রাশেক রহমান
ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। এই যে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারের স্তম্ভ নিয়ে আমরা কথা বলি; এগুলোই বাংলাদেশকে সুন্দর করবে এমন স্বপ্ন ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্বাসের জায়গাটা বাতাসের মতো উড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। এখনও বাংলাদেশ থেকে সেই বিষ সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডেও ওই সাম্প্রদায়িক শক্তির একটা ইন্ধন ছিল।
আমার বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুরে। এবারের শারদীয় দুর্গোৎসবে মিঠাপুকুরে পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিল ১৪০টি। দুই বছর আগে অর্থাৎ করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের আগে মিঠাপুকুরে পূজামণ্ডপ ছিল ১২০টি। গাণিতিকভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, এবার পূজা আয়োজনের ব্যাপ্তি ঘটেছে। পূজা-পার্বণ ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনের সুযোগ না থাকলে পূজামণ্ডপ বৃদ্ধির ব্যাপারটা দেখা যেতো না। দেশবিরোধীদের মরণ কামড়ের পরও দেশে এখন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক স্থিতিশীলতা আছে বলেই এমনটা হচ্ছে। কারণ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ প্রচারের পাশাপাশি নিজেরাও চর্চা করে যাচ্ছে। তবে আমিও আর সবার মতো চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে চাই, কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলাই আমরা দেখতে চাই না। এমন ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের সমূলে উৎপাটন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক হামলা এমনই এক বাস্তবতা যার কাছে বাংলাদেশে কোনও সনাতন ধর্মাবলম্বী, কোনও বৌদ্ধ, কোনও খ্রিষ্টান, এমনকি কোনও মুসলমানও রক্ষা পাবে না।
এ দেশের একটি অনন্য সৌন্দর্য হলো বিভিন্ন বিশ্বাসের মানুষদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই বাংলাদেশ, জননেত্রী শেখ হাসিনার এই বাংলাদেশ। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে যদি আমরা রক্ষা না করতে পারি তবে আপনি বা আমি কতটুকু নিরাপদ সেটাও ভাবনার বিষয়। কারণ সাম্প্রদায়িকতা সবাইকেই আক্রান্ত করে। সাম্প্রদায়িক হামলা ধনী-দরিদ্র চেনে না। এর করাল থাবা থেকে কেউই নিরাপদ নই। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর গ্রামের মাঝিপাড়ায় মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়িতে উগ্রবাদীদের হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার কথা সারাদেশ জানে। এটি আমার প্রতিবেশী উপজেলা। সেখানে যাদের ওপরে হামলা হয়েছে তারা আমাকে বলছিলেন, সবাই সেই রাতে ধানক্ষেতে শুয়ে ছিলেন। হামলার সময় বৃষ্টি ছিল, কিন্তু তাও তারা রক্ষা পাননি। সবারই মনে রাখতে হবে, হামলাকারীরা মেঘ-বৃষ্টি দেখে কাউকে ছাড় দেয় না।
মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ কারা বপন করেছিল, কারা এই দেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছে, তারা সুচিহ্নিত। এখন এ দেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা সবসময়ই ছোবল দেওয়ার চেষ্টা করে। দেশের কিছু কিছু জায়গায় এমন কিছু গোষ্ঠী রয়েছে যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাঝে ফাটল ধরানোর মাঝে নিজেদের সফলতা খুঁজে পায়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক একজন মুক্তিযোদ্ধা ও জাতির পিতার বন্ধু ছিলেন। আইনমন্ত্রীর কাছে সবিনয়ে জানতে চাই, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যতবার এমন সহিংসতার জন্য দায়ী সন্ত্রাসীদের ধরে জেলে পুরেছে তাদের জামিনের বিষয়ে ক’বার নারাজি দেওয়া হয়েছে? কোন আইনের ভাষায় এমন সন্ত্রাসীদের জামিনের বিরোধিতা করা হয়েছে? সেই হিসাব-নিকাশ যদি না করা হয় তবে কোনও ফল পাওয়া যাবে না। সন্ত্রাসী ধরা যেতে পারে, বিভিন্ন জনকে আটকানো যেতে পারে, কিন্তু তাদের আসলে বেশিদিন অন্তরীণ করে রাখা যায় না। প্রতিটি সরকারে বিজ্ঞ কৌসুলিরা থাকেন, যাদের কাজ সন্ত্রাসীরা যাতে জামিন না পায় এবং তাদের চার্জশিট যেন আইনি প্রক্রিয়া অর্থাৎ বিচারের শেষ পর্যন্ত যেতে পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তারা তা কতটুকু করতে পেরেছেন তার আকলন/বিকলনের ফিরিস্তি নেওয়া প্রয়োজন।
ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে বিদ্বেষমূলক বার্তা ছড়ানো হয় সেসব মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি কতটা? এ নিয়ে আমাদের ভাবনার সময় এসেছে। শুধু ব্যক্তি আক্রমণই নয়, এখন রাজনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিকভাবেও অনেককে হেয় করা হচ্ছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় যখন দেখি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিদ্বেষমূলক বার্তা ছড়ানো হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরাই বিভিন্নভাবে সমাজে উসকানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার চেষ্টা চালায়। তাহলে এই কন্টেন্টগুলো আপলোড হয় কীভাবে?
আমি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই, আমাদের দেশে ফেসবুকে যারা কন্টেন্ট অ্যাপ্রুভার আছেন বা যারা কন্টেন্ট অ্যানালাইসিস করেন অবশ্যই তারা পার্টিজান। খেয়াল করে দেখবেন, দেশবিরোধী কন্টেন্ট তো প্রথমত আপলোডই হওয়ার কথা না। যদি ঠিকমতো কন্টেন্ট অ্যাপ্রুভার রাখা হয় এবং ফেসবুক ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করে থাকলে যে কন্টেন্টে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায় কিংবা যে কমেন্টে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হামলার উসকানি থাকে সেগুলো তো আপলোডই করা যেতো না।
আমার মনে হয়, বিটিআরসি’র ফেসবুকের সঙ্গে বসা উচিত। ফেসবুককে বলতে হবে– আপনি আমার দেশ ও জনগণকে দিয়ে মুনাফা আয় করছেন, আপনার ব্যাপ্তি বাড়ছে, সুতরাং যাকে কন্টেন্ট অ্যাপ্রুভার হিসেবে দায়িত্ব দেবেন তাদের আরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে মানবিক হয়ে কাজটা করতে হবে। যদি এই জায়গাটা পরিষ্কার না করেন তাহলে আগামীতেও পূজামণ্ডপে কোরআন রেখে ছবি তোলা, চাঁদে দেলওয়ার হোসেন সাঈদিকে দেখা যাওয়ার মতো আরও কন্টেন্ট আপলোড হবে, যেটা জাতি ও দেশের জন্য বিপজ্জনক। যেহেতু আমরা মাঠের রাজনীতি করি, আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেই, সেক্ষেত্রে বলতে পারি– ফেসবুকের কন্টেন্ট অ্যাপ্রুভাররা একেবারেই দায়িত্বশীল জায়গা থেকে কাজ করছেন না এবং তারা পার্টিজান।
বিটিআরসি যুক্তরাষ্ট্রের কোনও আইনি সংস্থাকে ভাড়া করলে মার্ক জাকারবার্গ বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা নিয়ে কাজ করবে। তখন অবশ্যই উসকানিদাতাদের আইনের আওতায় আনা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে বিটিআরসি’র একটি ডেস্ক থাকা উচিত, যেখান থেকে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে আইনি সহায়তা নিয়ে ফেসবুক, ইউটিউব এবং হোয়াটসঅ্যাপের সঙ্গে আইনি ভাষায় কথা বলতে পারবে সরকার। এটা বড্ড প্রয়োজন। দিনের শেষে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ চিঠি বা ইমেইল পাঠালে ফেসবুক অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মাধ্যমে উত্তর পাঠায়। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের কাছে জানতে চাই– ফেসবুক, ইউটিউব বাংলাদেশের মতো একটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, সেখানে তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? যেসব কন্টেন্ট, ভিডিও বা পোস্টের কারণে বাংলাদেশ অস্থির হয় সেগুলো নিয়ে ফেসবুককে সতর্ক করা উচিত।
বাংলাদেশে আমাদের সবার দায়িত্ব আছে। এটি আমাদের সবার অনিন্দ্য সুন্দর মাতৃভূমি, যা বঙ্গবন্ধু আমাদের এনে দিয়েছিলেন। তাই আসুন, সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলি। লেখক- কলামিস্ট