প্রভাষ আমিন
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ দলের মনোনয়ন ঘোষণা করে গত ২৬ নভেম্বর। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২৯৮ আসনে দলের মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। কুষ্টিয়া-২ এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন দুটি ফাঁকা ছিল। সবাই ধরে নিয়েছিল প্রথম আসনটি জাসদের হাসানুল হক ইনু এবং পরেরটি জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমানের জন্য খালি রাখা হয়েছিল। হয়েছেও তা-ই। তবে তখনই কথা উঠেছিল, মাত্র দুটি আসন খালি রাখা হলো, তাহলে কি জোট-মহাজোটের সঙ্গে আসন সমঝোতা হবে না।
বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পর আওয়ামী লীগ এবার চেয়েছিল নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে। এমনকি দলের বিদ্রোহীদেরও স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে উৎসাহিত করা হয়, যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ে। তারচেয়ে বড় কথা, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার যাতে তেমন বদনাম না হয়, কেউ যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ। জোট-মহাজোটের সবাই আলাদা নির্বাচন করলে এই একতরফা নির্বাচনেও কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি হতে পারতো। আওয়ামী লীগ সেটাই চেয়েছিল। কিন্তু জোট-মহাজোটে থাকা দলগুলোর এমনই করুণ দশা, তারা জয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের দিকেই তাকিয়ে ছিল। এ নিয়ে দেনদরবার হয়েছে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৬টি এবং ১৪ দলের তিন শরিককে ৬টি অর্থাৎ মোট ৩২টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। এই ৩২টি আসনে আওয়ামী লীগের কোনও প্রার্থী থাকবে না। এছাড়া ২৯৮ আসনে ঘোষিত তালিকা থেকে আওয়ামী লীগের ৫ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। তার মানে মোট ৩৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকছে না। জাতীয় পার্টি নিজেদের প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচন করলেও ১৪ দলের শরিকরা নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে লড়বেন।
প্রাথমিকভাবে যে ২৯৮ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল তারা সবাই কিন্তু মনে মনে এমপি হয়ে গিয়েছিলেন। বিএনপি যেহেতু নেই, তাই সবাই ধরে নিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নিশ্চিত এমপি হয়ে যাওয়া। ২৬ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও তারা অনানুষ্ঠানিক প্রচারণা চালিয়েছেন। এলাকার নেতাকর্মী ও মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিনে এসে এদের মধ্যে ৩২ জন জানলেন, তাদের নির্বাচন করা হচ্ছে না। তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হবে। এমপি হওয়ার স্বপ্ন তাদের ছিল মাত্র ২২ দিন। হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন। দেখলেন, তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল।
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী। এর আগে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ফরিদুন্নাহার লাইলী দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক একটা আবেগ জড়িত। আমার স্ত্রী মুক্তি শিকদারের বড় বোন জলি কবিরও রাজনীতি করতেন। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন। মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন। ২০০৬ সালের ২৪ জুলাই নোয়াখালী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। দাউদকান্দিতে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে তাদের গাড়ি। তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হেরে যান তিনি। সেই গাড়িতে ছিলেন ফরিদুন্নাহার লাইলীও। বোনের শেষযাত্রার সঙ্গী বলে লাইলী আপার প্রতি মুক্তি ও তাদের পরিবারের আলাদা একটা টান আছে। এবার লাইলী আপার মনোনয়নের খবরে মুক্তি খুবই খুশি হয়েছিল, যেন তার বোন মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু ১৭ ডিসেম্বর রাতে যখন মুক্তিকে বললাম, লাইলী আপার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে, তখন তার মন খারাপ হয়ে যায়। মুক্তিরই এত মন খারাপ; আর যাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছে, তাদের না জানি কেমন লেগেছে। মুক্তিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম, লাইলী আপা একা নন, এমন আরও ৩১ জনকে দলের সিদ্ধান্তে নির্বাচন থেকে সরে আসতে হয়েছে। মুক্তি বললো, এ তো বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় রিটেনে পাস করে ভাইভায় ফেল করার মতো।
যে ৩২ জন মনোনয়ন পেয়েও হারিয়েছেন, তাদের দুঃখ তো আছেই। তবে দুজনের দুঃখটা আরও বেশি। পটুয়াখালী-১ আসনের সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহজাহান আলম শাজু। দুজনই মাস দেড়েক আগে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে তারা সংসদের কোনও অধিবেশনে বসার সুযোগ পাননি। তাদের নির্বাচিত হওয়ার আগেই একাদশ সংসদের অধিবেশন শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবারও দুজন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দুটি আসনই জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে কপাল পুড়েছে এই দুই সংসদ সদস্যের।
মনোনয়ন পেয়ে কয়েক দিন সুখস্বপ্নে বিভোর থেকে যাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছে, দল নিশ্চয়ই তাদের মূল্যায়ন করবে। কিন্তু ২০/২২ দিন মাঠে থেকে উঠে আসার যে অপমান, তা নিশ্চয়ই পোড়াবে তাদেরও। দলের জন্য যত ভালোবাসাই থাকুক, তারাও তো মানুষ। রাজনীতি আসলেই বড় নিষ্ঠুর।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ