Search
Close this search box.

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের আশ্রয়দাতা দেশগুলোর উচিত দুঃখ প্রকাশ করা

 

 

 

 

রেজা সেলিম

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে যেসব বিপথে যাওয়া সেনা কর্মকর্তা নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করেছিল তারা সে বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশেই ছিল। তাদের ধারণা ছিল যা ঘটেছে ও তারা যা ঘটিয়েছে এর বিরুদ্ধে যেহেতু কোন সংগঠিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠেনি ফলে তারা হয়তো নিরাপদ। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, এদের অনেকেই চিন্তিত ছিল কোন অঘটন ঘটার আশঙ্কায় ও সে কারণে পরিবার পরিজন নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিতে ব্যস্ত ছিল ও চেষ্টা করছিল যাতে মোশতাক সরকার সেরকম একটি ব্যবস্থা নেয়। এসবের ফলেই খোন্দকার মোশতাক তাদের, নিজের ও ষড়যন্ত্রকারীদের রক্ষায় সুদুরপ্রসারী চিন্তা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমেই শাস্তি এড়াবার নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য “ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ” আইন প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তখনকার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে। এসবের জন্যে তখনকার সরকারের উপর হত্যাকারী দল ও পরিকল্পনাকারীদের নিশ্চয়ই চাপ ছিল যদিও এ অধ্যাদেশ জারী করে তাদের উদ্বেগ নিরসনে ৪০দিনের মতো সময়ও লেগেছিল। কী সেই চাপ ও সরকারী নথিপত্রে নেপথ্য পরিকল্পনার ও সেই মতে এগিয়ে যাবার যা যা প্রমাণ বা দলিলাদি আছে এই নিয়ে প্রাইমারি গবেষণা হওয়া দরকার। আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে সেগুলোর অধিকাংশই সেকেন্ডারি বা নানাজনের সাক্ষাৎকার ও লেখালেখি সূত্রে পাওয়া। এভিডেন্সগুলো এখন প্রকাশ্য হওয়া দরকার।

‘৭৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পট পরিবর্তনের শেষের পর্যায়ে সকল নেপথ্য ঘটনার অনুঘটক সুযোগসন্ধানী জেনারেল জিয়াউর রহমান সাজানো নাটকীয় পরিস্থিতির মাধ্যমে সামরিক ক্ষমতার সামনে বা দৃশ্যপটে চলে আসেন। এতোদিন তিনি নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন তা নানা সূত্রে প্রমাণিত। রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক এই সময়ে অপসারিত হন ও তখনকার প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম মোশতাকের স্থলাভিষিক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বছর চারেকের বড়ো, প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্র ও ত্রিশের দশকে কোলকাতা বারে নবীন আইনজীবী হিসেবে সুপরিচিত, পরবর্তিকালে ঢাকা হাইকোর্টে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের সহায়ক আইনজীবী, পূর্ব পাকিস্তান আইনজীবী পরিষদের নেতা হিসেবে বিশেষ পরিচিত এই সায়েমকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হাইকোর্টে দেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ‘৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু দেশে সুপ্রীম কোর্ট গঠন করেন ও সেদিন থেকে বিচারপতি সায়েম দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ও ৬ নভেম্বর এর সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পর মূলতঃ ৬ নভেম্বরই বিচারপতি সায়েমকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি সংসদ ও মন্ত্রী পরিষদ ভেঙে দিয়ে সারা দেশে সামরিক আইন জারী করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন এবং সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে সামরিক শাসনের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন ফলে সঙ্গত কারণেই ‘৭৫ সালের নভেম্বর থেকে ‘৭৭ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সকল ঘটনাবলির দায় তাকে নিতে হবে। এই পুরো সময়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান বিচারপতি সায়েমকে সামনে রেখেই তার সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন এ নিয়েও কোন সংশয় নেই। তখনকার অস্থির পরিস্থিতিতে হত্যাকারী দলের সদস্যগণ ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বিদেশে চলে যেতে চাইছিলেন বা কেউ কেউ লিখেছেন তাদের সাথে সেরকম প্রতিশ্রুতি দেয়া ছিল। কে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কখন বা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের কোন পর্যায়ে এসে তা দেয়া হয়েছিল তার আনুপুঙ্খ আমাদের জানা দরকার। ফলে তথ্য অনুসন্ধানের কাজ ও তা উন্মোচনের-প্রকাশের কাজ এখানেও চালাতে হবে। এসব সত্য আড়ালে থেকে যাবার কোনই কারণ নেই।

’৭৫ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আত্মস্বীকৃত ও চিহ্নিত হত্যাকারীদের একটি দলের বিদেশ যাবার সব বন্দোবস্ত করা হয়। বিশেষ বিমানে তারা প্রথমে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড হয়ে লিবিয়ায় যায় ও ’৭৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত লিবিয়ায় অবস্থান করে। বিভিন্ন সূত্রে এখন জানা যাচ্ছে, ’৭৬ সালের ৮ জুন তারিখে জিয়াউর রহমানের অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর মধ্যস্ততায় এদের ১২জনকে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরীর বন্দোবস্ত করা হয় ও সে অনুযায়ী নিয়োগপত্র পেয়ে এদের সকলেই কাজে যোগ দেয়। হত্যাকারীদের মধ্যে দুইজন শীর্ষস্থানীয় সদস্য কর্ণেল ফারুক ও কর্ণেল রশীদ চাকুরী না নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। সে সময়ে যে ১২জন হত্যাকারীদের চাকুরী বন্দোবস্ত করা হয় এরা হলো- লে. কর্নেল আজিজ পাশা আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব হিসেবে, লে. কর্নেল শরিফুল হক (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর শাহরিয়ার রশিদ ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর বজলুল হুদা পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরী ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরী সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেন কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেন কানাডায় তৃতীয় সচিব, লে. খায়রুজ্জামান মিসরে তৃতীয় সচিব ও লে. আবদুল মাজেদ সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল।

প্রশ্ন হলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শিশুর এই মধ্যস্থ তৎপরতার নেপথ্য ঘটনাগুলো কি? আমরা জনি বিদেশের দূতাবাসে কোন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হলে সে দেশের অগ্রিম অনুমতি বা সম্মতি নিতে হয়। কূটনীতির এই শিষ্ঠাচার এই ক্ষেত্রে কেমন করে অনুসরণ করা হয়েছিল? কে করেছিলেন, কীভাবে করেছিলেন? বঙ্গবন্ধু তখন পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় ও অবিসংবাদিত জনপ্রিয় নেতা। যেসব দেশে হত্যাকারীদের চাকুরী দেয়া হলো সেসব দেশ কেনই বা তাদের গ্রহণ করতে সম্মতি দিল? যুক্তি বা তর্কের খাতিরে আমরা মধ্যপ্রাচ্য বা পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলোর এই সম্মতি দেয়া যদি মেনেও নেই তাহলেও অন্তত কয়েকটি দেশের ভূমিকা আজও রহস্যজনক বা আমাদের অজানা, যেমন আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, কানাডা ও সেনেগাল। বিশেষ করে আলজেরিয়ায় তখন জোট নিরেপক্ষ দেশগুলোর আন্দোলনের অন্যতম নেতা হুয়েরই বুমেদিন বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন ও ৭৩ সালের সেপ্টেম্বরের ৩-৯ তারিখে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ন্যামের চতুর্থ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বুমেদিনের বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেন। এই সময়ে তিনি বিশ্বের নামিদামি নেতাদের সাথে মত বিনিময় করেন ও জোট নিরেপক্ষ আন্দোলনে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেন। এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাথে ফিডেল ক্যাস্ট্রো, মার্শাল টিটো, আনোয়ার সাদাত, গাদ্দাফী-সহ অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হয় ও বাংলাদেশের এই নেতার অবস্থান বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়।

প্রশ্ন হলো আলজেরিয়া কেমন করে সে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর একজন প্রত্যক্ষ হত্যাকারীকে তার দেশের দূতাবাসে চাকুরী করতে সম্মতি দিল? পশ্চিমের ধনী দেশ ও কমনওয়েলথ সদস্য কানাডাই বা কী করে অপর একজন হত্যাকারীকে চাকুরী করতে সম্মতি দেয় বা সেনেগালের মতো স্বল্পোন্নত দেশ যার সাথে বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শনের তেমন কোন অমিল ছিল না। তাহলে আরও প্রশ্ন হয়, এইসব সম্মতিদানের নেপথ্য ঘটনা কি? আমাদের জানা দরকার আমরা সেসব দেশের সাথে কোন কূটনৈতিক আলোচনা করেছিলাম কিনা যাতে সেসব দেশের পরিচয় হত্যাকারীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে না হয়? যদি এসব সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর মতো উচ্চমানের সম্মানিত ব্যাক্তিত্বের নির্মম হত্যাকান্ডের তাৎপর্য বা গুরুত্ব বিবেচনা না করেই ওই দেশগুলো নিয়ে থাকে আমরা নিশ্চয়ই সেসব দেশগুলোকে এখন দুঃখ প্রকাশ করতে আহ্বান জানাতে পারি। কোন কোন দেশের এখন বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইবারও যথেষ্ট কারণ আছে কারণ তারা ইতিহাসের এক কলঙ্কিত সন্ত্রাস সংঘটনকারীদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে ও একটি দেশের জাতির পিতা হত্যাকারীদের আশ্রয় দিয়েছে বলে এ দেশের জনগণের কাছে ধিকৃত হয়ে আছে।

শুধু তা-ই নয়, আমাদের জানা দরকার জিয়া ও এরশাদের আমলে এইসব ঘৃণ্য অপরাধীরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেমন করে বছরের পর বছর চাকুরী অব্যাহত রেখেছে, এমনকি পদোন্নতিও পেয়েছে? শুধু তা-ই নয় প্রথমে এদের চাকুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটেশনে দেয়া হলেও ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে এদের সবাইকে ফরেন সার্ভিসের ক্যাডারভুক্ত করা হয় যা আমাদের বৈদেশিক দপ্তরের জন্যে অত্যন্ত বিব্রতকর ও লজ্জার বিষয়!

প্রশ্ন হলো- আমাদের বন্ধুপ্রতীম অনেক দেশ তাদের গ্রহণ করেছে? কেন করেছে? আলজেরিয়া কীভাবে করে? পদোন্নতি পেয়ে রাশেদ চৌধুরী একসময় জাপানে বদলী হয়, বন্ধু ও শান্তিপ্রিয় দেশ জাপান কেন তাকে গ্রহণ করলো? ডালিম-কে বেইজিং থেকে পোল্যান্ড বদলী করা হলে একমাত্র প্যোলান্ড-ই তাকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, পরে তাকে কেনিয়ায় হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এ কাজ কেমন করে সম্ভব হয়েছিল? মেজর নূর ব্রাজিলে চার্জ-দ্য-অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। আর বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি পেয়ে বদলী হলে দু-একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া অন্যান্য সব দেশই এদের মেনে নিয়েছিল। তাহলে এসবের পেছনে কি কোন বড় শক্তির সমর্থন ও ইঙ্গিত ছিল? বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার রহস্য উন্মোচনে ওইসব দেশের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা থাকতে হবে ও উত্তর পেতে হবে। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো একটি প্রফেশনাল বিভাগেরও নৈতিক মান অক্ষুন্ন রাখতে ও দায়মুক্ত রাখতে এসবের উত্তর জানা আমাদের দরকার।

আর ওইসব দেশগুলো সব জেনেশুনে, এমনকি অপরাধের বিচার করা যাবে না এমন আইনের অধীনে থাকা হত্যাকারী অপরাধীদের কেমন করে কূটনৈতিক মর্যাদা দিয়ে তাদের দেশে কাজ করতে দিয়েছে? যদি আইন করেই অপরাধের বিচার করা যাবে না তাহলে তো তারা সেই অপরাধ করেছিল প্রমাণিতই হয়, যা বিশ্ব ইতিহাসের জন্যে এক বিশাল কলঙ্কের বোঝা হয়েছিল, সেসব দেশ কেন এই অপরাধীদের অপরাধ আমলে নেয়নি, আজকের বিশ্বে এর ঐতিহাসিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষণ বের করে আনা জরুরী।

লেখক – রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ