বিভুরঞ্জন সরকার
দেশে আপাতত কোনও রাজনৈতিক উত্তেজনা নেই। একটি কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি নিয়ে অস্বস্তি আছে কিন্তু আওয়ামী লীগের বিকল্প মুক্তিযুদ্ধের ধারার একটি প্রত্যাশিত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠছে না। খুব শিগগিরই তেমন দল গড়ে ওঠার বাস্তবতাও দেখা যাচ্ছে না। দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী জনগোষ্ঠী আছে। আছে আওয়ামী লীগবিরোধী অসংখ্য রাজনৈতিক দল। কিন্তু এই দলগুলোর কোনোটিই আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পেরে উঠছে না। বেশ কয়েক বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমান তালে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল বিএনপি। খালেদা জিয়ার ওপর ভর করে বিএনপি শক্তি-সমর্থন অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। ভোটে জিতে ক্ষমতায়ও গিয়েছে একাধিকবার। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিএনপির অবস্থা জৌলুসহীন হয়ে পড়ছে। ভুল রাজনৈতিক নীতি-কৌশল এবং তারেক রহমানের হঠকারিতার জন্যই মূলত বিএনপি আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না।
একসময় মনে করা হচ্ছিলো বামপন্থী দলের মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় শক্তি হয়ে উঠবে। সিপিবি সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, শোষণমুক্ত সাম্যভিত্তিক গণতান্ত্রিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই দলের অনেক নেতাকর্মীর ত্যাগ ও আত্মদানের বিষয়টি ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সিপিবির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। মুক্তির মন্দির সোপান তলে সিপিবির অনেকের প্রাণ বলিদান হয়েছে। আমি নিজেও এই দলের একজন সামান্য কর্মী ছিলাম। তারুণ্যের উজ্জ্বল-উচ্ছ্ল দিনগুলোতে আমিও এই দলের লাল পতাকা গৌরবের সঙ্গেই বহন করেছি। এখন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মূলত রাজনীতিই আমার চর্চার বিষয়। রাজনীতির ভালো-খারাপে আমি এখনও আলোড়িত হই। সিপিবির সাফল্য-ব্যর্থতা এখনও আমাকে আলোড়িত করে। আমি মনেপ্রাণে চাই আমাদের রাজনীতিতে সিপিবি আবার প্রভাবকের ভূমিকা পালন করুক। লাল পতাকার মিছিলে সয়লাব হোক দেশ-জনপদ। কিন্তু আমি এটাও জানি, আমি চাইলেও আর সিপিবি রাজনীতির প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে পারবে না।
সিপিবির বন্ধুরা আমার ওপর রুষ্ট হবেন, পাঁজিপুথি থেকে নানা মহাজন ব্যক্তির বাণী উদ্ধৃত করে বললেন, একদিন পৃথিবী ‘লাল’ হবেই, পৃথিবী শোষকদের নয়, শোষিতের। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ ক্ষয়িষ্ণু, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, সমাজতন্ত্রের বিজয়রথ ওই নাগালের মধ্যে এলো বলে। ধন্য আশা কুহকিনী।না, কারও বিশ্বাস বা আশাবাদ নিয়ে আমি কিছু মন্তব্য করতে চাই না। মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচে। গত সংসদ নির্বাচনের আগে সিপিবির কয়েকজন নেতাকর্মীর কাছ থেকে যে বার্তাটি পেয়েছি তা এখানে হুবহু তুলে ধরছি :
‘আপনি নৌকায় ভোট দিলে নৌকা হয়তো জিতবে, সঙ্গে জিতবে লুটেরা কালো টাকার মালিকরা। আপনি ধানের শীষে ভোট দিলে ধানের শীষ হয়তো জিতবে,সঙ্গে জিতবে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার আর সুবিধাবাদীরা। আর হেরে যাবে দেশের সাধারণ মানুষ। আপনি কাস্তে মার্কায় (সিপিবির নির্বাচনি প্রতীক) ভোট দিলে কাস্তে যদি নাও জিতে, অন্তত আপনার বিবেক জিতে যাবে। কেননা, আপনি কোনও অসৎ কালো টাকার মালিক, ব্যাংক লুটেরা, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার বা সুবিধাবাদীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেননি’।নির্বাচনি প্রচারের জন্য এটি একটি সুন্দর বক্তব্য সন্দেহ নেই। নৌকা এবং আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়ে সিপিবিকে ভোট দেওয়ার পক্ষে মোক্ষম যুক্তি! কাস্তে জিতবে না কিন্তু জিতবে ভোটারের বিবেক! কিন্তু বিবেককে জেতাতে গিয়ে কাকে হারাচ্ছি, সেটা কি ভেবে দেখার মতো নয়? বলা হবে, নৌকা, ধানের শীষের কে জিতলো তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। ওই দুই দলের মধ্যে মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই। সত্যি কি নেই? প্রসঙ্গত, প্রবাসী লেখক কুলদা রায়ের ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি। কুলদা রায় লিখছেন: ‘দেশে নির্বাচন এসে গেছে। নির্বাচনের সময় এদের (একশ্রেণির প্রগতিবাদী) চরমভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে দেখা যাচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জামায়াত-বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছেন। তাদের ক্ষমতায় আনার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনও অর্থেই জামায়াত-বিএনপি নয়। জামায়াত-বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতায়ই বিশ্বাস করে না। তারা বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্র বানাতে চায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই মৌলবাদীরা ক্ষমতায় এলে প্রথমেই তাদের বর্তমান হোস্ট কামাল অ্যান্ড গংদের উৎখাত করবে। ইরান ও আফগানিস্তানের ইতিহাস তা-ই বলে। দেশ থেকে খুঁজে খুঁজে বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল, নাস্তিকদের গলা কেটে উল্লাস করবে। তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও রেহাই দেবে না। একাত্তরে জামায়াতরা কাউকে রেহাই দেয়নি। যে জামায়াত-বিএনপির কারণে নাস্তিক-ব্লগাররা মৃত্যুর হুমকি মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়েছে, তারাই এখন জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে সহযোগিতা করছেন। কী পরিহাস’!
সত্যি,সিপিবির বর্তমান রাজনৈতিক লাইনও আমার কাছে পরিহাস বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্বের নীতি নিয়ে মূলত আওয়ামী লীগের বিরোধিতা এবং বিএনপির সহযোগিতা করা হচ্ছে। বলতে পারেন তা কেন হবে—সিপিবি তো দুই দলেরই সমালোচনা করছে, ‘আপদ-বিপদ’ থেকে নিরাপদ দূরে থাকছে! সেটা ঠিক। সিপিবি এখন আওয়ামী লীগেরও সমালোচনা করে, বিএনপিরও করে। এই যে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে এক করে দেখা, শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে সমান সমান দেখা—সিপিবির এই কৌশলের মধ্যেই রয়েছে চালাকি বা শুভঙ্করের ফাঁকি।
সিপিবি একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য ও মৈত্রীর নীতি নিয়েই অগ্রসর হয়েছে। সিপিবি যে রাজনীতিতে দৃশ্যমান শক্তি হয়ে উঠেছিল, সেটা আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ পরিচয় নিয়েই। সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পর সিপিবি যখন থেকে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার নীতি বা স্বতন্ত্র পথ অনুসরণ শুরু করেছে, তখন থেকেই সিপিবি কার্যত উত্থানরহিত, মৃতপ্রায় নদীর মতো হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলছে সিপিবি প্রায় তিন দশক হতে চললো। তারপরও অনেকেই সিপিবিকে আওয়ামী ঘরানার দলই মনে করে। তারও কারণ আছে। কারণটা হলো মুক্তিযুদ্ধ। সিপিবি আওয়ামী লীগ ছাড়লেও মুক্তিযুদ্ধ ছাড়েনি। আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হলে তাকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি করা হবেই। ফলে সিপিবি আওয়ামী লীগ ছেড়ে কোনও সুফল না পেলেও সুফল পাচ্ছে বিএনপি। বিএনপির বিরুদ্ধে সিপিবি কী বলে সেটা চেপে গিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কী বলে সেটাই বিএনপি মানুষের সামনে তুলে ধরে। আওয়ামী লীগের পুরনো মিত্র সিপিবিও এখন তাদের সঙ্গে নেই, কত মজাদার ব্যাপার! এই প্রচারণা একজনকে আওয়ামী লীগবিরোধী হতে সাহায্য করলেও সিপিবিমুখী করছে না। বরং বিএনপি অনুরাগী করছে। আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে কেউ সিপিবিকে ভাবছে না। তাতেই সুবিধা বিএনপির। তাছাড়া সিপিবির কোনও কোনও নেতার বক্তব্য আওয়ামী লীগের প্রতি যতটা আক্রমণাত্মক, বিএনপির প্রতি ততটাই নমনীয়।নৌকা বা ধানের শীষে ভোট না কাস্তেকে ভোট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, বলা হয়েছিল বিবেকের কথা। এসব কথা শুনতে ভালো। কিন্তু এর প্রায়োগিক মূল্য কম। প্রথম কথা, সিপিবি সারা দেশে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারে না। এমনকি ১০০ আসনেও নয়। যেখানে সিপিবির কাস্তে মার্কা থাকে না সেখানে মানুষ কী করবে? ভোট না দিয়ে ‘বিবেক’জেতাবে? সিপিবির এই বিবেক জেতানোর প্রচারণা কৌশলে মানুষকে ভোটবিমুখ করা হয়েছে কিনা ভেবে দেখা দরকার।
গত নির্বাচনের আগে সিপিবির একজন ছোট নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের জেতার মতো কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকার মতো প্রার্থী কতজন আছেন?আমার প্রশ্নে নেতা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমরা জিততে না পারলেও হারাতে পারবো বেশ কয়েকজনকে।
কোন দলের প্রার্থী হারাতে পারবেন সিপিবি প্রার্থীরা সেটা ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। সিপিবিকে নিশ্চয়ই বিএনপি ঘরানার কেউ ভোট দেয় না।
কুলদা রায়ের কাছে আবারও ফিরে যেতে হয়। তিনি লিখেছিলেন: ‘আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করুন, আপত্তি নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগকে সরিয়ে জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবেন না। দেশের প্রধান শত্রু জামায়াত-বিএনপি। তাদের শক্তিশালী করার যেকোনও পদক্ষেপই হবে আত্মঘাতী। তাদের বদলে উদার অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি গড়ে তুলতে কাজ করুন’।মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী এবং তাদের সহযোগীদের বিরোধিতা করার মতো একটি রাজনৈতিক শক্তি যতদিন গড়ে না উঠবে, ততদিন সব ইস্যুতে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করলে কার্যত বিএনপি-জামায়াতকেই সহযোগিতা করা হবে। বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে এখন দক্ষিণপন্থার উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘ধর্ম’ রাজনীতির একটি বড় নিয়ামক উপাদান হয়ে উঠছে। আবার সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নিয়েও সারা বিশ্বেই শঙ্কা ও উদ্বেগ আছে। আমরা মুজিববর্ষ উদযাপন করতে যাচ্ছি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সব অর্থেই এক ‘বিস্ময় মানব’। তিনি জন্মেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। তিনি জাতির পিতা। রাজনীতিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, কীভাবে শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পরিস্থিতি নিজের পক্ষে নিতে হয়, শত্রু-মিত্র বাছাইয়ের কৌশল কী—এসবই শেখ মুজিবের কাছ থেকে শিখতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হলে মুজিব-অধ্যয়নের কোনও বিকল্প নেই।দেশ এখন আবার রাজনীতিতে একজন বিস্ময় মানবের অপেক্ষা করছে। এই অপেক্ষা কত দীর্ঘ হয়,দেখার বিষয় সেটাই।