জাফর ওয়াজেদ
সেদিন যার যা দায়িত্ব ছিল, তারা তা পালন করেছে, তা নয়। কেন পারেনি, কেন দায়িত্বে অবহেলা করেছে, সেসব আজও অনুদ্ঘাটিত। সে সময় ঢাকায় দলের প্রায় সব সংসদ সদস্য, প্রশিক্ষণরত বাকশালের জেলা গভর্নর, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা অবস্থান করছিলেন। ছাত্রনেতারা ব্যস্ত ছিলেন ১৫ই আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষ্যে আয়োজনে। সেদিন হরতাল ডাকা হয়েছিল সশস্ত্র একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। শহরে বোমাবাজির ঘটনাও ঘটে। এক ধরনের আতঙ্ক ১৪ আগস্ট দিনে-রাতে তৈরি করা হয়। নগরবাসীর ওপর মানসিক চাপ আগেই তৈরি করা হয়। সমাবর্তনে যোগদানকে সামনে রেখে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও সে রাতের ঘটনা প্রমাণ করে না নিরাপত্তা ব্যবস্থা সামান্যতম হলেও ছিল। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আগের সময়গুলোতে কারা কারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন, কারা বঙ্গবন্ধুর তথ্য পাচার করত, সেসব অজানাই থেকে গেছে। দলের ভেতর নানা উপদল, গ্রুপ, উপগ্রুপগুলোর তৎপরতা-অপতৎপরতার ভেতর বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষ মাত্রা কতটা ছিল, তা অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রয়োজন ছিল, সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু এই হত্যার নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারীদের অবস্থান রয়ে গেছে অজ্ঞাত। তারও নেপথ্য-প্রকাশ্য কারণ রয়েছে।
সেদিন যার যা দায়িত্ব ছিল, তারা তা যথাযথভাবে বা সামান্যতম হলেও পালন করেছিলেন, এমনটা জানা যায় না। বরং ঘাতকরা যে বেতার-টিভিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘খুনি, ডিকটেটর, সম্পদলুটেরা’ ইত্যাকার বানোয়াট অভিধা দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল, তাতে ভয়ার্ত, আতঙ্কিত হওয়ার কী কারণ ছিল বাকশাল নেতা, সংসদ সদস্যদের। প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যর্থতার কথা আংশিক হলেও সর্বজনবিদিত। কিন্তু রাজনীতিকদের ভূমিকা ও অবস্থান দেখে বিস্মিত হতে হয়েছে সেদিন। বঙ্গবন্ধু নেই জেনে শোকাহত সাধারণ মানুষকে সেদিন শক্তিতে পরিণত করে দেশকে পাকিস্তানপন্থিদের হাতে চলে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হতে পারেননি। সরকারি দলের নেতাদের অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল এই ধারণা জন্মেছিল যে, বঙ্গবন্ধু নেই, তাতে কী হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারাই তো ক্ষমতায়। অনেকে মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। অথচ মুজিব বিরোধিতা দিয়েই মোশতাক এবং তার সেনা-সহযোগী জিয়ার অবস্থান গ্রহণ। মোশতাক ক্ষমতায় বসে বঙ্গবন্ধু প্রণীত সব ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটন করে পাকিস্তানি বিধিবিধান চালু শুরু করে। পাশাপাশি জাতীয় চার নেতাসহ অন্যান্য নেতা, যারা তার আনুগত্য মেনে নেননি, তাদের কারাগারে পাঠায়। মোশতাক যখন বুঝতে পারে, আওয়ামী লীগ নেতানির্ভর দল নয়; কর্মীনির্ভর দল, তখন সারা দেশে কর্মীদের তার পক্ষে টানার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিল। আর জেলা ও থানা পর্যায়ে তার বিরোধী নেতাদের মামলা-হামলার ভয় দেখিয়ে কাউকে কাউকে অনুগত করে। অনেককে জেলে পাঠায়। অস্ত্র উদ্ধারের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘরে তল্লাশি চালানো হয়। প্রশাসনে পাকিস্তানপন্থি আমলাদের বসানো হয়।
মোশতাক খুব স্বল্প সময়ে এবং দ্রুত তার কার্য সমাধা করে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে পেরেছিল ৮১ দিনের ক্ষমতা দখলকালে। মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, হাজী দানেশ, মওলানা তর্কবাগীশ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠন তার প্রতি সমর্থন জানায়। অনেক সংসদ সদস্য সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিষোদ্গার করে মোশতাকের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছিল। মোশতাক পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়, কট্টর বামপন্থি ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের উন্মুক্ত পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার সূচনা করে।
পাকিস্তানিদের পক্ষে দালালির অভিযোগে যাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের সূচনা হয়। রাষ্ট্রীয় কাজে ধর্মের প্রাধান্য দান, কালো টাকা বৈধকরণসহ অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু; বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্তির কাজটি দ্রুত সেরেছিলেন। দেশজুড়ে তার এবং খুনি সেনাকর্মকর্তা ফারুক-রশিদ-ডালিমের প্রহরায় পরিচালিত তার সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়নি। তার প্রতি বিরূপ আওয়ামী লীগারদের বিচার করার জন্য মোশতাক দুটি সামরিক আদালত গঠন করে। অস্ত্র উদ্ধারের নামে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করায়।
৬১টি জেলা গঠনের আদেশ বাতিল করে ১৯টি জেলা বহাল করে। একপর্যায়ে সব রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। কিন্তু মোশতাক ও তার অনুসারীরা নিজস্ব রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। ভাসানী ন্যাপ পুনর্গঠিত হয়। দালাল আইনে আটক তাদের নেতা যাদুমিয়া ছাড়া পেয়ে পাকিস্তানি ধারা চালু করে। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের সমন্বয়ে ক্ষমতা দখলকারীদের কেউই তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শোনা যায়নি। দলের নেতাকর্মীদের পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, অবিশ^াস বাড়ছিল। কাউকেই আর বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না।
দেশের মানুষ এমন একটা ধাক্কা খেয়েছে ১৫ই আগস্ট, তারা নির্বিকার, ভাবালুতাহীন হয়ে পড়েছিল। শোকের, বেদনার মাত্রা খুব তীব্র ছিল বলেই ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও দাঁড়াতে পারেনি। সেদিন কেউ জনগণকে খুনিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে ডাক দেয়নি। যাদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা, তারাই খুনিদের প্রতি, মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্যে শুধু ব্যক্তি মুজিবকে নয়, বাংলাদেশ নামক তাঁর সৃষ্ট রাষ্ট্রটাকেও হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে বহুবার হত্যার চেষ্টা হয়েছে স্বাধীনতার পূর্বাপর। ১৯৭৫ সালে ঘাতকরা সফল হয়েছে। শেখ হাসিনাকেও ২১ বার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন প্রয়োজন তাঁর সৃষ্ট দেশটাকে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করার লক্ষ্যে। যাতে দেশ ও দেশবাসী ফিরে পায় সেই স্বদেশ। সমাপ্ত
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)