আমরা চাই, যারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধ করেছেন, তারা যে দলেরই হোক না কেন, মর্যাদা পাক ॥ একটা সময় ছিল, যখন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া কঠিন ছিল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলিয়ে ফেলার চেষ্টা চলেছে, আমরা এসে তাদের মর্যাদা দিয়েছি ॥ বীর মুক্তিযোদ্ধারা মানবেতর জীবনযাপন করবে, রিকশা চালাবে, আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায় থাকতে সেটা হবে না ॥ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হবে, আমরা এটাই চাই ॥ বাংলাদেশের ওপর আর যেন কারো কালো থাবা না পড়ে, সেদিকে সবার সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে
মিথুন আশরাফ – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭১ সালে যারা জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করেছে, বিজয় এনেছে, তাদের সম্মান দেখানো আমাদের কর্তব্য। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোকে আওয়ামী লীগ কর্তব্য মনে করে। দলমত নির্বিশেষে সব মুক্তিযোদ্ধাকে আওয়ামী লীগ সম্মান দিয়েছে। বুধবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘বীর নিবাস’ প্রকল্পের আওতায় পাঁচ হাজার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিজস্ব জমিতে একতলা বাড়ির চাবি হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা জাতির জন্য লজ্জার। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারপ্রধান বলেন, একটা সময় ছিল, যখন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া কঠিন ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলিয়ে ফেলার চেষ্টা চলেছে। আমরা এসে তাদের মর্যাদা দিয়েছি। আমরা চাই, যারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধ করেছেন, তারা যে দলেরই হোক না কেন, মর্যাদা পাক।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে উঠবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হবে, আমরা এটাই চাই। বাংলাদেশের ওপর আর যেন কারো কালো থাবা না পড়ে, সেদিকে সবার সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, গত ১৪ বছরের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। আমরা এরইমধ্যে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছি। রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন করেছি। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মর্যাদা পেয়েছি। ৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ব।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধারা মানবেতর জীবনযাপন করবে, রিকশা চালাবে, আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায় থাকতে সেটা হবে না। আমরা অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘর করে দিচ্ছি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে তাদের কাছে ভাতা পৌঁছে দিচ্ছি। আমরা চাই, বেঁচে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পরিবার যেন মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারেন। এর আগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঁচ হাজার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বীর নিবাসের চাবি হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধক্রমে তার পক্ষে প্রথমে নড়াইলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুস সবুরের হাতে বীর নিবাসের চাবি হস্তান্তর করেন জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান।
যেসব জেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি হস্তান্তর করা হচ্ছে তার মধ্যে ঢাকায় ৫৭, গাজীপুরে ৩৮, মানিকগঞ্জে ৫১, নরসিংদীতে ৩৯, নারায়ণগঞ্জে ৩২, মুন্সীগঞ্জে ৬, টাঙ্গাইলে ২০২, কিশোরগঞ্জে ১০৪, ফরিদপুরে ১২০, গোপালগঞ্জে ৫১, রাজবাড়ীতে ৫৮, শরীয়তপুরে ১২৫, মাদারীপুরে ৪৫, চট্টগ্রামে ৭৮, কক্সবাজারে ১৭, রাঙামাটিতে ৩, খাগড়াছড়িতে ৪৫, বান্দরবানে ৮, কুমিল্লায় ১৮৬, চাঁদপুরে ৮১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৩০, নোয়াখালীতে ৬৪, ফেনীতে ৮১, লক্ষ্মীপুরে ৩৬, বরিশালে ৬৭, ভোলায় ৯৮, পিরোজপুরে ৮১, পটুয়াখালীতে ৪২, বরগুনায় ৩৯, ঝালকাঠিতে ৩০, খুলনায় ৮৮, বাগেরহাটে ২৭৫, সাতক্ষীরায় ১০১, যশোরে ৭৫, মাগুরায় ৩৫, ঝিনাইদহে ১৩৩, নড়াইলে ৭৭, কুষ্টিয়ায় ১৭৯, চুয়াডাঙ্গায় ৯১, মেহেরপুরে ৪৬, রাজশাহীতে ৭২, নওগাঁয় ৮০, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪১, নাটোরে ৪৩, বগুড়ায় ৬৯, জয়পুরহাটে ৫২, পাবনায় ৯৯, সিরাজগঞ্জে ৭১, দিনাজপুরে ৯৮, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩৮, পঞ্চগড়ে ৫৯, নীলফামারীতে ২২, রংপুরে ৬৫, গাইবান্ধায় ৯৩, লালমনিরহাটে ৩৬, কুড়িগ্রামে ৪১, ময়মনসিংহে ১৯১, নেত্রকোনায় ১২৬, জামালপুরে ৯৮, শেরপুরে ১০৬, সিলেটে ১৯, মৌলভীবাজারে ৫৯, হবিগঞ্জে ৫০ ও সুনামগঞ্জে ১৪৮টি বাড়ি রয়েছে।
জানা যায়, মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালে সারাদেশে ৩০ হাজার বীর নিবাস নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করে সরকার। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। এ পর্যায়ে পাঁচ হাজার বাড়ি নির্মাণ শেষে হস্তান্তর করা হচ্ছে। বাড়িতে দুই বেডরুম, একটি ড্রইং ও একটি ডাইনিং, দুটি বাথরুম এবং একটি বারান্দা রয়েছে। চার শতাংশ জমিতে ৭৩২ বর্গফুট আয়তনের এক-একটি বাড়ির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ১০ হাজার ৩৮২টাকা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করেছি, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করেছি, তাদের জন্য বৈশাখী ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেলে যেন সম্মান পান, সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি। জাতির পিতা যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, নির্যাতিত মা-বোনদের জন্য কোটা সিস্টেম চালু করেছিলেন, আমরা সরকারে আসার পর শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, তাদের সন্তান ও বংশপরম্পরায় যারা আসবে, তারাও যেন প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রায়, সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি, সেটা মানুষ ভুলে গিয়েছিল। কারণ ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর ইনডেমনিটি জারি করে হত্যাকারীদের বিচার থেকে রেহাই দিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। অন্যদিকে যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছিল, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা ছিল, তাদের ক্ষমতায় বসায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সেই তারাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা হয়ে ক্ষমতায় বসেন। আর মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে পড়েন কোণঠাসা। এমনকি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হলে তাদের দেওয়া হতো না। এই ধরনের দুর্ভাগ্য চলে ২১ বছর পর্যন্ত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ আর থামাতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আমরা গড়ে তুলবো। সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
২০২১ সালের ১৬ মার্চ সরকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ ও প্রয়াত যুদ্ধ বীরদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ৩০ হাজার বাড়ি নির্মাণের জন্য ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, শহীদ ও প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের বিধবা ও সন্তানদের জন্য ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস’ নির্মাণ করা। এই প্রকল্পটি আর্থিকভাবে প্রান্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের বিধবা ও সন্তানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে নড়াইল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসকরা নিজ নিজ এলাকায় চাবি হস্তান্তর করেন।