Search
Close this search box.

যমুনা পাড়ে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য

যমুনা পাড়ে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য
শাহনাজ পারভীন এলিস

বিকেল ৩টা। তপ্ত সূর্যটা একটু একটু পশ্চিমা দিগন্তে হেলে পড়ছে। আর নীল আকাশের নীলাভ আভায় যমুনা নদীর পানি সাগরের নীল রঙ ধারণ করেছে। সেই নীল জলরাশির ওপর সূর্যের মায়াবি রুপালি রশ্মি চক চক করছে; যেন যমুনার জলে মিলেমিশে একাকার। সূর্যাস্তের চিকচিকে আলো নদীর পানির ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে মিশে মায়াবি এক আবহ তৈরি করেছে। মনে হচ্ছে ঢেউয়ের সাথে তার নিবিড় সখ্য বহুদিনের। সূর্যাস্তের এমন অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাবেন- নদীবেষ্টিত টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার যমুনা সেতু এলাকার বেলটিয়া পাথরঘাট এলাকায়।

সূর্য বিদায়ের ক্ষণ
এরপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে ক্লান্ত সূর্যটা আর হেলে পশ্চিমে। সূর্যের রূপালি আভা ধীরে ধীরে রক্তিম লাল বর্ণ ধারণ করতে থকে। এই মাঝে কিছুক্ষণ পর পর নদীতে বয়ে চলছে তরুণ পর্যটক বহনকারী ট্রলার নৌকা। নদীর ঢেউ আর মিউজিকের তালে তালে তাদের উদ্মাম নৃত্য আনন্দ বার্তা বহন করে পৌঁছে দিচ্ছে সবদিকে; যা আপনাকে মুগ্ধ করবে। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা-কালো মেঘের দল। মেঘমালা ভেদ করে নদীর জলে সূর্যের রক্তিম আভা জল জল করে উঠছে। নদীর পানি হালকা জোয়ার-ভাটার স্রোতে সূর্য্যরশ্মি যেন অপরূপ খেলায় মাতোয়ারা। সূর্য্যমিামা যমুনা সেতুর দিগন্তে ডুবে গেলেও তার রক্তিম আভা সেতুর প্রাপ্ত ভেদ করে অনেক দূর পর্যস্ত আলো ছড়ায়; সেই মহুর্তে চলন্ত ট্রলারে থাকলে আপনি বেশ কিছুক্ষণ থাকবেন মায়াবি সৌন্দর্যের আবহে। পশ্চিমাকাশে সূর্য বিদায়ের এমন অপরূপ দৃশ্য আকৃষ্ট করছে প্রাকৃতিপ্রেমি ও ভ্রমণ পিয়াসি মানুষকে।

বিপুল পর্যটকের আনাগোনা
অস্তগামী সূর্যের মায়াবি সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেতু এলাকায় প্রতিদিনই ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। সম্প্রতি ঈদুল আজহার ছুটিতে যমুনা সেতু এলাকার কালিহাতীর বেলটিয়া পাথরঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে মুখরিত বিস্তীর্ণ নদীর তীর। যমুনা সেতু ঘিরে পুরো এলাকা জুড়েই পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দর্শনার্থীরা। দুপুরের দিকে লোক সমাগম কিছুটা কম থাকলেও সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তা বাড়তে থাকে। সবারই অপেক্ষা নদীর বুকে সূর্যাস্ত দেখার। যমুনা নদীতীরের বিস্তীর্ণ জলরাশি, উপরে রক্তিম উদার আকাশ। গোধূলি লগ্নে যমুনা সেতু থেকে পূর্বদিকে অদূরে উন্মুক্ত নদীতীরে দাঁড়ালে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সূর্য অস্তমিত হচ্ছে আর আকাশের রক্তিম রঙে নদীর জল রঙিন হয়ে ওঠছে। এসময় দিগন্তে দ্রুত রঙ বদলাতে থাকে। অস্তগামী সূর্যের লাল টিপ কপালে পরে পৃথিবী যেন নববধূর সাজে। ঝিলিমিলি ঢেউখেলানো সোনারঙের জলে জেলেদের নৌকা ভেসে চলার অপূর্ব দৃশ্য। আর নদীর তীর ঘেঁষে বাতাসের স্রোত সাঁতরে উড়ে চলে সাদা বক, গাঙচিলের ঝাঁক। রক্তিম সূর্য তার উষ্ণতা বিলিয়ে লাল হতে হতে নিচে নামতে থাকে।

এমন দৃশ্য অনেকেই মোবাইল ফোন অথবা ক্যামেরায় ছবি তুলে স্মরণীয় করে রাখার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। ছবি তোলার পর কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট বা শেয়ার করছেন। অনেকে আবার ফেসবুকে সূর্যাস্তের দৃশ্য লাইভ প্রচার করছেন- গোধূলির সময়ে আবিরে রাঙা অস্তায়মান লাল সূর্য। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে কমতে থাকে চারপাশের কর্মকোলাহল। প্রকৃতিতে নেমে আসে অন্যরকম এক প্রশান্তি। পশু-পাখি নীড়ে ফিরে যেতে থাকে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর শুরু হয় মানুষের ঘরে ফেরার পালা। চরাচরে সর্বত্রই বিরাজ করে এক নৈসর্গিক নীরবতা। সূর্যের রক্তিম আলোচ্ছটায় প্রকৃতি যেন অন্যরকম রঙে নিজেকে সাজায়। বিস্তৃত যমুনার নদীতীর, স্বর্গীয় আভায় রাঙনো আকাশ। নদীতীরের এই শোভা, এমন অপরূপ রূপের মাধুরী দু’চোখভরে দেখতে বার বার ছুটে যান প্রকৃতিপ্রেমীরা। বিশ্বস্রষ্টা যেন নিজেকে আড়ালে রেখে মোহময় সৌন্দর্যের মধ্যে মানুষকে ডুবিয়ে রেখেছেন।

দর্শনার্থীদের জন্য ট্রলার
বেলটিয়ায় যমুনা নদীতীরে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের নদীতে বেড়ানো এবং সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পাথরঘাট এলাকায় রয়েছে যাত্রীবাহী ট্রলার। পর্যটকদের আনন্দ দেয়ার জন্য কোন কোন ট্রলারে রয়েছে মিউজিক সিস্টেমের ব্যবস্থা; যা তরুণ প্রজন্মের দর্শনার্থীদের আরও বেশি আকৃষ্ট করে। নদীর ঘাটে কর্মরত ট্রলার চালক মোহাম্মদ মোন্নাফ জানান, এই ঘাট এলাকায় প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি যাত্রীবাহী ট্রলার যাতায়াত করলেও ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে এই যাত্রীবাহী ট্রলারের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়। কারণ ঘাটে নিয়মিত দর্শনার্থী দেড় থেকে ২শ’ থাকলেও বিভিন্ন উৎসবে তা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তবে এসব ট্রলার চালাতে তাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধির অনুমতি নিতে হয় বলেও জানান তিনি। নদীতে ট্রলারে করে যমুনা সেতুর ওইপাড় হয়ে ঘুরে আসতে প্রতি ২০ মিনিটের জন্য জনপ্রতি ভাড়া নেওয়া হয় ৫০ টাকা।

নদীতীরের ব্যবস্থাপনা
সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগে পাথরঘাট এলাকায় ব্যাপক পর্যটক ও দর্শনার্থীর আনাগোনা ক্রমেই বাড়ছে। তবে আগত দর্শনার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে সেতু কর্তৃপক্ষ বা সরকারি উদ্যোগে কোন অবকাঠামোই গড়ে উঠেনি। শুধু বেসরকারি উদ্যোগে ঘাট এলাকায় চালু হয়েছে কিছু অস্থানী খাবারের দোকান, যা পরিবেশসম্মত নয় বলে অভিযোগ করেন পর্যটকরা। এছাড়া ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য ঘাট এলাকায় নেই স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও। এতে নদী এলাকায় গিয়ে প্রায়ই বিপাকে পড়তে হয় বলে অভিযোগ অনেকের।

দর্শনার্থীদের প্রত্যাশা
যমুনা নদীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়া দর্শনার্থী লিপি আক্তার জানান, সূর্যাস্তের অপরূপ এই দৃশ্য দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগে। তাই পরিবার নিয়ে প্রায়ই আসেন। তিনি বলেন, ‘সূর্য ডোবার ক্ষণে তার মনে হয় নদী আর আকাশ যেন মিশে গেছে দিগন্তরেখায়। সূর্য যেন কান পেতে শুনছে পৃথিবীর গোপন বিষাদের সুর। তারপর সেই অগ্নিগোলক যেন নদীর বুকে টুপ করে ডুবে গেল। আঁধারের কালো চাদর আচ্ছন্ন করে চারদিক। চরাচরে ঝিঁঝিঁর শব্দ, জোনাকির মিটিমিটি আলো, ঝিরিঝিরি বাতাসে সৃষ্টি হয় নতুন এক আবেশ। অস্তায়মান সন্ধ্যায় আবছা আঁধারে নদীর ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর বিচূর্ণ আলোর কারুকাজ সত্যিই বিস্ময় জাগিয়ে দেয়। ইচ্ছে হয়, সেই ঢেউয়ের কারুকাজে একটু হাত রাখি। ছুঁয়ে দেখি আলোছায়ার বিচিত্র লুকোচুরি। ঘনায়মান সন্ধ্যার অপরূপ রূপের মাধুর্য ধরে রাখি হৃদয়ে।’ তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে আধার এই নদীতীর ঘিরে আগ্রহী দর্শনার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় কোন অবকাঠামো গড়ে না উঠায় হতাশা জানান তিনি। বেলটিয়া পাথরঘাট এলাকায় যমুনা নদীর এই পাড় ঘিরে সরকারি উদ্যোগে বিনোদন ব্যবস্থা এবং দর্শনার্থীদের জন্য উপভোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলার দাবি জানান তিনি।

জেলা প্রশাসক ও সেতু কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বেলাভূমি এই যমুনা সেতু এলাকায় কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। স্থানটিকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করতে কোন পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. আতাউল গণি জানান, এ বিষয়ে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার আসলে বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের। তবে তিনি জানান, সেতুর নিকটবর্তী বেলটিয়া পাথরঘাট এলাকাকে পর্যটনের জন্য উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে উপযোগী করে গড়ে তুলতে সেতু কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন তিনি।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, যমুনা নদীর সৌন্দর্য আর সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে সেতু এলাকায় বেড়েই চলেছে পর্যটকের ভিড়। তাই সেতুকে ঘিরে এর পাশর্^বর্তী এলাকায় পর্যটকদের থাকার জন্য কিছু অবকাঠামো নির্মাণে যমুনা রিসোর্ট নামে একটি প্রকল্প নিয়েছিলো সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটির চুক্তিভিত্তিক ইজারা স্থানীয় ঠিকাদার আব্দুল আওয়াল মিন্টুকে দেয়া হয়। কিন্তু তিনি শর্ত ভঙ্গ করায় তার সাথে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। এপর্যায়ে অন্য ঠিকাদার খোঁজা হচ্ছে। নতুন ঠিকাদার চূড়ান্ত হলে প্রকল্পের কার্যক্রমে পুনরায় গতিশীল হবে। এছাড়া নদী তীরের সৌন্দর্য বর্ধন, পর্যটকদের জন্য বসা ও মানসম্পন্ন স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে।
কালিহাতী বেলটিয়া এলাকার এই নদীতীরে একদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর সৌন্দর্য ও পাশেই চলছে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর কাজ। রেল সেতুর কাজকে ঘিরে নদীতে রয়েছে ছোট বড় জাহাজ। এতে নদীর সৌন্দর্য আরও বেড়েছে। স্থানীয়রা জানায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন তার পরিবার পরিজন নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু সংলগ্ন যমুনা নদীর তীরে বেড়াতে আসছে। কনোনা মহামারির কারণে (২০২০-২০২১) দু’বছর বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় এখন সুযোগ পেলেই পরিবার-পরিজন ঘুরতে যাচ্ছেন। নৌকা দিয়ে উপভোগ করছেন যমুনা নদী ও সেতু এলাকার অপার সৌন্দর্য।

বঙ্গবন্ধু সেতু নৌ পুলিশ স্টেশনের ইনচার্জ মো. ফজলুল হক মল্লিক জানান, যমুনা নদীর পাড়ে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য নিরাপত্তা সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া আছে। নদীঘাট ও নৌকাযোগে ঘুরে বেড়াতে দর্শনার্থীদের যাতে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে না হয় সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর রয়েছে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।

বঙ্গবন্ধু সেতু বাংলাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে কৌশলগত সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। যমুনা নদীর ওপর এই সেতু নির্মিত হওয়ার পর এর উভয় পাড়ের মানুষের নানবিধ সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত এই সেতু আন্ত:আঞ্চলিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছে। সড়ক ও নৌপথে দ্রুত পণ্য এবং যাত্রী পরিবহন ছাড়াও এটি বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস বিজ্ঞান এবং সমম্বিত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেছে। এই সেতুটি এশিয়া মহাসড়ক এবং আন্ত:এশিয়া রেলপথের মধ্যবর্তী। ফলে এগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়ার পর এই সেতু নির্মাণ এশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে উত্তর পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ও রেল যোগাযোগ সৃষ্টি করবে।

১৯৯৮ সালের জুনে বঙ্গবন্ধু সেতু উন্মুক্ত করা হয়। এই সেতুর যমুনা নদীর পূর্ব পাড়ের ভুয়াপুর এবং পশ্চিম পাড়ে সিরাজগঞ্জকে সংযুক্ত করেছে। এটি ১৯৯৮ সালে নির্মাণকালীন সময়ে পৃথিবীর ১১তম বৃহত্তম সেতু এবং বর্তমানে এটি দক্ষিণ এশিয়ার ৬ষ্ঠ বৃহত্তম সেতু। এটি যমুনা নদীর উপর দিয়ে নির্মিত; যা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি সেতুর একটি এবং পানি প্রবাহের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। লেখক- সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ