স্বদেশ রায়
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ইতিহাসবিদ। হাজার বছরের ইতিহাসের বিচারেই নিশ্চয়ই তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের অবস্থান দেখেন। তাঁর সে বিচার থেকেই লিখেছেন, রাষ্ট্রের হাত থেকে সমাজ ছিনতাই হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে কারা এই সমাজ ছিনতাই করেছে? মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, তারা রাষ্ট্রের প্রশাসনের ভেতর ও রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দলের রাজনৈতিক শক্তির একটি অংশ। এখানে তিনি প্রবীণ সাংবাদিক, নাট্যজন ও সর্বোপরি সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। রামেন্দু মজুমদার বলেছেন, রাজনীতির থেকে সংস্কৃতির সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই এমনটি ঘটছে।
বাস্তবে সমাজের যা অবস্থা হয়েছে তা প্রত্যেকেই দেখতে পাচ্ছেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতি দেখতে পেয়েও হয় নিশ্চুপ থাকছে- না হয় মনে করছে নিশ্চুপ থাকা ভালো। তা যদি না হয়, তাহলে তারা অসহায়। হয়তো তাদের অসহায়ত্ব তাঁরা ক্ষমতার কারণে বুঝতে পারছেন না।
বাস্তবে আমরা যারা রাজনীতির কাছে, রাষ্ট্রের কাছে সমাজের এই অধোগতি ঠেকানোর বিষয়টি আশা করি। মনে করি রাষ্ট্র বা রাজনীতি এটা করে দেবে। আমরাও অসহায়। কারণ আমরা যার যার অবস্থানে থেকে কেউ কোন কাজ সঠিক ও স্বতস্ফূর্তভাবে করতে পারছি না। এই না পারার মূল কারণ রাজনীতি বা পলিটিক্সের প্রমত্ত রূপ। রাজনীতি যখন কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রমত্ত রূপ ধারণ করে তখন রাজনীতির মূল শরীরের থেকে তাকে আরও বেশি বড় মনে হয়। তারা নিজেরাও নিজেদের শরীর চিনতে পারে না। তখন স্বভাবতই রাজনৈতিক শক্তি মনে করে তারা রাজনীতি দিয়ে সব কিছু উদ্ধার করে ফেলবেন।
বাস্তবে রাজনীতি দিয়ে সমাজকে উদ্ধার করা যায় না। সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সব থেকে বড় প্রয়োজন সমাজের ভেতর থাকা সভ্যতার সব ধারা থেকে গ্রহণ ও বর্জনের মাধ্যমে আধুনিকতার বিকাশ ঘটানো। সমাজে আত্মজিজ্ঞাসা বাড়ানো। সমাজ যখন শুধু রাজনীতি দিয়ে ও রাজনীতির স্বার্থে পরিচালনার চেষ্টা হয়- সমাজে রাজনীতির কথাই শেষ কথা হয়- সে সময়ে ওই সমাজে কোনো আত্মজিজ্ঞাসা জাগার বা সৃষ্টি হওয়ার পথ থাকে না।
সমাজের এই আত্মজিজ্ঞাসার পথ বন্ধ হয়ে গেলেই মানসিক জড়তার আধিপত্য ঘটে। সমাজের মনন প্রক্রিয়া আর চলনশীল বা গতিশীল থাকে না, তা স্তব্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ সব সমাজেই যে একটি চলমান অন্তঃসলিলার মতো রেনেসাঁর ধারা বা মনোজগতের উন্নতির ধারা প্রবাহমান থাকে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তখন সমাজ স্বাভাবিকভাবে যে কোন অন্ধত্বকে আঁকড়ে ধরে বা আগাছার মতো ওই অন্ধত্বকেই ফুলের বাগান দখল করে নেওয়ার সুযোগ দিতে বাধ্য হয়।
রাজনীতি প্রমত্ত হলে, রাজনীতির ভেতর সব কিছু গ্রাস করার একটা ইচ্ছে থাকলে ওই রাজনীতি বুঝতে পারে না সমাজ স্তব্ধ হয়ে গেছে। সেখানে আগাছা ফুলের বাগান দখল করে নিয়েছে। বাস্তবে ওই সমাজ হয়ে গেছে একটা বদ্ধ জলাশয়। সেখানে যা কিছু ঘটছে তা কেবল বদ্ধ জলাশয়ের দুর্গন্ধ মাত্র। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন যে কলেজের প্রিন্সিপালের গলায় সমাজের মানুষ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন মিলে জুতোর মালা পরানোর কথা উল্লেখ করেছেন- তা মূলত ওই বদ্ধ জলাশয়ের দুর্গন্ধ মাত্র। জলাশয় বদ্ধ হলে এমন দুর্গন্ধ সেখান থেকে প্রতিনিয়ত ছড়াবেই।
রাষ্ট্র ও রাজনীতি বেশিক্ষেত্রে মনে করে আইন দিয়ে, সংবিধান দিয়ে তারা এই সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু আইন দিয়ে অন্ধত্ব বা সমাজের জলাশয়ের বদ্ধতাকে দূর করা যায় না। কোনো আইন, সংবিধান এটা পারে না। এর জন্য সমাজকে স্বাধীনভাবে বিকাশ হওয়ার সুযোগ দিতে হয়। কিন্তু যখন কোনো রাষ্ট্রের শিক্ষা, চিন্তা, মতপ্রকাশ, কাজের সুযোগ সবই রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন ওই সমাজ আর স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠে না। সেখানে সংস্কৃতির কোনো অঙ্গেরই বিকাশ ঘটে না।
তাই সমাজের ক্ষেত্রে, ব্যক্তির জীবনে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে রাজনীতির আধিপত্য’র এমনকি রাষ্ট্রের আধিপত্য’র একটা সীমারেখা থাকা উচিত। রাজনীতির প্রমত্ততা এই সীমারেখা না রেখে সবটুকু নিজে করার এক সর্বগ্রাসী মনোবৃত্তি থেকে সমাজের সাংস্কৃতিক দিক ও বুদ্ধিবৃত্তির দিকও গ্রাস করে ফেলেছে। সমাজে স্বাধীন চিন্তা বিকশিত হওয়ার বদলে রাজনীতির ক্ষমতার স্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তাই এখন বুদ্ধিবৃত্তি ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি এখন রাজনীতিবিদের হাতের বাজারের থলের বস্তু হয়ে গেছে। তার নিজস্ব কোনো স্থান নেই।
আর বুদ্ধিবৃত্তি যখন রাজনীতিবিদের বাজারের থলেতে ঢুকে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই সমাজে অন্ধত্ব ও লোভের দাপট বাড়ে। তাকে বাধা দেওয়ার প্রকৃত কোনো শক্তি বাইরে থাকে না। আর সে সময়ে ওই লোভ অবাধে রাষ্ট্রের সম্পদও খেয়ে ফেলতে চায়। আর এ অবস্থায় শুধু রাষ্ট্রের হাত থেকে নয় বুদ্ধিবৃত্তির হাত থেকেও সমাজ ছিনতাই হয়ে যায়।
এই ছিনতাই হয়ে যাওয়া সমাজ কোনো এক ব্যক্তি বা শুধু রাজনৈতিক শক্তি রক্ষা করতে পারে না। এর জন্যে দরকার হয় সমাজে একটি পরিপূর্ণ না হলেও বড় ধরনের চিন্তার বিকাশ- যা অনেকখানি রেনেসাঁর মতো। যেমনটি এই ভূখণ্ডে ৫০ ও ৬০ এর দশকে স্বাধীন সংস্কৃতিজনের হাত ধরে ঘটেছিল। যাদের চিন্তা ও কাজ রাজনীতিকে প্রগতিশীল করেছিল।
ষাটের দশক থেকে এখন সমাজে অন্ধত্ব অনেক বেশি। আবার স্বাধীন সংস্কৃতিজনের সংখ্যা নিতান্তই মাইক্রোস্কোপিক। এ অবস্থায় দেশ ও জাতির ভরসা থাকে একমাত্র নতুন প্রজম্ম থেকে আত্মজিজ্ঞাসা সম্পন্ন তরুণ তরুণীদের বেরিয়ে আসা। যারা বদ্ধ জলাশয়ের বাঁধ কেটে দিয়ে সেখানে সব ধরনের পানি ঢোকানোর কাজে নেমে পড়বেন। বাস্তবে এ কাজ একটি রাষ্ট্র ও সমাজে সব থেকে কঠিন কাজ। কারণ এ কাজ অর্থ ব্যয়ে বা বরাদ্দে সম্পন্ন হয় না। মননের জিজ্ঞাসা ও বিকাশ ঘটিয়েই করতে হয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত।