সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের সখীপুরে লাখ টাকা থেকে কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। এই ঋণ কার্যক্রমে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নামও ব্যবহার করছে চক্রের সদস্যরা। সাধারণ মানুষকে বলছেন মাত্র ১২ বছর হলেই যে কেউ আবেদন করতে পারবে ঋণের জন্য। শুধু তাই নয় এই ঋণের টাকা পরিশোধের নেই কোন সময়সীমা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন ঋণের প্রলোভন দেখাচ্ছে হাজারও মানুষকে। উপজেলার বহুরিয়া গ্রামের মো: মনিরুজ্জামানের বাড়িতে এমন প্রলোভনে প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে শতশত লোকজন ছুটে আসছেন ঋণের জন্য নাম লেখাতে। সেখানে মনিরুজ্জামান, তার স্ত্রী এবং জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তি পূরণ করে নিচ্ছেন ঋণের ফরম। গত এক সপ্তাহ থেকে চলছে এ কার্যক্রম। তবে স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, এটি একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র। যাদের কাজ হচ্ছে ঋণ দেয়ার নামে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে, অর্থ হাতিয়ে নেয়া।
সরেজমিনে বহুরিয়া গ্রামের মৃত. আরফান হাজীর ছেলে মো.মনিরুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের কয়েক গ্রামের নানা বয়সের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অসংখ্য নারী-পুরুষ ভিড় করেছে। বাড়ির উঠানে চেয়ার টেবিল ফেলে ফরম পূরণের কাজ চলছে। ঋণ প্রত্যাশীদের থেকে নেয়া হচ্ছে ব্যক্তির নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর, মোবাইল নম্বর ও স্বাক্ষর। সদস্যদের ফরমে লেখা ছিল ‘বিপুল ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে গণমুখী বিনিয়োগ জাতীয় সংস্থা বরাবরে পুঁজির জন্য ঋণের আবেদন।’
পরিচয় গোপন রেখে সংগঠক মনিরুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হয় এই ঋণ সম্পর্কে। মনিরুজ্জামান জানান, ‘দরখাস্ত করতে আইডি কার্ড, মোবাইল নাম্বার এবং স্বাক্ষর লাগবে। লোনটা এখনও পাশ হয়নি, লোনটা পক্রিয়াধীন। দরখাস্ত করতেছি ঋণের জন্য। যিনি এই কাজটা করতেছেন, ওনি ড. ইউনুসের খুব কাছের মানুষ। আগামী নভেম্বর এর ২৫ তারিখে একটা মিটিং হবে। আমরা আশা করতেছি মিটিং এর মাধ্যমে লোনটা পাশ হলে আমাদের কার্যক্রম শুরু হবে। যেমন বিভিন্ন জায়গা থেকে লুন্ঠিত অর্থ যেগুলো সরকারের হাতে আসতেছে, এরকম অবৈধ উদ্ধারকৃত, পাচারকৃত টাকাগুলো তখন পর্যায়ক্রমে ঋণ দেবে বিনা সুদে।’
পরে ওই বাড়িতেই মো. জাহাঙ্গীর হোসেন নামের ওই চক্রের আরও একজনের সাথে কথা হয়। দাবি করেন তিনি মিজাপুর থানার বাঁশতৈল ইউনিয়ন এর একজন সংগঠক। জাহাঙ্গীর জানান, ‘এই সংগঠনের আঞ্চলিক সংগঠক হিসাবে ৩ বছর যাবৎ কাজ করছি। আমরা শুধু সদস্য তৈরি করে দেই। আমরা কাজ করি টার্গেট অনুযায়ী। ৩০০ জন লোক দিতে পারলে নির্দিষ্ট একটা সম্মানী ভাতা আমরা পাই। আমাদের আঞ্চলিক মূল অফিস মির্জাপুরে।
তারা আরো জানান, আবেদন ফরমে গত দুই দিনে অন্তত এক হাজার এর উপরে মানুষের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রতিবেশী এক গৃহিণী জানান , ‘মনিরুজ্জামান সম্পর্কে আমার ছোট দেবর। আমাদের বাড়ির সবাই ঋণের জন্য আবেদন করেছি। দূর দূরান্ত থেকে অনেক লোকজন আসতেছে। গত (২১ অক্টোবর) কম করে হলেও পাঁচ-ছয়শ মানুষ আসছে।’
বহুরিয়া গ্রামের ওমান প্রবাসী আরিফ মিয়া জানান,’আমাদের বহুরিয়া বাজারে চায়ের দোকানে অনেক মানুষ এই ঋণ নিয়ে আলোচনা করছিল। পরে আমিও ঋণের জন্য আবেদন করি। মনিরুজ্জামান সম্মর্কে আমার নানা হয়। তিনি জানাইছে ড. ইউনুসের ফান্ড থেকে এই ঋণ দেওয়া হবে। এখন এটা প্রতারণা কিনা আমি বলতে পারবো না।’
বেড়বাড়ি গ্রামের আখি আকতার নামে এক গৃহবধূ জানায়,’আমার বাবার বাড়ি বহুরিয়া ইউনিয়ন এর চতলবাইদ গ্রামে। আমার বাবার বাড়ির আশে পাশের প্রায় সকলেই ঋণের জন্য ভর্তি হয়েছে। আমি আমার মায়ের কাছে এই ঋণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। পরে আমিও শ্বশুর বাড়ি থেকে এসে ওখানে ভর্তি হয়েছি। আমার দেখাদেখি আমার ভাসুরও ভর্তি হয়েছে। মায়ের কাছে জেনেছি, ড. ইসনুস নাকি এই ঋণ দেবে।
বাঁশতৈল গ্রামের ব্যবসায়ী রুবেল মিয়া জানান,’১৯ দিন হয়ে গেছে আমি আবেদন করেছি। এখনো কোন কার্যক্রম চোখে পরেনি। ঋণ পাবো কিনা জানি না। তবে আমার সাথে আর কেউ যোগাযোগ করেনি।
সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং ইন্টারন্যাশনাল টেকনোলজি অব বাংলাদেশের প্রধান কর্মকর্তা আল হাসান মিলাদ বলেন, জাতীয় পরিচয় পত্রের তথ্য এবং স্বাক্ষর যাচাই-বাছাই ছাড়া কাউকে দেয়া উচিত না। এগুলো ব্যবহার করে সাইবার জগতের অপরাধীরা আপনাকে ফাঁসাতে পারে।
বহুরিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি শুনেছি আমার ওয়ার্ডে একটি সংগঠন এরকম কাজ করছে। তবে কারা কোন বাড়িতে করছে তা জানা নেই।
এদিকে সরেজমিনে বিষয়টির তথ্য সংগ্রহে বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীরা স্খানীয় বহুরিয়া বাজারে একটি মুদি দোকানে প্রয়োজনীয় হালকা নাস্তা করার জন্য বিরতি দেয়। তার জের ধরে অভিযুক্ত মনিরুজ্জামানসহ অন্যান্যরা ওই দোকানদারকে সাংবাদিকদের অবগত করার সন্দেহে হুমকি ধামকি দিয়ে ওই দোকান বন্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে মুদি দোকানদার সোহেল রানা সখীপুর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকির হোসেন বলেন, এবিষয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।