সম্প্রতি, বাংলাদেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যার মাধ্যমে স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটার সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এই কোটার মাধ্যমে কিছু বিশেষ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভর্তি সুযোগ দেওয়া হতো, তবে সরকারের এই নতুন সিদ্ধান্তের ফলে সেই সুযোগ আর থাকছে না। কোটার ব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষিতে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। এর ফলে স্কুল ভর্তির ক্ষেত্রে কিছু নতুন নিয়ম এবং নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে, যা শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কী কারণ এবং এর ফলস্বরূপ কী প্রভাব পড়তে পারে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষভাবে কিছু শিক্ষার্থীকে সুবিধা দিতে বিভিন্ন সময়ে কোটার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। স্কুলে ভর্তি হতে বিশেষ শ্রেণির, যেমন দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, উপজাতি এবং অন্যান্য দুর্বল শ্রেণির জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা ছিল। এই কোটার মাধ্যমে তারা শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। সরকারের লক্ষ্য ছিল, এই কোটার মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা এবং সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য আরও সুযোগ সৃষ্টি করা।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন জনের মাঝে এই কোটার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। অনেকেই মনে করতে শুরু করেন যে, কোটার কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে এবং এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার হতে পারে। এছাড়া, অনেক শিক্ষাবিদ এবং সমাজকর্মীও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন যে, কোটার মাধ্যমে আসলেই কি সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতি যথাযথ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে, নাকি এটি শুধুমাত্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই নতুন সিদ্ধান্তের পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, মন্ত্রণালয় মনে করে যে, কোটার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে এবং এর ফলে প্রতিযোগিতা এবং মেধার মূল্যায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। যে শিক্ষার্থীরা মেধার মাধ্যমে স্থান পাওয়ার কথা, তারা কোটার কারণে তাদের স্বাভাবিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর যাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা ছিল, তারা ওই কোটার কারণে অনেক সময় যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়াই ভর্তি হয়ে যাচ্ছিলেন, যার ফলস্বরূপ তাদের শিক্ষাগত মান সন্তোষজনক নয়।
দ্বিতীয়ত, কোটার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যে অসন্তোষ এবং বৈষম্য তৈরি হচ্ছিল, তা সামাজিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের অশান্তি এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মাঝে এই বিষয়টি অনেক সময় হতাশার সৃষ্টি করছিল এবং তারা কোটার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করার জন্য এই কোটার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, শিক্ষার ক্ষেত্রে সমতা এবং ন্যায় নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তারা মনে করেন, কোটার মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে যেসব শিক্ষার্থী কোটার আওতায় আসেন, তারা আসলেই প্রয়োজনীয় সুযোগ লাভ করছেন কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ। সুতরাং, কোটার ব্যবস্থা বাতিল করার মাধ্যমে সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় আরো সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছতা আনতে চায়।
কোটার আদেশ বাতিল হওয়ার পর স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু নতুন নির্দেশনা প্রবর্তিত হবে। প্রথমত, ভর্তি প্রক্রিয়ায় মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থী নির্বাচিত হবে। অর্থাৎ, যে শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করবে, তাদের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া চলবে। ফলে, মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা স্থান পাবে, এবং কোনো ধরনের কোটার ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন প্রক্রিয়া চালু করা হবে, যার মাধ্যমে সামাজিক এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যারা শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছেন, তাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু সহায়তা প্রদান করা হবে। এর মাধ্যমে দুর্বল শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মূলধারায় যুক্ত হতে পারবে এবং তারা সুযোগ পাবে শিক্ষা লাভের। তবে, এই সহায়তাগুলি কোটার মাধ্যমে নয়, বরং প্রকৃত প্রয়োজনের ভিত্তিতে প্রদান করা হবে।
এছাড়া, কোটার বাতিলের পর, স্কুলগুলোকে আরও কঠোরভাবে এবং সুবিন্যস্তভাবে ভর্তি প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা স্বজনপ্রীতি হতে পারবে না। এতে করে স্কুলের ভর্তি প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং সমতাভিত্তিক হবে, যা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কোটার বাতিলের মাধ্যমে, সরকার শিক্ষার ক্ষেত্রে সমতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠায় একটি দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এর মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি একটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সমান সুযোগ প্রদান করবে।