পথে প্রান্তরে ডেস্ক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ১৫ আগস্ট ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গণে আলোচনা বেশ কয়েকদিন থেকেই। আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে যাত্রার কর্মসূচির পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচিতে জনমনে শঙ্কা ভর করেছে। সকলের মনে প্রশ্ন কী হতে যাচ্ছে ১৫ আগস্ট।
এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে: বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে একত্রিত হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, দলটি যেন কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
দু’পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে দেশে আবারও সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এমন একটি সময় এসব ঘটনা ঘটছে, যখন নিজেদের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে হামলার শিকার হয়ে রীতিমত বিপর্যস্ত পুলিশ বাহিনী। ফলে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হলে সেটি মোকাবেলা করা বর্তমান সরকারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জনবিস্ফোরণের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ ঘটনার পর টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটির বেশিরভাগ নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দলটি। গত এক সপ্তাহে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের মতো হাতে গোটা কয়েকটি এলাকার বাইরে দলটির তেমন কোনো সক্রিয় কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি।
কিন্তু সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আবারও নেতাকর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তিনি ইতোমধ্যেই তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের একজন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবার আগে তিনি জানিয়ে ছিলেন: গতকাল (সোমবার) আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। যদিও ঠিক কী নিয়ে কথা হয়েছে, সেটি জানাতে রাজি ছিলেন না তিনি।
দলটির একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে: শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালনকে উপলক্ষ্য করে আবারও নিজের অস্বিত্ব জানান দিতে চায় আওয়ামী লীগ। ওইদিন ঢাকার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে কর্মসূচি পালনের নিরাপত্তা চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।
কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মী-সমর্থকদের ঢাকায় আসতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন দলটির একাধিক নেতা।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এক ভিডিওবার্তায় শোক দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রোববার নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে তিনি বলেন: ১৫ই অগাস্ট আমার আহবান আপনাদের প্রতি, শান্তিপূর্ণভাবে ৩২ নম্বরে গিয়ে ফুল দিয়ে আসবেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য, স্বাধীনতার চেতনার জন্য এবং আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।
আওয়ামী লীগের এমন রাজনৈতিক তৎপরতা রুখে দেয়া ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে: ১৫ই অগাস্টে আওয়ামী লীগ ঢাকায় কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিলেও সেটি সফল হতে দেওয়া হবে না।
এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন: গত ১৬ বছর ধরে শাসনের নামে তারা যেভাবে মানুষের হত্যা, নির্যাতন ও গুম করেছে, যত রক্ত তাদের হাতে লেগে আছে, সেগুলোর বিচার না হওয়া পর্যন্ত এদেশের ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগকে রাজনীতির মাঠে দেখতে চায় না।
কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এখনও বেশ বড় এবং নিষিদ্ধ কোনো সংগঠনও নয়। তাহলে তাদেরকে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: কারণ সুযোগ পেলেই তারা আবারও রক্তপাত ঘটাবে, মানুষের জীবন যাবে।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে অবৈধ আগ্নেয়ান্ত্র রয়েছে দাবি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ নেতা বলেন: আন্দোলন চলাকালে তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি ছুঁড়েছে, সেটা সবারই জানা। এরপর থানা থেকেও ওরা অস্ত্র লুট করেছে। এ অবস্থায় তাদেরকে আবারও রাজপথে নামার সুযোগ দিলে আবারও এদেশের মানুষের রক্ত ঝরবে, প্রাণ যাবে। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না।
রাজপথে নামতে না পেরে প্রশাসনের অনুগত কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও দাবি করেন হাসনাত। বলেন: সম্প্রতি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে ক্যু করার চেষ্টা আমরা প্রতিহত করেছি। একইভাবে, আরও নানান ষড়যন্ত্র চলছে, যা আমরা কোনোভাবেই সফল হতে দেব না। এর কারণে যদি আমাদেরকে মাসের পর মাসও রাজপথে থাকতে হয়, আমরা থাকবো। তারপরও ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে আমরা ব্যর্থ হতে দেবো না।
আওয়ামী লীগকে রুখে দিতে রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিও। তবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবেন বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম বলেন: আমাদের নেতাকর্মীরা সব জায়গাতেই মাঠে আছেন। দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের নিরাপত্তায় কাজ করছেন।
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেছেন: কোনো দিবসকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের কেউ দেশে কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম বা কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে, তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে।
তিনি আরও বলেন: স্বৈরাচারী হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিদেশে পালিয়ে থাকা তার দুর্নীতিবাজ ছেলে বিদেশে বসে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে। তারা ষড়যন্ত্র করছে দেশে কোনোভাবে নৈরাজ্য, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো যায় কি না। বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্র করছে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা। আর দেশে থাকা স্বৈরাচারের দোসররা তাদের সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। তবে আমরা তাদের শক্ত হাতে রুখে দিব।
কর্মসূচি পালনের নামে মানুষের উপর হামলা হলে বিএনপি সাধারণ নাগরিকদের পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে জানান বিএনপি নেতারা।
এদিকে কর্মসূচি পালনের জন্য নিরাপত্তা চেয়ে আওয়ামী লীগের পাঠানো চিঠির ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ডিএমপি’র মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন।
তিনি জানান: চিঠির (আওয়ামী লীগ থেকে অনুমতি চেয়ে) বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। হেড কোয়ার্টার থেকেও আমাকে কিছু জানানো হয়নি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনও একই কথা জানিয়ে বলেছেন: এমন কোনো আবেদন তো পাওয়া যায়নি।
হুশিয়ারী দিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন: লোক জড়ো করুন, আর যাই করুন; এমন কিছু করবেন না যাতে আপনাদের জীবন বিপন্ন হয়।
তবে আওয়ামী লীগ যদি কর্মসূচি পালন করতেও চায়, তারপরও ঘটনা যেন কোনোভাবেই সহিংসতায় না গড়ায় সেটি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরিন বলেছেন: দু’পক্ষ ঘোষণা দিয়ে যেভাবে মাঠে থাকার কথা বলছে, সেটি থামানো না গেলে আবারও সহিংসতা ও প্রাণহানি হতে পারে। কাজেই সরকারকে এখনই উদ্যোগী হয়ে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে হবে। দু’পক্ষের সঙ্গেই কথা বলতে হবে, থামাতে হবে।
অন্যদিকে, পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ পর্যায়ে পৌঁছাবে না বলে মত দিচ্ছেন কেউ কেউ। গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন: জনরোষের মুখে যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, তাতে এখনই তারা রাজপথে কর্মসূচি পালন করবে বলে আমার মনে হয় না। তবে পরিস্থিতি যদি সত্যিই খারাপের দিকে যায়, তাহলে সরকারের জন্য সেটি মোকাবেলা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে।