Search
Close this search box.

রোকেয়া ইসলামের গল্প ‘বন্ধু আমার তোমার ভালবাসা থাকুক চিরকাল’

বন্ধু আমার তোমার ভালবাসা থাকুক চিরকাল
রোকেয়া ইসলাম

 

কালিদাস মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে বের হতেই  ব্যাগে ফোন বেজে ওঠে। তখন বোতল থেকে গলায় ঠান্ডা পানির বোতল উপুর করা ।
পানি গলা দিয়ে একেবারে বুকের ভেতরে প্রবেশ করে হিমেল আমেজ ছড়ায়।
গ্রীষ্মের অনাবৃষ্টি আর ঝাঁঝালো রোদের তাতানো  দুপুরে খোলা রাস্তায় না পারা যায়  চোখ পরিপূর্ণ করে তাকানো না পারা যায় দাঁড়ানো। তীব্র গরম  ধাওয়া করে গাড়িতে তুলে দেয়।
রিং সুর তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে চুপ হয়ে যায়।
ডলি লুৎফা লুলু এলে, ড্রাইভার স্টার্ট দেয়। ততোক্ষণে রিনু ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে লাল তারকা খচিত নম্বর কল দেয়।
কিরে কতদূর তোরা।
পাকুল্লা ছাড়াচ্ছি।
মাত্র।
ঠিক আছে তুমি কই।
আমি  বোনের বাসায় নাস্তা সেরে বসে আছি তোদের জন্য।
ঠিক আছে  আর পনর মিনিট পরে নিলুর বাসায় যা,  আমরা আসছি।
ছোঁ মেরে  ফোনটা কেড়ে নেয় , চমকে তাকিয়ে দেখে  লুৎফাকে পেরিয়ে ডলি হাত ততোক্ষণে নিজের কানে ফোন নিয়ে গলগল করছে।
ধারে কাছে কোন পারলার বুকিং দে,  আমাকে শাড়ি পরিয়ে দেবে।
আমাকেও আমাকেও আরো দুজনের সমস্বর ইথারে পৌঁছে দেয় ফিরোজাকে।
ধারেকাছের পারলার কোথায় জানি না।
খোঁজ তাড়াতাড়ি। শাড়ি পরতে পারিনা।
ফোনটা ফিরিয়ে দেয় রিনুর হাতে। পুরো গাড়ি জুড়ে গমগম করছে চারজন।
ওদের বন্ধু রাহেলার  ডাক্তার কন্যা আর আন্নার  ভাইয়ের  ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে।
দুই পক্ষ থেকে পুরানো বন্ধুদের সাড়াশি আমন্ত্রণ।
ওদের একটা গ্রুপ আছে, করোনাকালীন দুঃসহ যাপনের ভয়াল সময়ে রিনুর নাতীকে দিয়ে এই গ্রুপটা খুলেছে।  তাতে খুব সহজ হয়েছে যোগাযোগ। কতজনকে ভুলে গিয়েছিলো তারাও যোগ হয়েছে,  শুধু জন্ম শহরে থাকা বন্ধুরাই নয়, কর্মক্ষেত্রে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা যোগ দিলো, কেউ কেউ দেশের বাইরে থাকা বন্ধুদেরও যোগালো।
এখন মোটামুটি একটা সমৃদ্ধ গ্রুপ।
এই গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ওরা এখন কত জায়গায় বেড়াতে যায়। এর বাড়িতে এমাসে তো ওর বাড়িতে পরের মাসে। এই যে আজ যে বিয়ে সম্পন্ন হবে সেটারও  অনুঘটক এই গ্রুপ।  আন্নার ভাইয়ের ইঞ্জিনিয়ার ছেলে আর রাহেলার ডাক্তার মেয়ের বিয়ে।
ওরাও  আমন্ত্রিত হয়েছে এই গ্রুপের মাধ্যমে।
গাড়ি করোটিয়ায় ঢুকতেই লুৎফার ফোন বেজে ওঠে।
ওদের গ্রুপের সবচেয়ে হাসিখুশি মেয়েটি ফোন করেছে, ও মাত্র সাভার ক্রস করছে।  সময় দেখে বলে ও পৌছাতে পারবে ঠিকঠাক। পৌছেই তৈরি হতে হবে এই যা।
বাইপাস এড়িয়ে গাড়ি ঢুকে যায় শহরে । আট পুকুর পার হতেই পথের দুপাশের সোনালু রুপবতী কন্যার হাসিতে স্বাগত জানায়।
বিন্দু বাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে গাড়ি এগুতেই রিনু গাড়ি থামাতে বলে।
ওদের স্কুল এটা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ দশটা বিদ্যালয়ের একটা এটা।
ওরা নেমে পড়ে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য ড্রাইভারের ডাক পড়ে।
অনতিদূরে নিলুর বাসা।
দোতলায় প্রতীক্ষায় ছিল ও।
হুড়মুড়িয়ে দোতলার ফ্ল্যাটে ঢুকে ওরা।
ডাইনিং টেবিলে খাবার। কেউ ওয়াসরুমে ছেড়ে আসে কিছুটা ভার।
ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে আকন্ঠ পান করে বরফ শীতল পানি।
ওরা মোটামুটি তৈরি এমন সময় হুড়মুড়িয়ে বুলবুলি প্রবেশ করে।ও  দ্রুত তৈরি হতেই হতেই চিনু আর ফিরোজা এসেই জড়িয়ে ধরে ডলিকে। রিনু হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে। উছলে ওঠা আবেগ কিছুটা থিতু হতেই চিনু তাকায় রিনুর দিকে।
অপরিচিত দৃষ্টি আঁটকে রাখে দুজনকে। ফিরোজা বুঝতে পারে লিকলিকে রিনুর মেদের পাহাড় শরীরে আঁটকে আছে চিনুর দৃষ্টি রিনুও চিনুর বয়সী ছাপের মুখটা থেকে সরিয়ে বের করছে লাবণ্যময়ী চিনু।
ওরে রিনুরে তুই!
দুই হাত প্রসারিত করে করে দেয়।
হৈচৈ আনন্দের বিয়ে বাড়িতে যোগ হয় আরো অনেকজন। রিনুকে বেশ কয়েকজন বন্ধু চিনতে পারলো না। তাদের আর দোষ কি রিনু স্কুলে এতোই চিকনা ছিল যে ওকে সবাই বগা বলে চিনতো। এমনিতেই ও সবার চেয়ে মাথায় উঁচু ছিল তার উপর গলাটা ছিল চিকন আর লম্বা।
এখন ওর মেদবহুল শরীরটায় গলা ঘাড় মেদুল হয়ে গেছে, এই বস্তাভরা মেদভর্তি মানুষটাকে কে আর চেনে।
পারু তো বলেই ফেললো, ছিলি বগা আর এখন মুটকি ভুটকি, না চিনলে রাগ করিস না বন্ধু।
আরে আমার মেদ তো খালি বাড়ে আর বাড়ে।
রাতে সবাই নিলুর বাসায় থাকবে এমন কথাই ছিল।
বুয়া বড় ভাতের হাঁড়ি চুলায় বসায় অন্য চুলায় আলু বসিয়ে দেয় সাথে ডালও থাকে। দুপুরে ভারি খাবার পর রাতে ভর্তা ভাত মানে ডায়েট ব্যলেন্স করা আর কি।
রাত আটটার মধ্যেই জমে যায় আড্ডা । হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে।

সবাই এলোমেলো হয়ে শুয়ে বসে আড্ডায় মশগুলো এই অসময়ে কে এলো!  কারো তো আসারও কথা নয়।
নিলুর বাড়ি, অবাক ও নিজেই খুলতে যায় দরজা।
হৈ হৈ করে ঘরে ঢুকে চিনু ফিরোজা পারভীন।
আরে ওদের তো অন্যত্র থাকার কথা।
আরে বাদ দে কি কথা আর কথা নয় তোরা চুটিয়ে আড্ডা দিবি আর আমরা থাকব না এটা কি হতে পারে?
সরাসরি প্রশ্ন রেখে পা ছড়িয়ে খাটে বসে।
আরে না না আহো বন্ধুরা আহো বেবাক খুইল্লা আড্ডা দেই।
খুলতে পারুম না শরম লাগে।
আমার শরীরে তো কাপড়ই নাই খালি ঢিল্লা নাইটি এডাও খুলতে কস।
হাসতে হাসতে সবার পেটে খিল ধরে যায় রিনু আর বুলবুলির শব্দ আর অঙ্গভঙ্গিতে।
ট্রেতে অনেক গুলো  কাপে ধুমায়িত চা নিয়ে আসে নিলু।
নিলু আর কোন খাবার আনবে না প্লিজ।
খাবার কোথায় এতো গল্পের অনুষঙ্গ।
যাই হোক চুপচাপ বস, যার দরকার সে তৈরি করে নেবে চা।
চুপচাপ বসতে পারব না এই গল্পের হাটে, সবাই কথা বলছে আর আমাকে কেন নিশ্চুপের  কারাগারে নিক্ষেপ করছো বল তো।
আরে আরে আমি কি সে কথা বলেছিরে।
কথার লতা থেকে নতুন চারা, সে চারার আবার লতা, লতা থেকে কুশি, কুশি থেকে লতা বেড়ে যায়, এভাবেই এগুতো থাকে গল্পের ঝাড়।
ফিরোজা বলছে পঞ্চাশ বছর আগের জীবন। কত প্রেম কত প্রেমিক কতজনে প্রেমকাহিনী তাদের প্রেমিকদের অতীত বর্তমান। সব যেন ওর জানা।
চিনুকে আসতে দিলো কালাম ভাই।
আচমকা প্রশ্ন করে রিনু।
আমি বলেছি তো তাই আসতে দিবেই দিতেই হবে কালাম ভাইকে।
এতো জোর তো কালাম ভাইয়ের উপর।
ওদের প্রেমকাহিনীর একমাত্র জীবন্ত সাক্ষী আমি।
এ্যই কোন ক্লাস থেকে প্রেম করছিলি তুই।
সেভেন না এইট।
ওরা থাবলে ধরে চিনুকে।
ফিরোজা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়।
কত বছর পর ছোট্ট একটা ঢিল পরলো ওর নিরবে নিভৃতে রাখা সুপ্ত অনুভূতির দেয়ালে।
একই পাড়ায় থাকতো ফিরোজা আর কালাম।  বড় ভাইয়ের বন্ধুত্বের সূত্র ধরে আগমন ওদের বাড়ির  অন্দরমহলে।
সবার চেয়ে একটু অন্যভাবে তাকায় কালাম ফিরোজার দিকে।
তাকানোতে একরাশ মুগ্ধতা বুঝতে পারে ফিরোজা। মাত্র হাফপ্যান্ট ছেড়ে পাজামা ওরনা ধরেছে, তবে পুরুষের দৃষ্টি বোঝার ঐশ্বরিক ক্ষমতা নারীর জন্মসূত্রে প্রাপ্য।
ওরা তো আর এই যুগের পুতুপুতু মেয়ে না।
কালামের ঘন ঘন আগমন কাচারি ঘরে লুডু ক্যারাম খেলার আসর ছেড়ে জগ ভরে পানি নেবার ছলে ভেতরে এসে গভীর দৃষ্টিতে তাকাতো  ফিরোজার দিকে।
ফিরোজারও খুব ভালো লাগতো কালামকে ওর ভেতরও দানা বাঁধছে কালামের জন্য ভাললাগার চেয়েও বেশি কিছু।
নিহাররঞ্জন গুপ্তের” মাধবী ভিলা ” বইটা কিনে নিয়ে যায় স্কুল থেকে ফেরার পথে।
কিছুতেই খুঁজে পায় না কি লিখবে বইতে।
সেদিন কাচারি ঘরে ধুম ক্যারাম খেলা হচ্ছে বুঝতে পারে ফিরোজা।
আজ কি কারো পানির পিপাসা পায়নি,  একবারও যে এলো না কালাম পানি নিতে অথচ ছাদ ফাটিয়ে সম্মিলিত হাসিতে কালামের প্রাণময় শব্দ মিশে আছে।
“খালাম্মা কেমন আছেন ” আজ একবারও বাড়ির ভেতর এলো না এটা নিয়ে মায়ের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ফিরোজাই অস্থির পদচারণায় মুখর করছে ঘর উঠোন।
পরদিন স্কুলের সময়ের একটু আগেই বের হয় ফিরোজা মনের অস্থিরতা সবুজ কামিজ সাদা ওড়না ভাঁজ করে ক্রস বেল্টে আঁটকে।
দুরে একটা কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুলে ছাওয়া গাছের   নিচ থেকে হেঁটে আসছে দুজন। খুব চেনা ভঙ্গিটা ফিরোজাকে থামিয়ে দেয়।
ফুলের ঝরণাধারা নেমেছে গাছ থেকে নিচে সবুজে হলুদে মাখামাখি অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে ফিরোজা।
ওকে দেখে যুগল পা চালিয়ে কাছে আসে । কাছাকাছি আসতেই ফিরোজার ছোট্ট পৃথিবী আধার হয়ে আসে। তীব্র তাপদাহ গ্রাস করে ওকে। তবুও বৃষ্টি বিহীন লু হাওয়ায় দৃঢ়তায় দাঁড়ায়।
চিনু আর কালাম একেবারে কাছে আসে।
কেমন আছো ফিরোজা।
কালামের দৃষ্টি ফিরোজার মুখে।
চোখ জোড়া খুঁজতে এতোদিনে মুগ্ধ ভালবাসার দৃষ্টি।
চিনু ফিরোজার হাত দুটি ধরে থাকে। ওর সমস্ত শরীর থেকে মৃদু  অচেনা সুর বের হচ্ছে।
চোরাবালিতে ডুবতে ডুবতেও বইয়ের ব্যাগে হাত রাখে।
পায়ের তলে শক্ত মাটির নাগাল পায়।
ব্যাগ  খুলে” মাধবী ভিলা ” বইটি বের করে দেয় দুজনের হাতে।
কিছু লিখে দে
চিনুই কলম বের করে দেয়।
“বন্ধু আমার তোমার ভালবাসা থাকুক চিরকাল”
সকালে ফিরোজাকে দেখে  মা আঁতকে ওঠে এ কাকে দেখছে!
নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এসময় একটা শুদ্ধ বোধ আঁকড়ে ধরে।
বই আর বই সবচেয়ে বড় প্রেম।  ফলাফল ভাল হয়।
স্কুল ছাড়ার পর আর দেখা হয়নি চিনুর সাথে কালামের সাথে। তবে খোঁজ পাওয়া যেত,  ওরা বিয়ে করেছে, চুটিয়ে সংসার করছে।
করোনাকালে B B G গ্রুপে এলো সবাই। দেখা হলো চিনুর সাথে।
রাহেলা আর চিনুর নিমন্ত্রণে ওরা এসেছে। কত বছর পর  সামনাসামনি দেখা হলো কতজনের সাথে চিনুর সাথে কালামের সাথে।
কিরে তুই বারান্দায় কেন?
এমনি।
তোকে বলা হয়নিরে তোর বইটা কিন্তু এখনও আমার কাছে আছে।
কোনটা!
ঐযে “বন্ধু আমার তোমার ভালবাসা থাকুক চিরকাল ”
তাই।
জড়িয়ে ধরে ফিরোজা কালামের নিত্য ছোঁয়া চিনুকে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ