Search
Close this search box.

লালনের দর্শনের এপিঠ ওপিঠ

লালনের দর্শনের এপিঠ ওপিঠ

সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

 

লালন শাহ (১৭৭২/৭৪-১৮৯০) ছিলেন প্রতীচ্যের সক্রেটিসের মতন প্রখর ধীশক্তি সম্পন্ন একজন অতি সাধারণ মানুষ যার ছিল এই বিশ্বজগৎ নিয়ে অসীম কৌতূহল। হাজার বছর ধরে মানুষ যে মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে লালন গভীর তত্ত্ব দিয়ে সেসবের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যাই তাঁর দর্শন। তিনি এতো বিস্তৃত বিষয় নিয়ে ভেবেছেন এবং প্রকাশ করেছেন যে কিছুতেই তাকে কয়েকটা লাইনের ভেতর প্রকাশ করা অসম্ভব। এই বিশ্বভূমিতে মানুষের জন্ম-রহস্য, ব্যক্তি মানুষের সাথে মহাজগতের সম্পর্ক, শরীর বা দেহের ভেতর অন্ত:লীলা, দেহতত্ত্ব, সমাজ, সামাজিক বৈষম্য, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, ধর্ম-নৈতিকতা, মানবতাবাদ, এবং লোকায়ত বোধ নিয়ে তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় রেখেছেন। তবে সবটুকুই তাঁর গানের মধ্য দিয়ে শিষ্য পরম্পরায় নথিভুক্ত হয়েছে। কারণ লালন কিছু লিখে রেখে গেছেন এমন তথ্য পাওয়া যায় না। সক্রেটিস যেমন তাঁর ভাবনাগুলো মানুষের মাঝে প্রচার করেছেন ঠিক লালনের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার পরেও সক্রেটিস এবং লালনের মাঝে আশ্চর্য মিল হল তাঁদের দু’জনকে নিয়েই গবেষণা হয়ে চলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে তাঁদের ওপর গবেষকরা নতুন নতুন চিন্তার বাঁক খোঁজ করে চলেছেন অবিরত। সক্রেটিস যেমনটি উপলব্ধি করেছেন, “নিজেকে জানো”। এই নিজেকে জানার উপলব্ধি প্রাচ্যবিদ্যা বিশেষ করে উপনিষদের মূল প্রত্যয়। লালন তেমনি গেয়েছেন, “আমার দেহ খানায় কে বিরাজ করে”। শাস্ত্রে বলছে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’,- হৃদয়ের ভেতর যিনি সর্বদা বিরাজ করছেন তাকে বুঝতে হলে মনের গহীন অন্তঃপুরে ঢুকে তাকে ছেঁকে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে সক্রেটিস এবং লালনের ভেতর সাঙ্ঘাতিক এক মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যদিও লালন সক্রেটিস সম্পর্কে কিছু জানতেন এমন তথ্য কারো কাছে নেই।

লালনের সঙ্গীত, যেটা লালন গীতি নামে বেশী পরিচিত তার গুরুত্ব অনুধাবন শেষে ২০০৫ সালে ইউনেস্কো ‘a Masterpiece of the Oral and Intangible Heritage of Humanity’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে এটা ঠিক, লালনের দর্শন কোন স্বীকৃতির ওপর নিশ্চয় নির্ভর করে না। তিনি ছিলেন নিজের গুণেই গুণান্বিত, আপন আলোয় উদ্ভাসিত নক্ষত্রের মতন। লালনের বিপুল সৃষ্টি আমাদেরকে বিস্মিত করে, ভাবিয়ে তোলে কিভাবে একজন স্বশিক্ষিত মানুষ, অবশ্যই দার্শনিক, এতো গভীরভাবে জীবন আর জগতের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন!

রবীন্দ্রনাথ লালন সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করে বলছেন, “শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হতো। আমার অনেক গানে আমি বহু সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিনীর সাথে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বানী কোন এক সময় আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স- শিলাইদহ (কুস্টিয়া) অঞ্চলের এক বাউল একতারা হাতে বাজিয়ে গেয়েছিল, ‘কোথায় পাবো তাঁরে-আমার মনের মানুষ যেঁরে।/হারায়ে সেই মানুষে- তাঁর উদ্দেশে/ দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে”। লালনের দর্শনের গভীর তত্ত্বের ওপর তাঁর লেখা “রিলিজন অব ম্যান” বিলেতের ম্যানচেস্টার কলেজে দেয়া একাধিক ভাষণ। ১৯৩১ সালে ম্যাকমিলান এন্ড কোম্পানি এই বিশ্ব সারা বিশ্বে রবীন্দ্র দর্শনের বিশেষ একটা দিক পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মানুষের ধর্মে রবীন্দ্রনাথ এক অপরিসীম জীবলীলার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেটা ভেতরের সাথে সাথে বাইরের; ব্যক্তি আমির সাথে বিশ্ব আমির। আমার ভেতরে নিয়ত যেমন এক অজানা লীলা বয়ে যাচ্ছে, তেমনি বয়ে চলেছে বহির্জগতে। এই বিশ্বভূমি সেই পরম নিয়তির টানে ছুটে চলেছে অনন্তের পথে, কাজেই এই ব্যক্তি আমি যখন মহা আমির সাথে মিলে যায়, তখনই প্রাণ গেয়ে ওঠে আনন্দের সঙ্গীত। এই জন্য ক্ষুদ্র আমির গণ্ডী থেকে বেরিয়ে পড়লে তখন আমরা বুঝি, আমার ভেতরে বিশ্বালোকের সাড়া মিলেছে। কবির নিজের কথায়, ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বালোকের পাবি সাড়া’।

একটা কথা না বললেই নয়, লালনের চিন্তার ভেতর একটা দুর্বোধ্য সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় যেটা কিছুটা বস্তুবাদ মিশ্রিত আধ্যাত্মবাদ। এবং এর প্রতিফলন ঘটেছে দেহতত্ত্ব বা দেহ-সাধনার ভেতর দিয়ে যা কিনা পৌঁছেছে কাব্যিক দ্যোতনার মাঝ দিয়ে অতীন্দ্রিয়বাদের গোপন ডেরায়। সুপ্রাচীন গ্রন্থ বেদের ভেতর এই ধরনের এক দ্বৈততা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। দেহ বস্তু, দেহ প্রসারিত এক পদার্থ মাত্র; কিন্তু এই নিথর দেহ আবার সব নয়। দেহ বা আত্মা কিম্বা মন – এই দু’য়ের দ্বৈত লীলার মাঝ দিয়ে প্রাণের প্রবাহ। তবে এটা ঠিক, লালনের চিন্তার এক বড় অংশ এই দেহের ভেতর জগত ও বিশ্বভূমির অনুভব। এর ভেতরেই সকল উপাসনার সারৎসার।

হাজার বছর ধরে এই উপমহাদেশে মানুষের ভেতর লোকধর্ম বা লোকায়তিক চিন্তা মনের অন্তঃপুরে প্রবলভাবে বিদ্যমান। মননে, মগজে, কথায়, ভাষায়, আচরণে লোকায়তিক বা সহজ ধারণা তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। লোকায়তিক চিন্তা সাধারণ মানুষের সহজ বোধ। অনেকে মনে করেন লোকায়তিক চিন্তা হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শন। আবার অনেকের ধারণা, বস্তুবাদ আর আধ্যাত্মবাদের এক অমিশ্রিত দ্রবণ হচ্ছে লোকায়তিক দর্শন। সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক, তাতি, কামার, কুমার, জেলে, ডোম, মুচি, মেথর, বীট, নরসুন্দর–এসব মানুষের সহজবোধই হল লোকায়তিক দর্শন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, “ওরা কাজ করে। ওরা মাটির বুকে ফসল ফলায়। তাই ওদের চেতনার নাম হলো লোকায়ত”। এই লোকায়তিক দর্শনের একটা সূক্ষ্ম কাব্যিক দ্যোতনা হল বাউল চিন্তা। কয়েক হাজার বছর ধরে এই সহজিয়া বা বাতুল চিন্তা বা পাগল ভাবনা, বাঙালি চেতনায় দারুণভাবে কাজ করে চলেছে। সূফীদর্শন, বৌদ্ধ সহজিয়া, চৈতন্যবাদ, বেদান্ত মায়াবাদ, সাংখ্য, যোগ, ন্যায় এবং কাপালিক তান্ত্রিকবিদ্যার এক মিশ্রিত উপাচার হচ্ছে বাউলমত। বাউলদের চিন্তা তাই একক কোন ভাবনার সরল রেখা নয়। তবে দেহতত্ত্বের বিভিন্ন অনুষঙ্গ এই দর্শনের গুঢ়বিদ্যা বলে লালন গবেষকদের ধারণা। ভারতবর্ষে এই লোকায়তিক আর কাপালিকদের প্রভাব ভীষণ প্রবল। এদের অনেকেই মনে করেন দেহই হচ্ছে সকল সাধনার মন্দির। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মতামত রেখেছেন, ‘The influence of the Lokayatikas and the Kapalikas is still strong in India. There is a sect and a numerous one too, the followers of which believe that deha or material human body is all that should be cared for, and their religious practices are concerned with the union of men and women and their success (siddhi ) varies according to the duration of the union’। অর্থাৎ শাস্ত্রী মনে করছেন, লোকায়তিক সম্প্রদায়ের আরেকটা বিশেষ পরিচয় হল কামসাধনা। স্ত্রী-পুরুষের মিলন! এই মতবাদের আরেকটা নাম বামাচার। শাস্ত্রী গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রাচীন পুথিতে সাক্ষ্য দিচ্ছে বামাচারী কাপালিকদের সাথে লোকায়তিকদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। অর্থাৎ লোকায়ত আর কাপালিক একই। সেই গুঢ়বিদ্যার কথায় একটু পরে আসছি।

প্রশ্ন হচ্ছে, লালনের অবস্থান কোথায়? সম্ভবত লালনের অবস্থান বিশেষ কোন দার্শনিক গণ্ডি ছাপিয়ে আরও গভীরভাবে সামাজিক চেতনার দিকে বিস্তৃত। এইজন্যই লালনের দর্শন উনিশ ও বিশ শতকের সামাজিক চেতনায় বিশেষ গুরুত্ব রেখে চলেছে। কতটুকু এর প্রভাব সেটা দেখা যাক। ভারতীয় ইতিহাসে অষ্টাদশ শতাব্দীকে বলা হচ্ছে রেনেসাঁর সময়কাল। প্রাচীন ভারত থেকে আধুনিক ভারতে পদার্পণের সন্ধিক্ষণ। এর প্রধানতম যুগস্রষ্টা হচ্ছেন রামমোহন রায়। কাকতালীয়ভাবে রামমোহনের জন্ম সাল লালনের সাথেই। অর্থাৎ ১৭৭২ সালে যখন ভারত প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদের বাড়াবাড়িতে কাতর, জাতধর্ম নিয়ে সামাজিক অনাচারে মানুষ ক্লান্ত, নারীর প্রতি হিংসা আর বিদ্বেষে সমাজ অতিষ্ঠ, তথাকথিত উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণের মানুষের মাঝে প্রবল বিরোধ, পৌত্তলিকতা আর আনুষ্ঠানিকতায় ঈশ্বর যখন চাপা পড়ে নিঃশ্বাস বন্ধের অবস্থা তখন এই দু’জনেরই জন্ম হয় দুই বাংলায়। দু’জনেই বিপ্লবী, দু’জনেই দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক, আর নজিরবিহীন সামাজিক প্রভাবক। রামমোহন তৈরি করেছিলেন হিন্দুধর্মকে সংস্কার করে ব্রাহ্মধর্ম আর লালন বানিয়েছিলেন ধর্মের উদ্ধে উঠে সকল মানুষের জন্য মানবধর্ম। তাইতো প্রায় দু’শ বছর ধরে এই দু’জন মহান দার্শনিক আজকের একবিংশ শতকের জন্য সমানভাবে জরুরী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহন সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। তাঁর মতে হাজার বছরের ভারতীয় ইতিহাসে রামমোহন ছিলেন বিপ্লবী। তিনি আধুনিক ভারতে সমাজ সংস্কারের অতি উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ লালনের গভীর চিন্তা দ্বারা কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা বোধকরি আমাদের অজানা নয়।

লালন শাহ ছিলেন মানবতাবাদী। এবং সত্যিকার অর্থেই মানবতাবাদী শব্দটা দ্বিধাহীন ভাবে তাঁর ওপর প্রয়োগ করতে আমার বিন্ধুমাত্র সংশয় নেই। কারণ তিনি সকল ধর্মের বিভাজন রেখাকে অগ্রাহ্য করে এক নতুন নৈতিক চিন্তার প্যারাডাইম তৈরি করেছিলেন। এটার নাম আমি দিয়েছি, “সোশিও-ইডিওলজিক্যাল” প্যারাডাইম। লালন তাঁর নিজের জীবন থেকে উপলব্ধি করেছিলেন নিজ ধর্মের মানুষ তাঁকে বিপদে ফেলে যেতে পারে। ধর্মের তথাকথিত বিভাজন নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাংঘাতিক রকম বিরক্ত। হিন্দু ও মুসলিমের মাঝে যে বিভাজন তা নিয়ে অগ্রাহ্য করে গেয়েছেন –
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারী জাতির কি হয় বিধান,
ব্রাক্ষ্মণ চিনি পৈতে প্রমাণ,
বামনি চিনি কিসেরে…
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,
লালন বলে জাতের কি রূপ,
দেখলাম না এই নজরে…

লালন জন্মেছিলেন ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে। হিতকরী পত্রিকার ভাষ্য মতে লালন তরুণ বয়সে যে তীর্থভ্রমণে বের হয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে ছিল তারই ঘনিষ্ঠ জনেরা। মৃত ভেবে ফেলে রেখে গেলে স্থানীয় মলম শাহ (কারো মতে তাঁর ভাই) তাঁকে নিয়ে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। সমাজ তাঁকে মেনে না নিলে তিনি চলে যান কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে। সেখানে স্ত্রী ও কিছু ঘনিষ্ঠদের নিয়ে বসবাস শুরু করলে সিরাজ সাঁই-এর সংস্পর্শে আসেন। এই সিরাজ সাঁইকেই তিনি গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। তখন থেকেই মনে হয়েছে ধর্মের বিভাজন অন্যায়। হিন্দু ও মুসলিমের ভেতর যে দীর্ঘকাল বৈরি সম্পর্ক সেটা শুধুমাত্র মানুষের অজ্ঞানতার জন্য। লালনের বংশ পরিচয় ঘেঁটে অনেকেই নিশ্চিত হয়েছেন তিনি ছিলেন হিন্দু পরিবারের সন্তান। আবার অনেকে তথ্য প্রমাণ থেকে দাবি করেছেন তিনি ছিলেন মুসলিম। লালনের গবেষকরা হিন্দু না মুসলিম তা নিয়ে যতটা সময় ব্যয় করেছেন লালন নিজে তত সময় সম্ভবত নষ্ট করেননি। এখানেই তাঁর মানবতার অবস্থান স্পষ্ট। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “মনের মানুষ”-এ লিখছেন, “লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে”। রবীন্দ্র পরিবারের সাথে লালনের একটা যোগাযোগের কথা জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের ১২ বছরের বড় দাদা জতীরিন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের একটা স্কেচ করেছিলেন মর্মে জানা যায়। বিশ্বভারতীতে জতীরিন্দ্রনাথের দুই হাজারের মত স্কেচ সংরক্ষিত আছে, যার মধ্যে লালনের এই স্কেচটিও আছে। কথিত আছে লালন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে একটা চোখ হারিয়েছিলেন। মুখের অবয়ব পরিবর্তন হয়ে গেছিল। চুল ছিল লম্বা। লালন তাঁর নিজের সম্পর্কে খুব কম বলতেন, তিনি সামাজিক বৈষম্য ও ধর্মের বিভাজন নিয়ে খুব বিরক্ত ছিলেন, মর্মে তাঁর গানে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানের মধ্যে ২৯৮-টি সংগ্রহ করেছিলেন। সবাই আমরা জানি তাঁর গানের সুর ও অর্থ এমনকি গানের তাল-লয় রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করে অনেক গান নিজে রচনা করেছিলেন। ধারনা করা হয়, রবীন্দ্র চেতনায় জীবনদেবতা বলতে যাকে বুঝিয়েছিলেন সেটাই লালনের মনের মানুষ। এই মনের মানুষের সাথে পরম সত্তা, আলেক সাঁই, পরম গুরু, অপার্থিব, অথবা আত্মতত্ত্ব কিম্বা আত্ম সত্তার ইংগিত দিয়েছেন। কেউ বলছেন, এই সত্তা অধরা, অস্পর্শিত চেতনা, এবং দুর্বোধ্য। এখানেই লালনের অতিন্দ্রিয়বাদ বা মিষ্টিসিজম।

লালনের মিষ্টিসিজম গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং তা প্রতীচ্য দর্শনের সাথে অনেকাংশে সাযুজ্যপূর্ণ। দেহ ও মনের ভেতর যে অনতিক্রম্য দ্বৈরথ সেটা তাঁর চিন্তায় ফুটে উঠেছে প্রকটভাবে। যেমন “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”। খাঁচা আর পাখীর রূপকের আড়ালে দেহ ও আত্মার যে দোলাচল তা লালনের কথায় স্পষ্ট হয়েছে ফরাসী দার্শনিক রেনে ডেকার্তের মতো। ষোড়শ শতকের ফরাসী দার্শনিক ডেকার্ত দেহ ও মনকে এমনই দু’টো স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন দেহ ও মনের ভেতর এক আন্তক্রিয়া সংঘটিত হয়ে চলেছে অবিরত। পরিভাষায় এটাকে বলা হয়ে থাকে ইন্টারএকশানিজম বা ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বাদ। শরীরের সাধারণ বৈশিষ্ট হচ্ছে বিস্তৃতি। বলা যায় এই বিস্তৃতির আছে রকমফের। কিন্তু খাঁচা নামক শরীরটা কাঁচা বাঁশের তৈরি যা অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং ক্ষণস্থায়ী। কঠ উপনিষদ বলছে,
আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মন প্রগ্রহমেব চ
[অর্থাৎ শরীরে অধিষ্ঠিত আত্মাকে রথী বলিয়া জানিও। জীবের শরীরকে রথ বলিয়া জানিও। বুদ্ধিকে রথচলা বলিয়া জানিও এবং মনকে প্রগ্রহ (লাগাম) বলিয়া জানিও।] এখানে তাই ভীষণভাবে স্পষ্ট, লালনের অধিবিদ্যা দ্বৈত প্রকৃতির, মন ও আত্মার যৌথ ঘর।

লালনের চিন্তার আরেকটা বিশেষত্ব হল, নারী ও পুরুষের মাঝে বিভাজন শেষে নারীকে মনচ্যুত করে অস্পৃশ্য ঘোষণা করা। লালন এর বিরধিতা করেছেন এবং বলেছেন,
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীলোকের কি হয় বিধান।
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কি করে।।
কেউ মালা কেউ তসবিহ গলে
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে।
আসা কিংবা যাওয়ার কালে
জাতের চিহ্ন রয় কারে।।
জগৎ জুড়ে জাতের কথা
লোকে গল্প করে যথাতথা।
লালন বলে জাতের ফাতা
ডুবাইছি সাধবাজারে।।

রামমোহন ভারতবর্ষকে সতিদাহ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন, লালন করতে চেয়েছেন সঙ্গীতের মাধ্যমে। কারণ লালন ছিলেন কবি, দার্শনিক ও অতীন্দ্রিয় ভাববাদী সাধক। লালন ছিলেন নিভৃতচারী বাউল সাধক, ঋষি, কবি, ও দার্শনিক। তাঁর কথার আড়ালে ছিল কথা। এটার নাম দর্শনের পরিভাষায় মেটা-কথা। রূপক দিয়ে বুঝাতেন গভীর অর্থ, সাধারণ কথা দিয়ে ইঙ্গিত করতেন অসাধারণ কথার। আলচনার শুরুতে আমরা যে সক্রেটিসের কথা বলেছি, সেটা বোধকরি অহেতুক নয়। এথেন্সের রাস্তায় রাস্তায় তিনি সাধারণ মানুষের জন্য যে কথাগুলো বলতেন তাতে অনেকেই ক্ষুব্ধ হতেন। তিনি তরুণদের মাঝে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দিতেন। লালনও তেমনি বাঙলার সাধারণ মানুষের কথা বলতেন, জানাতেন লোক-দর্শনের গভীর অর্থ।

আইরিশ দার্শনিক বিশপ বার্কলি বলেছেন, ‘আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি’। এটা আমিত্বের চরমতম বোধ। এই আমিত্বের প্রভাব দেখি লালনের মধ্যে।
বাড়ির কাছে আরশী নগর
(একঘর) সেথা পড়শী বসত করে-
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।।
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পারে,
বাঞ্ছা করি দেখব তারে
(আমি) কেমনে সেথা যাই রে।।
কি বলব পড়শীর কথা,
হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাই-রে
ক্ষণেক থাকে শূণ্যের উপর
(ওসে) ক্ষণেক ভাসে নীরে।।
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেতো দূরে।
সে আর লালন একখানে রয়-
(তবু) লক্ষ যোজন ফাঁক রে।।

খেয়াল করলে দেখা যাবে লালন স্পষ্টত এখানে আমি ও তার( অজানা সত্তা)মাঝে আছে এক বিভাজন। লক্ষ যোজনের ফারাক। এখানে তিনি অজ্ঞেয়বাদি এবং আত্মবাদি। সারা বিশ্ব সংসার এবং আমি, এই বিপুল মহাজগত এবং আমি—এই স্পষ্ট ,অস্পষ্টের দোলাচলে আমার বয়ে চলা। কে দেবে এর সঠিক ঠিকানা? যে ক্ষণ অজ্ঞাত, তার ঠিকানা যে অপরিজ্ঞেয়, অজ্ঞাত। লালন তাই একজন মিস্টিক, এগ্নস্টিক, এবং স্কেপ্টিকও। অনাদি অনন্তের হাত ধরে মহা জগত যেদিকে এগিয়ে চলেছে সেদিকের এক ভাবুক যাত্রী। রবীন্দ্রনাথ যেমন সারাজীবন সাধনা শেষে বলে উঠেছেন,

প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিলো
সত্ত্বার নতুন আবির্ভাবে
কে তুমি?
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেলো—
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিলো
পশ্চিম সাগর তীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়—
কে তুমি?
পেলো না উত্তর।

লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ