শুক্রবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতির সূচনা: ইতিহাসের এক বিপন্ন অধ্যায়

নাসরিন সুলতানা

ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের ইতিহাস শুধু একটি জাতির আত্মপরিচয়ের খোঁজ নয়, বরং এটি এক দীর্ঘ রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের জটিল দলিল। এই অঞ্চল আজ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে যেমন বিতর্কিত, তেমনি মানবিক সংকটেরও কেন্দ্রবিন্দু।

প্রাচীন কালের বাইবেলীয় সময়েও ফিলিস্তিন অঞ্চলকে “পবিত্র ভূমি” হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে আধুনিক ইহুদি বসতি স্থাপনের বাস্তব রূপ নেয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে, ইউরোপে সিয়োনবাদী আন্দোলনের জন্মের মাধ্যমে। ১৮৯৬ সালে থিওডর হার্জল নামক অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাংবাদিক তাঁর “The Jewish State” গ্রন্থে একটি স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। ১৮৯৭ সালে প্রথম সিয়োনিস্ট কংগ্রেসে ফিলিস্তিনকে সেই রাষ্ট্রের সম্ভাব্য ভূমি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।

অটোমান শাসনামলে, সীমিত সংখ্যক ইহুদি ব্যক্তি ও সংগঠন ফিলিস্তিনে জমি কিনে কৃষি উপনিবেশ গড়ে তোলে। এসব বসতিকে তখনকার আরব জনগোষ্ঠী শঙ্কার চোখে দেখলেও ব্যাপক সংঘর্ষ তেমন ঘটেনি। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটিশ শাসন এবং ১৯১৭ সালের ‘বালফোর ঘোষণা’ এ পরিস্থিতিকে এক নতুন মোড়ে নিয়ে যায়। ঘোষণায় ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে একটি “ইহুদি জাতীয় আবাসভূমি” প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানায়, যা স্থানীয় আরবদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়।

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৯২২ সালে “ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন” কার্যকর করে, যেখানে একদিকে ইহুদি অভিবাসন উৎসাহিত করা হয়, অন্যদিকে আরবদের স্বার্থ রক্ষার কথাও বলা হয়। কিন্তু এই দ্বৈত নীতির বাস্তব রূপ ছিল ইহুদি বসতি গড়ে তোলায় নানাভাবে সহযোগিতা। ফলে ১৯২০ থেকে ১৯৪০-এর দশকে ইউরোপজুড়ে ইহুদি নিপীড়নের পরিণতিতে ফিলিস্তিনে অভিবাসনের ঢল নামে। এই ঢল স্থানীয় আরব জনগণের সাথে বিরোধকে বাড়িয়ে তোলে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ঘটে আরব বিদ্রোহ, যা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কঠোরভাবে দমন করে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা—বিশেষত নাৎসি বাহিনীর হাতে ইহুদি গণহত্যা—বিশ্বজনমতকে বদলে দেয়। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়—একটি ইহুদি ও অন্যটি আরব। ইহুদি পক্ষ তা মেনে নেয়, কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো ও ফিলিস্তিনি নেতারা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে অব্যবহিত যুদ্ধ শুরু হয়।

এই যুদ্ধে ইসরায়েল জাতিসংঘ নির্ধারিত সীমানার চেয়ে অনেক বেশি ভূমি দখল করে নেয়। প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি নিজভূমি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন—যা ‘নাকবা’ (বিপর্যয়) নামে পরিচিত। এ ঘটনা আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্বকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে।

পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের ‘ছয় দিনের যুদ্ধে’ ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এরপর থেকেই এসব এলাকায় ব্যাপক ইহুদি বসতি স্থাপন শুরু হয়। বর্তমানে পশ্চিম তীরে শত শত ইহুদি বসতি রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বিবেচিত হলেও ইসরায়েল এগুলোকে বৈধ ঘোষণা করে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত করে।

বিশেষ করে গাজা ও পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণের ফলে ফিলিস্তিনিদের চলাচল, কৃষিকাজ ও বসবাস চরমভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। একাধিক মানবাধিকার সংস্থা যেমন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ ও ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ বসতিগুলোর কারণে ফিলিস্তিনি জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। অনেক বসতিতে সৈন্য মোতায়েন করা হয়, নির্মিত হয় আলাদা সড়ক ও দেয়াল, যার মাধ্যমে অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

ইসরায়েল সরকার বসতিগুলোর নিরাপত্তার কথা বলে তাদের উপস্থিতি বৈধতা দিতে চায়, কিন্তু জাতিসংঘসহ অধিকাংশ রাষ্ট্র এগুলোকে দখলদারিত্ব হিসেবে দেখে। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) একটি পরামর্শমূলক মতামতে জানায়, পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা এসব বসতি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

এই বসতিগুলোর উপস্থিতি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা। ফিলিস্তিনিরা এগুলোকে দখলদারিত্ব ও নিপীড়নের প্রতীক হিসেবে দেখে। আন্তর্জাতিক মহলেও এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ বিরাজ করছে। জাতিসংঘসহ বহু মানবাধিকার সংস্থা একাধিকবার এই বসতিগুলোর নির্মাণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে, তবে স্থায়ী সমাধানের পথ এখনও অন্ধকারে ঢাকা।

ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতির সূচনা কোনো সাধারণ বসতি নির্মাণের ঘটনা নয়; এটি এক বিস্তীর্ণ রাজনৈতিক ও মানবিক দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা। ইতিহাসের একদিকে রয়েছে ইহুদিদের জাতিগত টিকে থাকার সংগ্রাম, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি হারানোর বেদনা। এই দ্বন্দ্বের সমাধান শুধু ভূখণ্ড নয়, ন্যায়বিচার, পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতেই সম্ভব।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ