স্টাফ রিপোর্টার: সাবেক ছাত্র নেতারা মনে করেন, ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি কলুষমুক্ত হবে না ; বরং এতে মানুষের মন থেকে তাদের অপরাধ ভুলিয়ে সহানুভূতি অর্জনের সুযোগ তৈরি করে দেয়া হবে। শেখ হাসিনার শাসনামলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর অপরাধের স্বচ্ছ বিচারের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব প্রদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে গত (২২অক্টোবর) বুধবার নির্বাহী আদেশে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অভ্যুত্থানকারী ছাত্র নেতৃবৃন্দ এতে উল্লসিত হলেও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বর্তমানে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে অনেকটা ‘রাখঢাক রেখে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘ছাত্রলীগের যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু, কেউ যদি মনে করে, আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে–তা গ্রহণযোগ্য নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে। বরং জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও আদর্শিক প্রতিরোধ বজায় রাখতে হবে।’
তার মতে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবশ্যিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। সেটি না করে ঘরে বসে কেবল আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে রুখে দেওয়ার চিন্তা ভুল। এতে বরং মানুষের মন থেকে তাদের অপরাধ ভুলিয়ে সহানুভূতি অর্জনের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে সংগঠনটির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে।
ছাত্রলীগ কীভাবে অধঃপতিত হলো–এ বিষয়ে জানতে সংগঠনটির কয়েকজন সাবেক সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও অন্যতম শক্তি ছিল ছাত্রলীগ। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব, মারামারি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক বাণিজ্য, বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচিতে হামলা, দমনপীড়ন ও অস্ত্রবাজির মতো অপরাধের হাজারো অভিযোগ ওঠে। এই সময়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অন্তত অর্ধশত প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান বলেন, ‘একটি ছাত্র সংগঠনের ছাত্রসুলভ আচরণ থাকা বাঞ্ছনীয়। ছাত্র সংগঠনের কাজ সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন নিশ্চিত করা, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ বজায় রাখা। তবে যে ছাত্র সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন করে, টেন্ডারবাজি, খুন, চাঁদাবাজি ও হেলমেট বাহিনী তৈরি করে সন্ত্রাস করে; বিশ্বজিৎ-আবরার হত্যার মতো সন্ত্রাস করে; তারা কোনো ছাত্র সংগঠন হতে পারে না। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তিযুক্ত মনে করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি সঠিক বলে ধরে নিচ্ছি।’
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল দমনকারীর ভূমিকায়। গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান শুরুর পর শিক্ষার্থীদের প্রতি মারমুখী ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিনও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে অস্ত্র হাতে অভ্যুত্থান দমনে রাজপথে দেখা যায়।
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গণহত্যার মূল হুকুমদাতা অর্থাৎ ছাত্রলীগের মাতৃ সংগঠন আওয়ামী লীগের কিছু হলো না। তাদের শীর্ষ নেতাদের যেখানে দেশ থেকে নিরাপদে বের করে দেওয়া হলো, সেখানে তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে কতটুকু অর্জন হবে, তা নিশ্চিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ যা করেছে, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গণহত্যায় তারা শামিল ছিল। সেটার শাস্তি হতেই পারে। তবে রাজনৈতিকভাবে সব মোকাবিলা করা দরকার।’
গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার পর শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানছাড়া হয় ছাত্রলীগ। গত ৫ আগস্টের পর সংগঠনের সভাপতি থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ নেতাদের সবাই আত্মগোপনে।
বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে পালাক্রমে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নাম করে ক্যাম্পাসে যেভাবে সন্ত্রাস করা হয়েছে, এর অবসান দরকার। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের যারা নৃশংসভাব ছাত্র হত্যা করেছে, ক্ষমতাসীদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে জঘন্য ভূমিকা পালন করেছে, তারা ছাত্র নামের কলঙ্ক। এই অপরাধীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হবে কি হবে না–এ বিষয়ে বক্তব্য নেই। এটুকু বলতে পারি, এ বিষয়ে সবার ঐকমত্য দরকার।’
গত ১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর এই নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বাতিল হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে যাওয়ার আড়াই মাসের মধ্যে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হলো। আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন অভ্যুত্থানকারীরা।