পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি শুধু একটি নতুন ক্যালেন্ডার বছরের সূচনা নয়, বরং এটি বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতিসত্তার গর্বিত বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে, ধনী ও দরিদ্র, নারী ও পুরুষ—সবাই এই দিনটিকে উদযাপন করে উৎসবমুখর পরিবেশে। কিন্তু এই আনন্দঘন দিনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
বাংলা সনের সূচনা হয় মুঘল সম্রাট আকবরের সময়। তিনি হিজরি চান্দ্রপঞ্জিকার পরিবর্তে কৃষিনির্ভর বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন ১৫৮৪ সালে, যাতে করে কর আদায় সহজ হয়। এই পঞ্জিকাই পরবর্তীতে বাংলা সন নামে পরিচিত হয়। কৃষিভিত্তিক সমাজে নববর্ষের প্রথম দিন ছিল খাজনা পরিশোধ, ফসলের হিসাব ও নতুন বছরের প্রস্তুতির সময়। এ কারণে এই দিনে ব্যবসায়ীরা ‘হালখাতা’ খুলতেন এবং পুরোনো দেনা-পাওনা চুকিয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতেন।
ব্রিটিশ আমলে পহেলা বৈশাখের উদযাপন সীমিত থাকলেও তা গ্রামীণ সমাজে বিশেষ গুরুত্ব পেত। এ সময় হালখাতা, মেলা ও লোকজ আনন্দ আয়োজন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাকিস্তান শাসনামলে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক আরোপিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে বাঙালির সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রতীক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এবং ছায়ানট এই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে ছায়ানটের নববর্ষের গান ও অনুষ্ঠান প্রথাগতভাবে পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর পহেলা বৈশাখ নতুন মাত্রা পায়। এটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। চারুকলা অনুষদের ছাত্র-শিক্ষকেরা বৈশাখী শোভাযাত্রা আয়োজন শুরু করে, যা পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে পরিচিত হয়। এই শোভাযাত্রা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক হিসেবে গড়ে ওঠে। ২০১৬ সালে ইউনেসকো এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়, যা বাংলাদেশি সংস্কৃতির জন্য এক গৌরবজনক অর্জন।
তবে এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে রাজধানীতে বাংলা নববর্ষের যে শোভাযাত্রা বের হয়, তার নতুন নামকরণ করা হয়েছে। এই শোভাযাত্রার নতুন নাম হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। যার আগে নাম ছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। গত ১১ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়।
পহেলা বৈশাখ শহরের পাশাপাশি গ্রামেও একই উচ্ছ্বাসে পালিত হয়। গ্রামে মেলা, পালাগান, লাঠিখেলা, নৌকা বাইচ ইত্যাদির আয়োজন করা হয়ে থাকে। শহরে রঙিন পোশাকে মানুষ রমনা, রমেশ্বরী, চারুকলা প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। খাবার হিসেবে ‘পান্তা-ইলিশ’ হয়ে ওঠে দিনটির অন্যতম প্রতীক। ব্যবসায়ীরা দোকানে হালখাতা করেন, ক্রেতাদের আপ্যায়ন করেন মিষ্টিমুখ করিয়ে।
পহেলা বৈশাখ এখন আর শুধু একটি ক্যালেন্ডার দিবস নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ঐক্য এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই যখন একসাথে মিলিত হয় নববর্ষ উদযাপনে, তখন এটি হয়ে ওঠে জাতির ঐক্যের এক অনন্য নিদর্শন। এই দিনটি আমাদের শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা এবং ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদের প্রতীক হয়ে রয়ে গেছে।
পহেলা বৈশাখ কেবল একটি উৎসব নয়, এটি আমাদের হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতি, আত্মমর্যাদা ও ঐতিহ্যের ধারক। এই দিনটির তাৎপর্য আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও সামাজিক চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সময়ের প্রবাহে এর রূপায়ণ পরিবর্তিত হলেও এর মূল সুর—মানবিকতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য—অটুট রয়েছে। নববর্ষের দিনটি আমাদের জীবনে আশার আলো জ্বেলে দেয়, পুরোনো গ্লানি ও হতাশা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়।
পহেলা বৈশাখ আমাদের শেখায় কিভাবে ভিন্নতা নিয়েও মিলেমিশে থাকতে হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই দিনটি উদযাপন করে যা প্রমাণ করে—বাঙালির উৎসব সর্বজনীন, সবার জন্য। এই জাতীয় ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
আমরা যেন এই সংস্কৃতিকে শুধু উৎসবের মাঝে সীমাবদ্ধ না রাখি, বরং এর অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ—সহমর্মিতা, সৌন্দর্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা—নিয়ে এগিয়ে যাই আগামীর পথে। পহেলা বৈশাখ হোক আমাদের সংস্কৃতি চর্চার, পরিচ্ছন্নতা ও মানবিকতার জয়গান।