জাকির হোসেন
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম এশিয়াবাসী। ১৯১৩ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তখন পর্যন্ত গীতাঞ্জলিই ছিল তার ইংরেজিতে অনূদিত একমাত্র গ্রন্থ। কবিগুরু যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন তিনি ভারতবর্ষ তো দূরের কথা, বাংলাভাষী মানুষের কাছেও সমধিক পরিচিত ছিলেন না। তার নোবেল পাওয়ার খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র বাঙালি জাতি আবেগোচ্ছল হয় এবং তাকে ‘বিশ্বকবি’ আখ্যায় ভূষিত করে। ওই সময় নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কবিগুরু নোবেলপ্রাপ্তির তারবার্তাটি পাওয়ামাত্র তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী নেপালচন্দ্র রায়ের হাতে সেটি তুলে দিয়ে বলেন, ‘যাক এতদিনে শান্তিনিকেতনের জলনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থার কিছু একটা উপায় হলো।’ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, পুরস্কারের সমস্ত অর্থ কুষ্টিয়া গ্রামীণ কৃষি ব্যাংকে জমা করা হয়েছিল এবং কিছুদিন পরই ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। কবিগুরুর গীতাঞ্জলি পাঠ করে পশ্চিমা সাহিত্য অনুরাগীরা বিমোহিত হয়েছিল। বিখ্যাত আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গ্রন্থটির প্রথম ইংরেজি সংস্করণে দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছিলেন। কিন্তু ১৯১৩ সালে পুরস্কার প্রদানমাত্র ইয়েটস ক্ষিপ্ত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ধিক্ টেগোরকে ধিক্!… সে তো ইংরাজি ভাষাই জানে না, এমনকি কোনো ভারতীয়ই ইংরাজি ভাষা জানে না।’
শুধু ইয়েটসই নন, এক সময়ের ইংরেজ রাজকবি রবার্ট ব্রিজেস, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোটেনস্টাইন ও লেখক এজরা পাউন্ডও কবিগুরুর বিরুদ্ধে অশোভন মন্তব্য করেছিলেন। তাদের অনুরূপ অশালীনতা থেকে রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের অমর উক্তি-
‘The East is East and Wes is West
N’er the twain shall meet.’ সত্য প্রমাণিত হয়।
কবিগুরু নোবেল পাওয়ার পর সুইডিশ সাহিত্যিক ভেরনের হাইদেনস্টাম বলেন, ‘বোধহয় বহুকালের জন্য প্রথম ও শেষবার আমরা এমন একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিককে খুঁজে পেয়েছি যাকে বছরের পর বছর সংবাদপত্রের কলামের মধ্যে পুরস্কারটির জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়নি।’ হালস্ত্রোম নামে অপর এক সুইডিশ সাহিত্য সমালোচক বলেন, ‘১৮৩২-এ গ্যেটের মৃত্যুর পর থেকে ইউরোপে রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য কোনো কবির জন্ম হয়নি।’
নোবেল পুরস্কারের রীতি অনুযায়ী পুরস্কারপ্রাপ্তকে ছয় মাসের মধ্যেই গুণীজনদের সামনে একটি বক্তৃতা দিতে হয়। কবিগুরু তার নোবেল বক্তৃতায় বলেন- অবশেষে আপনাদের দেশে আসতে পেরে আমি খুশি আর এই অবকাশেই আমার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আমাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে সম্মানিত করার জন্য আমি আমার কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করতে চাইছি। মনে পড়ছে সেই বিকেলবেলার কথা, যেদিন আমি আমার ইংল্যান্ডের প্রকাশকের তরফ থেকে তারবার্তা মারফত এই পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটা পাই। আমি তখন আমার বিদ্যালয় শান্তিনিকেতনে রয়েছি। আমার মনে হয়, এই বিদ্যালয়টির বিষয়ে আপনারা জ্ঞাত রয়েছেন। সেই মুহূর্তে আমি একটি দল নিয়ে কাছাকাছি এক জঙ্গলে বেড়াতে যাচ্ছি। ডাক ও তার অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে একজন দৌড়তে দৌড়তে এসে আমার হাতে সেই তারবার্তাটি দিয়ে যায়। আমার সঙ্গে গাড়িতে সেই সময়ে একজন ইংরেজ পর্যটকও ছিলেন। তারবার্তাটি যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এমনটা সেই মুহূর্তে মনে হয়নি। আমি সেটিকে পকেটে পুরে রাখি। গন্তব্যে পৌঁছে সেটি পড়ব, এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার অতিথি সম্ভবত বিষয়টি জানতেন এবং তিনি আমাকে অনুরোধ করেন সেটি পড়ে ফেলতে, বলেনÑ এতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বার্তা রয়েছে। আমি তার অনুরোধেই খাম খুলে বার্তাটি পড়ি।
প্রথমে নিজেরই বিশ্বাস হয়নি। মনে হয়েছিল, টেলিগ্রাফের ভাষায় কোনো গণ্ডগোল রয়েছে, নয়তো আমিই সেটিকে পড়তে ভুল করছি, ভুল মানে বুঝছি। যা হোক, ক্রমে ধাতস্থ হই, বুঝি আমি ঠিকই পড়েছি। আপনারা অনুমান করতে পারেন, আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে এই খবর কতটা আনন্দবাহী। আমাকে যা সব থেকে বেশি অভিভূত করে তা হলো, এই যে এই ছেলেরা আমাকে ভালোবাসে এবং তাদেরকেও আমি গভীরভাবে ভালোবাসি। এ সম্পর্ককে এই পুরস্কার এক অনন্য সম্মানে ভূষিত করল। আমার দেশবাসীর সঙ্গেও আমি এই সম্মান ভাগ করে নিতে চাই।
সেদিন বাকি বিকালটাও এভাবেই যায়। রাতে আমি ছাদে একা বসে নিজেকেই প্রশ্ন করি, পশ্চিমে আমার এই গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মানের কী কারণ থাকতে পারে? আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ের এক ভিন জাতের মানুষ। পশ্চিমের সন্তানদের থেকে সর্ব অর্থেই আলাদা। আমার এই প্রশ্ন কোনো উচ্চমনস্কতা থেকে জাত নয়, তা প্রকৃতই আমার হৃদয়ের গহিন থেকে উঠে আসা। সেই মুহূর্তে নিজেকে খুবই তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল।
মনে পড়ছিল, আমার লেখালেখির শুরুর সেই দিনগুলোর কথা। আমি তখন নেহাতই তরুণ। আমার তখন ২৫ বছর বয়স। বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে গঙ্গাবক্ষে এক নৌকায় প্রায় নির্জনবাস করি। শরতে হিমালয় থেকে উড়ে আসা পরিযায়ী বুনো হাঁসরাই আমার একমাত্র জীবন্তসঙ্গী। সেই নির্জনতায় আমি মুক্ত দিগন্তকে অফুরান রৌদ্র-সুধার মতো পান করেছি, নদীর ছলোচ্ছল ধ্বনি আমার কানে কানে যেন প্রকৃতির নিগূঢ় রহস্যের কথা বলে গেছে। এক নিরবচ্ছিন্ন নির্জন স্বপ্নে আমার দিন যায়, আমি সেই স্বপ্নকে কবিতায় রূপ দিতে থাকি।
কলকাতার মানুষজন সেসব লেখা পত্রপত্রিকা মারফত পড়েন। বুঝতেই পারছেন, সেই জীবন পশ্চিমের চেয়ে একেবারেই আলাদা। আমার জানা নেই, আপনাদের সভ্যতার কোনো কবি তার জীবনের তরুণ দিনগুলোর একটা বড় অংশ এমন বিচ্ছিন্নতার মধ্যে কাটিয়েছেন কি না। আমার বিশ্বাস, পশ্চিমা বিশ্বে এহেন বিচ্ছিন্নতার কোনো স্থানই নেই।
আমার জীবন এমনভাবেই কেটেছে। সেই সময়ে আমি আমার দেশবাসীর কাছেও অপরিচিত বলা যায়। আমার প্রদেশের বাইরে আমার নাম কেউ শুনেছেন বলেও মনে হয় না। সেই অপরিচয় নিয়ে কিন্তু আমি বেশ সুখীই ছিলাম। এই অপরিচয় আমাকে জনারণ্যের কৌতূহল থেকে রক্ষা করেছে। এবং এক সময়ে এই নির্জনতার কুহর থেকে বেরিয়ে আসার এক তাগিদ আমি অনুভব করতে শুরু করি। মনে হতে থাকে, আমার সহ-মানবদের জন্য কিছু কাজ করা প্রয়োজন। তা শুধু আমার স্বপ্নগুলোকে সাকার করার প্রয়াস নিয়ে নয়, বরং আমার ভাবনাগুলোকে নিয়ত কিছু কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে, আমার সহযাত্রীদের কাজে আসে এমন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে।
সবার আগে আমার মাথায় এসেছিল ছোটদের পড়ানোর কথা। তার মানে এই নয় যে, আমি এই কাজে বিশেষ দক্ষতার অধিকারী। বরং এ কথা বলা যেতে পারে যে, আমি নিজে নিয়মিত শিক্ষালাভের পূর্ণ সুফলগুলো পাইনি। সেই কারণে আমি প্রথমে এই কাজ নিজের হাতে নিতে দ্বিধাগ্রস্তও ছিলাম। কিন্তু এ কথাও অনুভব করি যে, প্রকৃতির প্রতি আমার এক অকৃত্রিম ভালোবাসা রয়েছে, শিশুদের প্রতিও রয়েছে। আমি এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যেখানে মানবশিশুরা প্রকৃতির কোলে মুক্তির আনন্দ, জীবনের আনন্দ খুঁজে পায়। অল্প বয়সে আমি নিজে স্কুলে বেশ কিছু অন্তরায়ের সম্মুখীন হয়েছি। আমি জানি, বেশিরভাগ শিশুকেই এই বাধাগুলোর মুখোমুখি হতে হয়। আমাকেও শিক্ষাযন্ত্রের সেই যন্ত্রণাকে সহ্য করতে হয়েছে, যেখানে আমার মুক্তি আর জীবনের আনন্দ পেষাই হয়ে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। আমি জানি, এই আনন্দের জন্য শিশুরা সর্বদা তৃষ্ণার্ত থাকে। আমার উদ্দেশ্য ছিল, মানব-সন্তানদের কাছে এই মুক্তি আর আনন্দকে পৌঁছে দেওয়া। আমার চারপাশের কিছু বালককে আমি পড়িয়েছি, তাদের আনন্দ দিতে চেয়েছি। আমি তাদের খেলার সাথি ছিলাম। তাদের সঙ্গে আমি জীবন ভাগ করে নিয়েছি। আমি অনুভব করেছি, আমি তাদেরই একজন, তাদের দলের সব থেকে বড় শিশু। খোলা হাওয়ায় আমি তাদের সঙ্গেই বেড়ে উঠি। শিশুদের অন্তরের আনন্দস্রোত, তাদের গান-গল্পে মেতে থাকা আকাশ-বাতাসে মুক্তির সুধারসকে আমি প্রতিদিন পান করি। প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময়ে আমি একা বসে পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেদের লক্ষ করি। সন্ধ্যার নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও আমি শিশুদের কলতান স্পষ্ট শুনতে পাই। মনে হয় সেই আনন্দগান, সেই কলধ্বনি যেন গাছেদেরও। তারা যেন মাটির বুক থেকে উঠে আসা জীবন-ঝরনা, অনন্ত আকাশের দিকে মাথা তুলে আনন্দগান গেয়ে চলেছে।
একে প্রতীক হিসেবে দেখে আমি বুঝতে পারি, মানব-জীবনের যাবতীয় আনন্দের অভিব্যক্তি, মানবাত্মার হৃদয়ের উৎসস্থল থেকে উঠে আসা আশার বাণী সেই অনন্ত আকাশের দিকেই ধাবিত। আমি যেন স্পষ্ট তা দেখতে পাই। বুঝতে পারি, আমরাও আসলে বড় হয়ে যাওয়া শিশু, আমাদের কলতানকে অনন্তের দিকে পাঠিয়ে চলেছি। আমি এই অনুভূতি হৃদয়ের উৎসস্থল থেকে বুঝি। এই পরিবেশ আর পরিস্থিতিই আমাকে ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলো রচনা করতে প্রাণিত করেছে। উজ্জ্বল তারায় তারায় খচিত ভারতের আকাশের নিচে বসে মধ্যরাতে আমি তাদের গাই এবং খুব ভোরে, এমনকি গোধূলিতেও আমি এই গানগুলো লিখি। এই গানের দল বয়ে চলে পরের দিনটির দিকে। আরও একবার এই মহাপৃথিবীর হৃদয়দ্বারে প্রবেশের প্রেরণা লাভ করি।
লেখক: সাংবাদিক