মনজুরুল আহসান বুলবুল
সংকটে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এই বোধ আছে বলেই মানুষকে অন্য জীবের চেয়ে আলাদা করা হয়। অতীত সাক্ষ্য দেয় এই বাংলা উজ্জ্বল হয়েছে এরকম বহু ব্যক্তি মানুষের স্পর্শে। অনেক ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে। স্বামী বিবেকানন্দ যতটা না একক ধর্মীয় পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত, তার চেয়েও বেশি স্মরণীয় এবং বরণীয় মানবিকতায় পূর্ণ সকল ধর্মের এক দার্শনিক হিসেবে। সম্মানিত আনন্দ মোহন বসু [আনন্দ মোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা] , মুরারী চাঁদ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা গিরীশ চন্দ্র রায়, ব্রজ লাল চ্যাটার্জি [বি. এল. কলেজের প্রতিষ্ঠাতা] তাদের সময়কার দাপুটে মানুষ ছিলেন সন্দেহ নাই। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক দাপট সময়ের বালিতে চাপা পড়ে গেছে, কিন্তু অক্ষয় হয়ে আছে তাদের ব্যক্তিগত অবদানের কীর্তি। একেবারে কাছাকাছি সময়ে দেখি রণদা প্রসাদ সাহার মতো মানুষ, প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছেন শুধু তার মানবিক কীর্তির কারণে। তিনি ভারতেশ্বরী বা কুমুদিনীর চেয়েও অনেক উচ্চাসনে।
জীবন সায়াহ্নে এসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন ‘… আমি চাই ত্যাগের ভিক্ষা, তা’ যদি না দিতে পারেন তবে জীবন ব্যর্থ হবে, দেশ সার্থকতা লাভ করতে পারবে না …’ [ ৪ ফাল্গুন, ১৩৩২ বাংলা, ময়মনসিংহে দেওয়া অভিভাষণ]। আজ এই ‘ত্যাগের ভিক্ষা’ দেওয়ার সময় এসেছে, দেশকে, দেশের মানুষকে। একজন পদাধিকারী তার পদকে ব্যবহার করে, একজন প্রতিষ্ঠান অধিকর্তা প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ নিয়ে এই ‘ত্যাগ ভিক্ষা’য় নাম লেখাতেই পারেন। সেটিই বা কম কিসে? করোনা আক্রান্ত এই সময়ে এ রকম ত্যাগের মেলা অঙ্ক দেখছি। কিন্তু এই ত্যাগ তাকে ব্যক্তি ত্যাগের তালিকায় কত উচ্চতায় নিয়ে যাবে, তার জবাব দেবে সময়।
কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ত্যাগের বাইরে গিয়ে দুটি ব্যক্তিগত দৃষ্টান্তের কথা বলি। বাংলাদেশে করোনা কড়া নাড়ার একেবারে শুরুতেই, তার একুশে পদকের সঙ্গে পাওয়া অর্থমূল্যের পুরোটাই, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রোগী কল্যাণ সমিতিকে দিয়েছেন, সুফি মিজানুর রহমান। ২৪ মার্চ সুফি মিজান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ অর্থ হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০২০ সালে সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছিলেন পিএইচপি পরিবারের চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। একুশে পদকের অর্থমূল্য যে আহামরি তেমন নয়। সুফি মিজান চাইলে দেশে সবচেয়ে বড় হাসপাতালটিই তৈরি করে দিতে পারেন। তার প্রতিষ্ঠান করোনা কবলিত মানুষের জন্য বিপুল সাহায্য দিচ্ছেও। কিন্তু তিনি যখন তার একুশে পদকের অর্থ এ রকম একটি মানবিক কাজে তুলে দেন, তার মর্যাদাটি ভিন্ন মাত্রা পায়। আমি নিশ্চিত, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সুফি মিজান এই জীবনে অনেক পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন। কিন্তু একুশে পদক দিয়ে রাষ্ট্র তাকে সম্মানিত করেছে ভিন্নমাত্রায়। এই পুরস্কারের সঙ্গে জড়িত একটি জাতির আবেগ ও ভালোবাসা। একটি রক্তস্নাত জাতি তাকে সম্মানিত করেছে রাষ্ট্রীয় পদকে। আবার সেই তিনিই জাতির ক্রান্তিকালে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনটি তুলে দিয়েছেন দেশের মানুষের জন্যই। সম্মান ও শ্রদ্ধার অপূর্ব নেওয়া দেওয়া। অবনত মস্তক শ্রদ্ধা তার প্রতি।
দেশে নানা পদক পাওয়া আর ক’জন এগিয়ে এসেছেন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনে? নজির দেখি না। সবাই পুরস্কারের টাকা দেবেন তা নয়, কিন্তু ৩০/৪০ জন পদকজয়ী তো একসঙ্গে একটি বিবৃতিও দিতে পারেন, যা জাতিকে উজ্জীবিত করবে।
আরেকটি ঘটনা: রাজনীতিক বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপির। সংসদ সদস্য হিসেবে ২০১৮ সালে এলাকায় মানবসম্পদ উন্নয়নে ১২ লাখ টাকার বরাদ্দ পান তিনি। এই অর্থ গরিব ও দুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য এফডিআর করেন একটি ব্যাংকে। সেই তহবিলের লভ্যাংশের টাকা তিনি করোনা প্রতিরোধে তার নির্বাচনি এলাকা নালিতাবাড়ি ও নকলার হাসপাতালে হস্তান্তর করেন। ঘটনাটি ব্যতিক্রমী। কারণ আমাদের রাজনীতিতে সবই ‘বর্তমান কাল’। সরকার যা বরাদ্দ দেয় তা সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বিতরণ, কিছু লুটপাট আর কিছু অপচয়—এই ত্রিভুজের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। সেই চক্কর থেকে বরাদ্দ রক্ষা করে গরিব ও দুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য এফডিআর করে রাখা এবং দুঃসময়ে সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা এক দূরদর্শী, সাহসী ব্যতিক্রম বটে। ‘থোক বরাদ্দ’ আর তা লুটপাট যখন রাজনীতিতে লজ্জাহীন সাধারণ ব্যাপার, তখন বেগম মতিয়া চৌধুরীর এই ব্যক্তি উদ্যোগ মানুষপ্রেমী রাজনীতির উজ্জ্বল এক উদাহরণ, সন্দেহ নেই।
মানুষের জন্য কিছু করতে সবসময় বিশাল ঘোষণা বা বিপুল আয়োজন না হলেও চলে। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোগও বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
ধরা যাক, ওপার বাংলার ফুটবলার ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়ার কথা। লকডাউনে তিনি নিজে আটকা পড়েছেন শিলিগুড়িতে। সেখানে বসেই শুনলেন, তার নিজের এলাকা সিকিমে আটকা পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের হাজারখানেক শ্রমিক। লকডাউনে কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও বাড়ি ফেরার উপায় নেই তাদের। থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই। সাহায্যে এগিয়ে এলেন বাইচুং ভুটিয়া। শিলিগুড়ি বসেই গ্যাংটকের কাছে লুমসে-তে নিজের অসমাপ্ত বাড়িতে আটকে পড়া এই শ্রমিকদের থাকা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করলেন তিনি।
দুঃসময়ে মানুষ ব্যক্তি মানুষের সহায়তাকে মনে রাখে প্রবলভাবে। সমাজের বড় বড় ‘মাথার’ দিকে তাকিয়ে থাকে তারা। কিন্তু মাঝে মাঝে এই ‘মাথা’দের আচরণে হতাশা ছড়ায়। ভারতে শচীন, অক্ষয়দের ব্যক্তিগত দানের যেমন প্রশংসা হচ্ছে, তেমনি সমালোচনা হচ্ছে অনেকেরও। যেমন বিগ বি অমিতাভ বচ্চন বা তার পরিবারের কেউই এখনও পর্যন্ত করোনা-যুদ্ধে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। সাহায্যে এগিয়ে আসার আশ্বাস মেলেনি বলিউডের দুই খান শাহরুখ এবং আমিরের কাছ থেকেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, করোনা মোকাবিলায় শাহরুখের অনুদান কত? কেন তিনি চুপ? তালিকায় এখন পর্যন্ত রাখা যাচ্ছে না কাপুর পরিবারকেও। কারণ রণবীর , কারিনা কাপুর বা কাপুর পরিবারের কোনও সদস্যও অর্থ সাহায্যে এগিয়ে আসেননি।
অভিনেতা অক্ষয় কুমার প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ২৫ কোটি টাকা দান করেছেন। রিলিফ ফান্ডে সরাসরি অর্থ সাহায্য না করলেও ২৫ হাজার দিনমজুরের দায়িত্ব নিয়েছেন সালমান খান। আমাদের ক্রিকেটারদের দান প্রশংসিত সব মহলে। সেনাবাহিনী আর সরকারি কর্মকর্তাদের দানও প্রশংসনীয়। এক উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজুর রহমান ওলিও বলছেন, যারা অসুবিধায় আছেন তাদের খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হবে, কিন্তু কোনও ছবি তোলা যাবে না। কর্মহীন হয়ে পড়া খেটে খাওয়া মানুষের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের কয়েকজন সংবাদকর্মী ও পুলিশ সদস্য। ঝালকাঠির রাজাপুরের দক্ষিণ তারাবুনিয়া গ্রামের কলেজছাত্রী নূপুর আক্তার দাঁড়ালেন দিনমজুর, শ্রমিক, রিকশাচালক ও হতদরিদ্রদের পাশে। লজ্জায় সহায়তা নিতে আসতে পারে না বলে চাঁদপুরে অসচ্ছল কিছু পরিবারকে রাতের বেলায় বাড়িতে গিয়ে সহায়তা দিয়ে আসছে একদল তরুণ।
ভারতের হায়দ্রাবাদের একটি মসজিদে সারিবদ্ধ করে সহায়তা সামগ্রী রেখে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যার যার প্রয়োজন একজন একজন করে আসেন এবং নিয়ে যান। এসবই ব্যক্তি উদ্যোগ। নিশ্চয় আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। এ লেখায় সবার নাম না এলেও যাদের জন্য কাজ, নিশ্চয়ই তাদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেবেন সবাই।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের বাইরে এসে সাত মাসের বেতন দিয়ে দিয়েছেন করোনা তহবিলে। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান ও মাননীয় মন্ত্রী এবং সাংসদরা কি পারেন এরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে? বরং আমাদের দেশে দেখি কয়টা লিফলেট বিতরণ করতে মহা আয়োজন। ১০-১২টা মাস্ক বিতরণ করে ৫-৬ জনের দল, আর ফেসবুকে ছবি ডজন ডজন! কয়েক হাঁড়ি খিচুড়ি বিতরণ করতে গিয়ে ক্যামেরার জন্য টেলিভিশন কর্মকর্তাকে জ্বালাতন! সংকটকালে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কম গুরুত্বপূর্ণ এ কথা বলার কোনও সুযোগ নেই। সরকারি, বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ আর জানা অজানা ব্যক্তি উদ্যোগই আমাদের সব সংকটের ত্রাতা। কিন্তু বছরের পর বছর মুনাফা করে দুঃসময়ে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতার জন্য যারা সরকারি প্রণোদনা বা থোক বরাদ্দের দিকে অসহায়ভাবে হাত বাড়ান, তাদের ‘গরিবি’ দেখে কষ্ট লাগে। যারা আজ এই সংকটকালে থোক বরাদ্দ, প্রণোদনা, মওকুফ, কিস্তি, বিনাসুদে ইত্যাকার শব্দে শোরগোল করছেন, তারা একেকজন তো এদেশের ‘সুসময়ের মহারাজ’! নানা বাহারি সংগঠনের বিবৃতিজীবীদের কী ব্যক্তি উদ্যোগ, কী প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অনুপস্থিতি সত্যিই পীড়া দেয়। সরাদেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পর আবারও করোনা সংক্রমণ উর্দ্ধগতি। তাই সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের অবশ্যই মানবিক হতে হবে।
কবিগুরুর বসন্ত প্রার্থনা দিয়েই শেষ করি : ‘…যখন বসন্তের দক্ষিণ হাওয়া বইতে আরম্ভ করে তখন কেবল পাখির গানই যথেষ্ট নয়। অরণ্যের প্রত্যেকটি গাছ তখন নিজের সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করে, তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ উৎসর্গ করে দেয়। সেই বিচিত্র প্রকাশেই বসন্ত পরিপূর্ণ হয় সেই শক্তি অভিব্যক্তির দ্বারাই সমস্ত অরণ্য একটি আনন্দের ঐক্য লাভ করে, পূর্ণতায় ঐক্য সাধিত হয়। পাতা যখন ঝরে যায়, বৃক্ষ যখন আধমরা হয়ে পড়ে, তখন প্রত্যেক গাছ আপন দীনতায় স্বতন্ত্র থাকে, কিন্তু যখন তাদের মধ্যে প্রাণশক্তির সঞ্চার হয় তখন নবপুষ্প নব কিশলয়ের বিকাশে উৎসবের মধ্যে সব এক হয়ে যায়। আমাদের জাতীয় ঐক্য সাধনেরও সেই উপায়, সেই একমাত্র পন্থাৃ ‘[ ৪ ফাল্গুন ১৩৩২ বাংলা, ময়মনসিংহে দেওয়া বক্তৃতা ]।
দুঃসময়ের ব্যক্তি উদ্যোগগুলোকে সুসময়ে আমরা যেন ভুলে না যাই।