Search
Close this search box.

ক্যাম্পাসে যৌন নিপীড়ন

আত্মহত্যা আটকানো যায়
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের নিগ্রহ এবং নিগ্রহকারী হিসেবে ছাত্র-শিক্ষকদের নাম উঠে আসা গভীর উদ্বেগের। অথচ সেটি ঘটছে অহরহ এবং এর কোন বিচার নেই, প্রতিকার নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন একটি ভয়ংকর যৌন নিপীড়নের ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে।

গত রোববার রাতে ক্যাম্পাসের ভেতরেই এক ছাত্রীকে বেঁধে রেখে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন পাঁচজন তরুণ। এই ধর্ষক ও নিপীড়করা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ছাত্রী হাটহাজারী থানায় অজ্ঞাতনামা পাঁচজনকে আসামি করে একটি মামলাও করেছেন। কিন্তু এমন গুরুতর ঘটনার পাঁচদিন দিন পরও জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ।

তবু প্রতিবাদ হয়। যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে মেয়েদের ও ছেলেদের এই সরব প্রতিবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা যৌন শোষণ রোধে এর চাইতে এ মুহূর্তে বড় কার্যকর পথ আর নেই। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল প্রয়োজন। ভবিষ্যতে নিগৃহীতার নিকটজনকে যেন জীবনভর গঞ্জনা বয়ে বেড়াতে না হয় সে আন্দোলনে সবার সক্রিয়তা প্রয়োজন। প্রায়ই ক্যাম্পাসে মেয়েরা যৌন নিগ্রহ ও ধর্ষণের শিকার হয়, কিন্তু কোন ঘটনারই বিচার হয় না। এবারের ঘটনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হলেও বলতে হবে একটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধান পাওয়া যাবে না, যেখানে ছাত্রীরা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত বোধ করেন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দায়বদ্ধতা, অভিযোগ নিরসন পদ্ধতি ও ক্ষমতাবিন্যাস নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। হাইকোর্টের অনেক অনেক নির্দেশনার পরেও অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি। নির্যাতনকারীরা ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর অবস্থান করায় পার পেয়ে যাচ্ছে, আর দোষ পড়ছে নিগৃহীতাদের উপর।

এবারের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গড়িমসি ও উদাসীনতা নিয়ে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। যৌন নিপীড়কদের শনাক্ত না করে উল্টো ছাত্রীদের হলে ফেরার সময়সীমা বেঁধে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শুধু তাই নয়, নিজেদের শিক্ষার্থীরা যখন আন্দোলন করছে, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে ফলাহারের উৎসব করেছেন। কতটা অসংবেদনশীল হতে পারেন এরা!

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও বেশ কিছু শিক্ষার্থী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এমনকি সাম্প্রতিক সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। বেশির ভাগ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা শাস্তি পায়নি। ক্যাম্পাসের ভেতরে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের বিরুদ্ধেও। কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এ সেল তৈরি করা হলেও সেটিকে পরিকল্পিতভাবে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বলে শিক্ষক মহল থেকেই অভিযোগ এসেছে। ছাত্রীরা কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে সেটিকে গুরুত্ব দেন না সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। অভিযোগ আমলে নিলেও সেটি দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়। এমনকি চার বছর ধরে পড়ে আছে এমন অভিযোগও আছে। অথচ স্বয়ং উপাচার্যই এ সেলের আহ্বায়ক। এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন নারী।

আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাধারণত নিগ্রহের শিকার নারী মুখ বুজে অত্যাচার হজম করে বা নীরবে শিক্ষাঙ্গন ত্যাগ করে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেদি দায়ী তা হলো অরক্ষিত ক্যাম্পাস, নিগ্রহকারীদের অমিত ক্ষমতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েটিকেই দোষ দেওয়া হয় যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার, প্রক্টর ও বিভিন্ন হলের প্রভোস্টদের নিয়ে উপাচার্য শিরীন আখতারের এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মেয়েরা বেশি রাতে বাইরে থাকতে পারবে না। এর কারণ রাজনীতি। রাজনৈতিক কারণে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য, প্রক্টর বা প্রভোস্টরা রাজনৈতিক যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধের কিছু না বলে তাদের বাঁচাতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। তাই পড়ালেখা শেষ করার অনিশ্চয়তা তো আছেই, সাহস করে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও নানা চাপের মুখে তাদের একটা বড় অংশ মাঝপথে পিছু হটতে বাধ্য হন।

২০০৯ সালের ১৪ মে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কয়েকটি দিকনির্দেশনাসহ রায় দেয় হাইকোর্ট। ওই রায়ে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগকেন্দ্র ও তা পরিচালনার জন্য ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের কমিটি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় হাইকোর্টের নির্দেশই মানেননি।

অনেকেই এখনও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেনি। এছাড়া যারা কমিটি করেছে তাদের বেশিরভাগই নিষ্ক্রিয়। অনেকেই যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে কাজ তো করেই না, যারা করে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই অনিয়ম করে এবং এর কারণ রাজনীতি। যারা ক্যাম্পাসে যৌন অপরাধের সাথে যুক্ত থাকে তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় রাজনীতি সচেতন শিক্ষক সমাজ এড়িয়ে চলে বা অপরাধীকে রাজনৈতিক কারণে প্রশ্রয় দেয়। রাজনীতির এত এত মারপ্যাঁচ, সমাজের রক্তচক্ষু এবং নিগ্রহকারীর পরাক্রম উপেক্ষা করে তবুও কখনও কখনও নির্যাতিতারা মুখ খুলেন। আন্দোলন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন নিয়েও বিতর্ক করার চেষ্টা করেন অনেকে। কেউ কেউ মেয়েদের এই প্রতিবাদী কণ্ঠকে মনোযোগ আকর্ষণ বা রাতারাতি বিখ্যাত হওয়ার কৌশল বলে কটাক্ষ করেন, কেউবা বলেন মেয়েদের কেন রাতে হলের বাইরে বের হতে হবে? কারও মতে এটা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ার।

তবু প্রতিবাদ হয়। যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে মেয়েদের ও ছেলেদের এই সরব প্রতিবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা যৌন শোষণ রোধে এর চাইতে এ মুহূর্তে বড় কার্যকর পথ আর নেই। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল প্রয়োজন। ভবিষ্যতে নিগৃহীতার নিকটজনকে যেন জীবনভর গঞ্জনা বয়ে বেড়াতে না হয় সে আন্দোলনে সবার সক্রিয়তা প্রয়োজন। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে করা মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই পারে ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ