টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থ ও পঞ্চম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। গত তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে তুলে এনেছেন অন্য রকম এক উচ্চতায়। ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইস্যুতে অনেক সমালোচনার জায়গা হয়তো আছে। তবে বাংলাদেশ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, দুই দশক আগে সেটা কেউ কল্পনাও করেনি।
অনেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার নিয়ে কথা বলেন। এটা মানতেই হবে, বাস্তবায়ন যতটুকুই হোক, আওয়ামী লীগ বরাবরই ইশতেহারের ব্যাপারে সিরিয়াস। দলের দর্শনটা পরিষ্কার ফুটে ওঠে ইশতেহারে। ধাপে ধাপে বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান শেখ হাসিনা, তারও স্পষ্ট চিত্র থাকে ইশতেহারে। তবে ইশতেহার নিয়ে আমার আগ্রহ একটু কম। কারণ, আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যা ছিল, তারচেয়েও অনেক বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন- সবকিছুই আমাদের গর্বিত করে। গড় আয়ু, মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু, দারিদ্র্যের হার- সব সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অর্জন বিস্ময়কর। পাকিস্তান তো বটেই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।
আপনি শেখ হাসিনার যত বড় সমালোচকই হোন, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ২০ বছর আগে আজকের বাংলাদেশ আপনার কল্পনায় ছিল? পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, স্যাটেলাইট, সাবমেরিন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ- শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একের পর এক বিস্ময়ের জগতে পা রেখেছে বাংলাদেশ। গোটা বাংলাদেশ এখন ৫ ঘণ্টার দূরত্বে। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে শিক্ষা আর বিদ্যুতের আলো। শেখ হাসিনা সত্যি সত্যি অসম্ভবকে সম্ভব করতে জানেন। স্কুলজীবন থেকে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করে আসছি। নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছি। তখনকার বিএনপি সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়ায় শহীদ জননীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছি বটে, কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় এটা দেখে যেতে পারবো ভাবিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা এ দুটি বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে পিতার হত্যার কোনও প্রতিশোধ নেননি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। তবে তার আগে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ চিরতরে বাতিল করে সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করতে হয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে ক্ষমতার ধারাবাহিকতার কারণে। পাঁচ বছর পরপর সরকার বদল হলে কোনও সরকারই তার কাজ শেষ করতে পারে না, দূরদর্শী পরিকল্পনা করতে পারে না। কিন্তু টানা ক্ষমতায় থাকার সুবাদে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পান। তাই তো তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রায় হাঁটেন। ডেল্টা পরিকল্পনা করেন শত বছরের বাংলাদেশ নিয়ে।
অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রগতি অনেকটাই থমকে যায় করোনাকালে। অবশ্য সেই ধাক্কা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই লেগেছিল। করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার লড়াই চলতে চলতেই চলে আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের অভিঘাত বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও লেগেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। মেয়াদ নতুন হলেও, দল পুরনো, নেতৃত্বও পুরনো। তবু নতুন সরকারের কাছে নতুন প্রত্যাশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছে জাতি।
যেমনটি বলছিলাম, করোনা ও যুদ্ধের ধাক্কা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও লেগেছে। ডলারের দাম বেড়েছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ কমেছে। যার প্রভাব সরাসরি পড়েছে বাজারে। জিডিপি, রিজার্ভ, মাথাপিছু আয় নিয়ে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। সাধারণ মানুষ চায়, নিত্যপণ্যের দাম তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে। কিন্তু গত কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। সরকার নানাভাবে ন্যায্যমূল্যের পণ্য নিয়ে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম যেখানে পৌঁছেছে, তাতে শুধু গরিব নয়, মধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থাও সঙ্গিন। নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগের ১১টি অগ্রাধিকারের প্রথমটিই দ্রব্যমূল্য। আমি ইশতেহারের ওপর ভরসা করতে চাই না। বরং আওয়ামী লীগ সরকার ইশতেহারের চেয়ে বেশিই করেছে। তবে এবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা ও আন্তরিকতা নিয়ে সরকারকে মাঠে নামতে হবে। নির্বাচনে জয়ের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি মায়ের মমতায় দেশের মানুষকে আগলে রাখেন। এটা আমরা জানি। এবার আরও একবার শেখ হাসিনার দৃঢ় অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। দ্রব্যমূল্যের লাগাম যাদের হাতে থাকে বলে শুনি, সেই সিন্ডিকেটকে ভেঙে দিতে হবে চিরতরে। বাজারের নিয়ন্ত্রণে যেন সরকারের হাতেই থাকে।
আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার অনেক অর্জন ম্লান হয়ে গেছে অনেক সমালোচনায়। বিশেষ করে দুর্নীতি, অর্থপাচার, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি আমাদের অর্থনীতিকেই থমকে দিচ্ছে। শেখ হাসিনা অনেক কিছু করেছেন। এবার সময় এসেছে অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার।
কাজটা কঠিন, কিন্তু শেখ হাসিনার কাছে অসম্ভব নয়। আসলে শেখ হাসিনার কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। এর আগে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে দলের প্রভাবশালীদের গ্রেফতার করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। আবার সময় এসেছে তেমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আশা করি চতুর্থ মেয়াদের প্রথম দিকেই অপ্রিয় কাজগুলো করে ফেলবেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার ঝুলিতে আরও কত বিস্ময় লুকিয়ে আছে, সেটার জন্যই এখন জাতির অপেক্ষা।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ