Search
Close this search box.

মানবাধিকার নিয়ে রাজনীতি আছে, কিন্তু রাজনীতিতে মানবাধিকার নেই

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

জাতিসংঘ মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেটের বাংলাদেশ সফরটি রাজনৈতিক অঙ্গনকে বেশ খানিকটা নাড়িয়ে গেছে বলতে হবে। যাওয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি মানবাধিকার সংক্রান্ত এমন কিছু কথা বলেছেন, যা দেশের জন্য অস্বস্তিকর। তিনি বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এবং এ জন্য সহযোগিতা করতে তার বাংলাদেশ অফিস প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন তিনি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার যেসব কথা বলেছেন, সেগুলোর সঙ্গে একমত বা দ্বিমত পোষণ করার চেয়ে বড় কথা হলো মেনে নেওয়া যে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের ভাবমূর্তির সংকট চিরদিনের। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বহুল আলোচিত দুটি বিষয়। এসব বিষয়ে আমাদের সরকারি অবস্থানটা পরিষ্কার নয়। তবে এটাও ঠিক, এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেখানে গুম হওয়া ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছিলেন এবং পরে ফিরে এসেছেন। অনেকে ফিরে এসে একদমই কথা বলছেন না, তথ্য দিচ্ছেন না এবং তাদের এই আচরণটাই বলে দেয় কোনও না কোনও জায়গা থেকে একটা ভয়ের সংস্কৃতি জিইয়ে রাখা আছে। কিন্তু বড় যে নির্মম কথাটি বলতে হয়, মানবাধিকার নিয়ে রাজনীতি করলেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডায় স্বাধীনতার এই ৫১ বছরেও মানবাধিকার কোনও বিষয় নয়। ক্ষমতায় থাকা দল আর ক্ষমতার বাইরের দল যতটা একে অপরকে দোষারোপের প্রচেষ্টায় লিপ্ত, যতটা বিদেশিদের কাছে অভিযোগ করতে তৎপর, ততটা সক্রিয় নয় বিভিন্ন জায়গায় অতি দরিদ্র মানুষ, শ্রমিক, কৃষক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু মানুষ যেসব লড়াই লড়ছেন, সেগুলোর সাথে যোগ দিতে। এত মানুষের দেশে সরকারি ক্ষমতা পাওয়া যেকোনও রাজনৈতিক দলের কাছেই যে কতটা লোভনীয়, তা যে কারোই ভোটদাতার বুঝতে অসুবিধা নেই। আপাতভাবে যে রাজনৈতিক দর্শনেরই চর্চা করুক, নীতিগত কিছু ফারাক থাকলেও ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পদ্ধতিগত কোনও মৌলিক তফাৎ নেই বড় দলগুলোর। এরা সমান হিংস্রতা নিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করতে চায়, মানুষকে ভোট থেকে দূরে রাখতে চায় কিংবা সম্ভব হলে নির্বাচনি ব্যবস্থাকেই এমনভাবে সাজাতে চায় যেন কেবল তারাই জিতে। মানুষ তার অসহায় শিকার। এহেন রাজনৈতিক সংস্কৃতি যখন মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে তখন মানুষ আরও একবার বুঝতে পারে যে তাদের নিয়ে মসকরা করছে রাজনীতি।

কোন সমস্যাকে তারা প্রাধান্য দেবেন, এমনকি তাদের সমস্যাগুলো ঠিক কী, সেটা ঠিক করে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব এবং সেখানে মানুষের কোন অংশগ্রহণ নেই। এটা এক অদ্ভুত অবস্থা। জনগণ ভোট দেয়, না দিলেও ক্ষতি নেই, রাজনৈতিক দলের মধ্যে জোর যার ক্ষমতা তার। সেই রাজনৈতিক দলই আবার স্থির করে জনগণ কোন কোন সমস্যা নিয়ে ভাববে বা ভাববে না। মাত্রই পালিত হলো ১৫ আগস্ট ও একুশে আগস্ট। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে যারা বিচার বিচার করার পথ বন্ধ রেখেছিল, যারা একুশে আগস্ট একটি রাজনৈতিক দলের পুরো নেতৃত্বকে গ্রেনেড হামলা করে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে বিচারের নামে প্রহসন করেছিল, তারাও মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার। এখনকার শাসক দল আবার বুঝতে চাইবে না যে জাতিসংঘ যেসব কথা তুলেছে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়াও আবার মানবাধিকারের রাজনীতি নয়, বরং সাহস নিয়ে এসব অভিযোগের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ভেতরেই সুশাসনের বীজ।
কিন্তু এ পথে পা বাড়ায় না আমাদের রাজনীতি। বরং কথার মাধ্যমে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ চালিয়ে রাজনীতির ভেতরেই সব আনন্দ ও সাফল্য দেখে এই রাজনীতি। জনগণের দরজার কাছে যে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা আছেন, কিংবা সংসদ সদস্যরা আছেন, তারা কী মানুষের কথা শোনেন? পরিবেশ দূষণ, জমি, খাল বিল দখল, তাদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের কাছে গেলে, দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনও কাজ হয় না। নেতারা এসব বিষয়কে গুরুত্বই দিতে চান না। জনপ্রতিনিধিরা গুরুত্ব দেন না বলে প্রশাসনও তৎপর হয় না। সারা দেশেই মূল বিষয়গুলো স্থির হয় রাজনৈতিক দলের স্বার্থ হিসাব করে, বিশেষ করে বড় ও প্রভাবশালী নেতাদের দেখভাল করার জন্য। এমন এক রজনীতির, যার কোনও অতীত বা ভবিষ্যৎ নেই, পুরোটাই বর্তমান। যা পাও লুটে নাও। জনগণের হাহাকার বা চিৎকার, কোনোটাই শুনতে পায় না এই রাজনীতি। রাজনীতিতে এই বধিরতা গণতন্ত্রের সংকট তৈরি করেছে, কিন্তু কেউ সচেতন নয়। দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোরও কোনও চেষ্টা নেই কোথাও।

মিশেল বাশেলেট যা বলেছেন সুশীল সমাজে তার আলোচনা হবে, বিরোধী পক্ষ এ নিয়ে যা বলবে, সরকারি পক্ষ তার বিপরীতটা বলবে। দিনশেষে মানুষের অধিকার কেবলই বিতর্কের বিষয়, সেই অধিকার আদায়ের বিষয় নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর বানানো নিজস্ব কিছু সমস্যা নিয়ে নিজেরা হইচই করে, নাগরিক সমাজও তাতে যোগ দেয়, গণমাধ্যম যোগ দেয়, কিন্তু এসবের কোথাও মানুষ, নেই মানুষের প্রতিনিধিত্ব। কারণ, আগেই বলেছি মানবাধিকার নিয়ে রাজনীতি আছে, কিন্তু রাজনীতির কাছে মানবাধিকার গুরুত্বহীন। মূলধারার রাজনীতি এবং নির্বাচনের অন্যতম মূল বিষয় যদি মানবাধিকার রক্ষা না হয়, তাহলে কখনোই সংবিধানের আওতার বাইরে থাকা মানুষের সমস্যাটা সমস্যা হয়ে উঠবে না এবং জাতিসংঘের বড় কর্তারা বারবার বললেও সমস্যার সমাধান হবে না।

লেখক: সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ