নিখিল মানখিন
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের গুরুত্বপূর্ণ খাত হয়ে উঠতে পারে মেডিক্যাল ট্যুরিজম। এমনটি মনে করছেন দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন,মেডিক্যাল ট্যুরিজমের মাধ্যমে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে বৈধ ও অবৈধ পথে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। অথচ দেশের উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সক্ষমতার বিষয়টি আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। দেশে রয়েছে মেডিক্যাল ট্যুরিজম গড়ে তোলার মত শক্তিশালী চিকিৎসা অবকাঠামো। চিকিৎসাব্যয় হ্রাসের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, জবাবদিহিতা ও আস্থার মাত্রা বৃদ্ধি করা গেলে দেশে স্থায়ী ও শক্তিশালী মেডিকেল ট্যুরিজম গড়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিকেল ট্যুরিজম হলো কোন এক দেশ থেকে অন্য আরেক দেশে সাধ্যের মধ্যে খরচে সুচিকিৎসার আশায় ভ্রমণ করা। যে চিকিৎসা রোগী তার মাতৃভূমিতে পেতে অপারক তা পাওয়ার জন্য অন্য উন্নত দেশে যাওয়ার বিষয়টি মেডিকেল ট্যুরিজমের আওতায় পড়ে। মেডিকেল ট্যুরিজম এর আওতায় কিছু সংস্থা আছে যারা রোগী এবং রোগীর পরিবারকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে কম খরচে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের থাকা ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। তারা কম খরচে উন্নত মানের চিকিৎসা পেতে রোগী এবং রোগীর পরিবারকে সাহায্য করে। সাধারণত রোগীকে দেশের বাইরে চিকিৎসা করতে নিয়ে এলে রোগীর পরিবারকে কিছু দিন বিদেশে থাকতে হয়। মেডিকেল ট্যুরিজম এর আওতায় থাকা এই সংস্থাগুলো তখন সেই রোগীর পরিবারের সদস্যদের এই বিদেশে ভ্রমণের সুযোগও করে দেয়। আর এই সমস্ত রকমের সুবিধা তারা প্যাকেজের মাধ্যমে রোগীর পরিবারকে দিয়ে থাকে।রোগীর পরিবার প্যাকেজ পছন্দ করে সহনীয় খরচে বিভিন্ন সুবিধা পেতে পারেন।মেডিকেল ট্যুরিজম নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এবং চিকিৎসাব্যবস্থার উপর অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন।
বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের কারণ:
বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানান, দেশের সর্বত্র প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার অবকাঠামো বেশ মজবুত। কিন্তু দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রযুক্তিগত দিক এখনও সর্বজনীনভাবে আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারেনি।স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো শক্তিশালী হলেও আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেই বললেই চলে। মেডিক্যাল ট্যুরিজম বলতে বোঝায়, যখন কেউ চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যজনিত কারণে এক দেশ থেকে অন্যদেশে বা একই দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যান এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বা রোগমুক্ত থাকতে চান।বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়ার কারণসমূহ উল্লেখ করতে গিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার সুখবর বাংরাকে জানান, তথ্য বিভ্রাটের শিকার হয়ে অনেকে বিদেশে যায়। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পেতেই বিদেশে গিয়ে থাকেন। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ কেউ দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাদের অনেকে দেশের প্রথম শ্রেনীর সকল হাসপাতালের খোঁজ খবর নেন না। আর অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা বাধ্য হয়েই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান।
বিদেশে যাওয়ার পেছনে দেশীয় চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতাকে দায়ী করলেন ডক্টর ফর হেলথ এণ্ড এনভায়রন্টমেন্ট এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা: রশিদী-ই মাহবুব। তিনি পথে প্রান্তরেকে জানান, বাংলাদেশীরা মূলত দু’টি কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। এক শ্রেনীর মানুষ বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। আর দেশে চিকিৎসা গ্রহণের পরেও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলে ওই রোগী বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করে থাকেন। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো অনেক শক্তিশালী। কিন্তু এখনও দেশের সর্বত্র বেশ কিছু জটিল রোগের চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা নেই। শুধু তাই নয়, কিছু জটিল রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়ে গেছে। শুরু হয়েছে বোনমেরু প্রতিস্থাপন ও লিভার সংযোজন কার্যক্রম। প্রাথমিক চিকিৎসা নয়, জটিল রোগের চিকিৎসা করানোর জন্যেই মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমায় বলে অধ্যাপক ডা: রশিদী-ই মাহবুব।
বিশেষজ্ঞরা জানান, যখনই মানুষ দেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান, তখনই মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই ব্যয়িত অর্থ বৈধভাবে খরচ হলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি বড় অংশ চলে যায়। পাশাপাশি অবৈধভাবে অনেকে খরচ মেটানোর জন্য অর্থ বহন করেন। গবেষণাকালে দেখা গেছে, সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে যেয়ে থাকেন। এই সামর্থের মধ্যে তিনটি উপাদান রয়েছে- আর্থিক সঙ্গতি, লোকবলের সঙ্গতি, যোগাযোগের সঙ্গতি। মূলত আর্থিক সঙ্গতির ওপর নির্ভর করে থাকে মানুষ চিকিৎসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, চীন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাবে কিনা। চিকিৎসার সময়ে রোগীর সাথে এটেন্ডেন্ট নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসা প্রসেসিংও অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি যে হাসপাতালে চিকিৎসা নেবে তাতে সরাসরি যোগাযোগ কিংবা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব আগে চিকিৎসা নিয়েছেন অথবা এখনও ওই দেশে অবস্থান করছেন- সেটিও মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে ওই রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট হাসপাতালকে নির্বাচন করা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেকেই ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের জন্য গিয়েছেন।
বাংলাদেশে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের সম্ভাবনা:
ডক্টর ফর হেলথ এণ্ড এনভায়রন্টমেন্ট এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা: রশিদী-ই মাহবুব বলেন, বাংলাদেশেও মেডিক্যাল ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে গড়ে তোলা যাবে, দেশে এমন অনেক হাসপাতাল রয়েছে। শুধু বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। দক্ষ জনবলসহ অত্যাধুনিক মানের মেডিক্যাল উপকরণ থাকতে হবে।
চিকিৎসা সেক্টরের প্রযুক্তিগত দিক আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা প্রদানের ওপর জোর দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা: প্রাণ গোপাল দত্ত। তিনি বলেন, চিকিৎসাসেবার সার্বিক অবস্থার উন্নতি ঘটলে যেকোনো দেশে মেডিক্যাল ট্যুরিজম গড়ে উঠবেই। বাংলাদেশের অনেক হাসপাতাল ইতোমধ্যে মেডিক্যাল প্রযুক্তিতে উন্নতি লাভ করেছে। এখন বাড়াতে হবে দক্ষ জনবল। আর স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিদেশী রোগীদের আস্থা অর্জন করতে হবে। ভারতের সাতটি রাজ্যসহ নেপাল, ভুটান ও বার্মা থেকে কিছু সংখ্যক রোগী বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে আসে বলে জানান অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত।
প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা থেকে জীবন বাঁচানোর মত সব ধরনের চিকিৎসাসেবাই বাংলাদেশে রয়েছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা বৈজ্ঞানিক ডা: মুস্তাক হোসেন। তিনি বলেন, প্রথমে দেশে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার দিকে নজর রাখতে হবে। দেশের চিকিৎসা অবকাঠামো এমনিতেই বিভাগ থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। তারপর জেলা ও বিভাগ পর্যায়ের প্রথম শ্রেনীর চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অত্যাধুনিক করে সাজাতে হবে। সব রোগের উন্নত চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা দিতে হবে। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ দুর্নীতি ও অনিয়মমুক্ত রাখতে হবে। আর চিকিৎসা ব্যয় অবশ্যই সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখতেই হবে। এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে এমনিতেই গড়ে উঠবে মেডিক্যাল ট্যুরিজম বলে জানান বৈজ্ঞানিক ডা: মুস্তাক হোসেন।
আগের তুলনায় বিদেশগামী রোগীর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা: আব্দুল্লাহ আল সাফী। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দেশে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বার খুলেছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশেও মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের রোগীরা ছুটে আসবে। এভাবেই দেশে গড়ে উঠবে মেডিক্যাল ট্যুরিজম বলে মনে করেন ডা: আব্দুল্লাহ আল সাফী।
বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে সুনামের সঙ্গে কাজ করার সংবাদ প্রকাশিত হয় হয় এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, চাইলে আমাদের দেশেও চিকিৎসা ট্যুরিজমের ব্যাপক বিস্তার সম্ভব।
লেখক- সিনিয়র সাংবাদিক