দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি এলাকা বাদে সব জায়গা থেকে ইসরায়েল মঙ্গলবার সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে বাস্তুচ্যুত বাসিন্দারা সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোতে ফিরতে শুরু করেছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতে এলাকাগুলো ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীনে বিলম্বিত সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে কফার কিলায় ফিরে আলা আল-জাইন জানান, পুরো গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এটি একটি বিপর্যস্ত এলাকা। ধ্বংসাবশেষ ও সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞার কারণে গাড়িতে করে কফার কিলায় পৌঁছনো সম্ভব হয়নি, তাই বাসিন্দারা গ্রামের প্রবেশপথে গাড়ি রেখে হেঁটে ফিরে যান।
দুই মাস ব্যাপক যুদ্ধসহ প্রায় এক বছরের সংঘর্ষ ২৭ নভেম্বর যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়। তারপর বাসিন্দারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত বা ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি, কৃষিজমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফিরে পায়। ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষের ঠিক আগে ঘোষণা করেছিল, তারা সীমান্তের কাছে ‘পাঁচটি কৌশলগত পয়েন্টে’ সেনা মোতায়েন রাখবে এবং মঙ্গলবার দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এ মোতায়েন নিশ্চিত করেন ও হিজবুল্লাহর কোনো ‘লঙ্ঘনের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার লেবানন জানায়, তাদের ভূখণ্ডে ইসরায়েলি উপস্থিতির অর্থ ‘দখলদারিত্ব’ এবং তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করবে, যাতে ইসরায়েল পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করে। দেশটির সশস্ত্র বাহিনী সীমান্তে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানানো হয়। লেবাননের সেনাবাহিনী জানায়, তারা সোমবার সন্ধ্যা থেকে শুরু করে দক্ষিণ সীমান্তবর্তী ১১টি গ্রামসহ অন্যান্য এলাকায় মোতায়েন হয়েছে, যেখান থেকে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। এক যৌথ বিবৃতিতে জাতিসংঘের দূত জেনিন হেনিস-প্লাসচার্ট ও ইউনিফিল শান্তি রক্ষা বাহিনী জানায়, ইসরায়েলের প্রত্যাহার ও লেবাননের সেনাবাহিনীর মোতায়েনের জন্য নির্ধারিত সময়সীমার শেষের পর যেকোনো ‘বিলম্ব আমাদের প্রত্যাশার বাইরে’ এবং এটি ২০০৬ সালের নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের লঙ্ঘন, যা ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের থিংকট্যাংক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের জ্যেষ্ঠ ফেলো ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস বলেন, একবার লেবাননের সেনাবাহিনী দক্ষিণে ‘সম্পূর্ণ মোতায়েন’ হলে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ‘সম্ভবত সম্পূর্ণ প্রত্যাহার সম্পন্ন করবে…যতক্ষণ হিজবুল্লাহ চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে’।
ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসা
অন্যদিকে লেবাননে পুনর্গঠনের ব্যয় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং জাতিসংঘের মতে এখনো এক লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত রয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞ সত্ত্বেও গ্রামবাসীরা ফেরার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে জাইন জানান। দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘পুরো গ্রাম ফিরছে, আমরা তাঁবু খাটিয়ে বা মাটিতে বসেই থাকব। ’অনেকেই ধ্বংসস্তূপের নিচে স্বজনদের মৃতদেহ খুঁজতে দক্ষিণে গিয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সামিরা জুমা, যিনি ভোরবেলা কফার কিলায় গিয়ে হিজবুল্লাহ যোদ্ধা তার ভাইয়ের মরদেহ খুঁজতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো তাদের কোনো খবর পাইনি। আমরা নিশ্চিত তারা শহীদ হয়েছেন। আমি এসেছি আমার ভাইকে দেখতে এবং সেই ভূমি স্পর্শ করতে, যেখানে সে ও তার সহযোদ্ধারা লড়াই করেছে।’ আরো দক্ষিণে লেবাননের সেনাবাহিনীর একটি চেকপয়েন্টে বহু গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, যাতে তায়বেহ ও ওদাইসেহ গ্রামের দিকে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। সেখানে কিছু নারী তাদের আত্মীয়দের ছবি ধরে রেখেছিলেন, যারা যুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহর পক্ষে লড়াই করে নিহত হয়েছেন, অন্যরা ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীটির হলুদ পতাকা উত্তোলন করেন। লেবাননের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে এবং বৈরুতে অবস্থিত হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিগুলো এই সংঘাতে ব্যাপক ধ্বংসের শিকার হয়েছে। গোষ্ঠীটি গাজা যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় মিত্র হামাসকে সমর্থন দিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালায়।
হিজবুল্লাহ নিরস্ত্র হবে?
ওয়াশিংটন ও প্যারিসের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েলি সেনাদের ৬০ দিনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হবে, যার সময় বাড়িয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয় এবং সেই সঙ্গে লেবাননের সেনাবাহিনী ও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা মোতায়েন হবে। এ ছাড়া হিজবুল্লাহকে লিতানি নদীর উত্তরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সরিয়ে নিতে হবে এবং সেখানে তাদের বাকি সামরিক স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সীমান্ত সংঘাতে লেবাননে চার হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সীমান্তের ওপারে সেনাসহ দেশটির ৭৮ জন এবং দক্ষিণ লেবাননে স্থল অভিযানের সময় আরো ৫৬ জন সেনা নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া যুদ্ধবিরতির পর থেকে প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ২৪ জানুয়ারিতে দুই ডজনের বেশি নিহত হয়, যখন বাসিন্দারা সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে ফেরার চেষ্টা করছিল। লেবাননের সরকার গত সোমবার ঘোষণা করে, শুধু রাষ্ট্রের হাতে অস্ত্র থাকা উচিত, যা হিজবুল্লাহর অস্ত্রভাণ্ডারের ব্যাপারে ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা দেয়। যুদ্ধের পর থেকে গোষ্ঠীটি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং তাদের নিরস্ত্রীকরণের দাবি আরো জোরদার হয়েছে।