Search
Close this search box.

কারাগারে হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে যেভাবে রক্ষা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

নৃশংসতম একুশে আগস্ট

ফিরোজ মান্না :

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একাধিকবার হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। এই ষড়যন্ত্র শুরু হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার দিন থেকেই। বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের মিয়াওয়ালির কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ‘কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার কাজটা শুরু হবে ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত একটা থেকে। কিন্তু রাত সাড়ে ১১টা থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর অধিনায়করা উত্তেজিত এবং প্রস্তুত। তারা এইচ-আওয়ার অর্থাৎ হামলার নির্ধারিত সময়টি এগিয়ে আনার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল।’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা নাটক শেষে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সেদিন সন্ধ্যাবেলায় লুকিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। তাকে বহনকারী বিমানটি তখনও কলম্বো আর করাচির মাঝপথে রয়েছে। সেটি করাচি না পৌঁছনো পর্যন্ত অ্যাকশন শুরু করা যাবে না। পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েনে সেনাবাহিনীর কোর কমান্ডার ও সামরিক শাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠালেন: ববিকে (ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবাব) বলো যতক্ষণ সম্ভব অপেক্ষা করতে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের কোড-নেম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’- চার পাতার এই পরিকল্পনায় ছিল ১৬টি অনুচ্ছেদ। এই পরিকল্পনায় ছিল সেনাবাহিনীর দুটি সদর দফতর থাকবে। একটির দায়িত্ব নেবেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। তার অধীন ব্রিগেডিয়ার আরবাবের ৫৭ ব্রিগেড ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে অপারেশন চালাবে। অন্যদিকে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা দ্বিতীয় হেডকোয়ার্টারের দায়িত্বে থাকবেন। ঢাকা বাদে দেশের বাকি অংশে অপারেশনের দায়িত্ব তার।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে সেই রাতে ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন মেজর সিদ্দিক সালিক। তিনি তার লেখা উইটনেস টু সারেন্ডার বইতে জানিয়েছেন, ‘রাত সাড়ে এগারটা থেকে ওয়্যারলেসগুলো সচল হয়ে উঠলো। নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হলো হামলা। খুলে গেল দোজখের দরোজা।’ ‘সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কন্টিনজেন্ট যখন ঢাকা শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তখন বিশাল এক বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির দিকে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া ছিল। তাকে গ্রেফতারের জন্য যে কমান্ডো দল রওনা দিয়েছিল তারা রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে তা উড়িয়ে দেয়।’ সেনাবাহিনীর নিয়মমাফিক কোম্পানিতে নেতৃত্ব দেয়ার কথা একজন ক্যাপ্টেন বা মেজর পদমর্যাদার অফিসারের। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকের দায়িত্ব পাওয়া স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এসএসজি) ৩ কমান্ডো কোম্পানিতে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল জেড এ খান এবং কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মেজর বিলাল রানা আহমেদ। এসএসজি কমান্ডোরা যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল তখন বাড়ির রক্ষীরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। কমান্ডোরা দ্রুত এদের থামিয়ে দেয়। একজন অস্বীকার করলে তাকে হত্যা করা হয়। বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথেই ৫০ কমান্ডো স্টেনগান দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণ শুরু করে। তারা চিৎকার করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বেরিয়ে আসতে বলে। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে তারা দোতলায় উঠে আসে। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তার গ্রেপ্তারের সেই মুহূর্তগুলোর বর্ণনা দিয়েছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক সিডনি শনবার্গকে। ‘গোলাগুলি শুরু হলে আমি সবাইকে নিয়ে ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়ি। তারপর যখন সিঁড়িতে তাদের পায়ের শব্দ পাই, তখন দরোজা খুলে বলি: গুলি থামাও, গুলি থামাও। কেন তোমরা গুলি করছো? আমাকে যদি মারতে চাও আমি তো এখানেই রয়েছি। কেন তোমরা আমার লোকজনকে মারছো?’ পাকিস্তানি সৈন্যরা এরপরও গুলি চালালে, মেজর বিলাল তাদের থামায় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে জানানো হয় যে তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেন। তাদের তিনি বলেন: ‘আমাকে হয়তো ওরা মেরে ফেলবে। ফিরে আসতে পারবো কিনা জানি না। কিন্তু কোন একদিন আমাদের দেশের মানুষ মুক্ত হবে। তখন আমার আত্মা তা দেখে খুশি হবে।’ একথা বলে তিনি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু পাক সেনাবাহিনীর জিপে উঠতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। তিনি তার আটককারীদের বলেন, ‘আমি আমার পাইপ আর তামাক ফেলে এসেছি। পাইপ আমার লাগবেই।’ তার কথা শুনে সৈন্যরা থমকে যায়। এরপর তারা তাকে ঘিরে আবার বাড়িতে ফিরে এলে বেগম মুজিব সেই পাইপ আর তামাক স্বামীকে এগিয়ে দেন।

‘এরপর এসএসজির দলটি বাড়ির সবাইকে আটক করে এবং সেনাবাহিনীর জিপে চড়িয়ে সেকেন্ড ক্যাপিটালে নিয়ে আসে,’ সিদ্দিক সালিক লিখছেন, ‘এর কয়েক মিনিটের মধ্যে ওয়্যারলেসে ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর জাফরের গলার শব্দ শোনা যায়। পরিষ্কার গলায় সে জানায়: বিগ বার্ড ইন দ্যা কেজ (বড় পাখি এখন খাঁচায়)। অন্যান্য পাখিরা নীড়ে নেই, ওভার।’‘এই মেসেজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমি দেখতে পেলাম সাদা সার্ট পরিহিত বিগ বার্ডকে ক্যান্টনমেন্টের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেউ একজন জেনারেল টিক্কাকে জিজ্ঞেস করেছিল তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে চান কি না। জবাবে তিনি বলেছিলেন: আমি তার মুখ দেখতে চাই না।’‘পরে আমি মেজর বিলালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন শেখ মুজিবুর রহমানকে সেদিন একেবারে শেষ করে দেয়া হলো না। সে জবাব দিয়েছিল যে জেনারেল মিঠঠা তাকে ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়েছিল মুজিবকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে।’

সিডনি শনবার্গ লিখেছেন, ‘ক্যান্টনমেন্টে শেখ মুজিবকে রাখা হয়েছিল আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের একটি নোংরা অন্ধকার ঘরে।’ পরের দিন তাকে সরিয়ে নেয়া হয় ক্যান্টনমেন্টের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে। আটক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি বিমান পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে ১ এপ্রিল। বিমানটি করাচিতে নামার পর সেখান থেকে আরেকটি বিমানে তাকে সরিয়ে নেয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে এবং শেষ পর্যন্ত তার জায়গা হয় উত্তর পাঞ্জাবের শহর মিয়াওয়ালির কারাগারের এক প্রকোষ্ঠে যেখানে সাধারণত রাখা হতো মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের। তার বন্দিদশা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় বহু পরে। কিছু তথ্য পাওয়া যায় বিদেশি পত্রপত্রিকা থেকে। আর কিছু তথ্য পাওয়া যায় কয়েক দশক পর যখন এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও ততদিনে বেঁচে নেই। করাচির ডন পত্রিকায় ১০ অগাস্ট এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর থেকে এক প্রেসনোটের মাধ্যমে জানানো হয়েছে, এক বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচার করা হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। বিচারটি গোপনে হবে এবং এর বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে না বলে প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়। এক সপ্তাহ পর, নিউইয়র্ক টাইমস ঢাকা ডেটলাইনে এক খবর প্রকাশ করে, যেখানে জানানো হয় তার এক সপ্তাহ আগে শেখ মুজিবের গোপন বিচার শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পাক সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে মোট ১২টি অভিযোগ দায়ের করে। এর মধ্যে ছয়টি অভিযোগের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। বিচারাধীন অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে বিদেশি সরকারগুলো সে সময় জানার চেষ্টা করে। পাকিস্তানে নির্জন কারাবাসের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে কয়েকবার এক জেল থেকে অন্য জেলে সরিয়ে নেয়া হয়। মিয়াওয়ালি, ফয়সালাবাদ, সাহিওয়াল ছাড়াও রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে উত্তর পাঞ্জাবের বস্ত্রশিল্পের শহর লায়ালপুর। সেখানে এক নবনির্মিত একতলা জেলখানায় কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে ওই বিচার চলে। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে ফয়সালাবাদ জেল থেকে মিয়াওয়ালি জেলে নেয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় তার সহবন্দী রাজা আনার খানের বয়ানে। এই রাজা আনার খানকে পাকিস্তানের গোয়েন্দারা চর হিসেবে ব্যবহার করলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার এক ধরনের সখ্যতা গড়ে ওঠে।

তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘রাতে দরজায় প্রচণ্ড খটখট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি জানতে চাইলাম কে? জবাব এলো আমি খাজা তুফায়েল। জলদি দরোজা খোল। আমি বললাম, খুলতে পারবো না। নিরাপত্তার ব্যাপার।’ তিনি জানতেন তার বন্দীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। খাজা তুফায়েল ছিলেন মিয়াওয়ালি কারাগারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বললেন, ‘খুদাকে লিয়ে দরওয়াজা খোল। তোমার আর শেখ মুজিবের জীবন সংকটে।’ আনার খান বলেন, ‘আমি দরজা খুলে দিলে তিনি দ্বিতীয় চাবি দিয়ে শেখ সাহেবের সেলের লক খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তাকে ঘুম থেকে জাগাতেই তিনি কিছুটা বিচলিত হলেন।’‘খাজা সাহেব তাকে তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে নিতে বললে তিনি জিজ্ঞেস করলেন তাকে কি ফাঁসি দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’ ‘সেই সময়টাতে কারাগারে মধ্যরাতের পর কয়েদিদের ফাঁসি দেয়ার নিয়ম ছিল। তাই শেখ সাহেব ভেবেছিলেন সেজন্যেই তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেজন্যে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন তাকে কী ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু খাজা সাহেব তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ফাঁসি না, অন্য একটি কারণে তাকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।’এরপর আনার খানের সহায়তায় ওই কারা কর্মকর্তা শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত কারাগারের বাইরে নিয়ে যান এবং শহরের অন্যদিকে আরেকটি বাড়িতে নিয়ে ওঠান। এই হত্যা ষড়যন্ত্রটির কথা পরে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও স্বীকার করেছেন সিডনি শনবার্গের কাছে।
মিয়াওয়ালি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির জেলা। মিয়াওয়ালি কারাগারের বেশিরভাগ কর্মকর্তা আর বন্দি ওই জেলার লোক। তাই জেলের কিছু কর্মকর্তা কৌশলে শেখ মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তারা ১৫ ডিসেম্বর কয়েদিদের মধ্যে প্রচার করে যে পূর্ব পাকিস্তানের লড়াইয়ে জেনারেল নিয়াজি নিহত হয়েছে, আর যার জন্য এসব ঘটেছে সেই শেখ মুজিব ওই মিয়াওয়ালির ক্যাম্পেই আটক রয়েছেন। তাই কয়েদিদের বলা হলো জেলের তালা খুলে দেয়া হলে তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করতে পারবে। কিন্তু ষড়যন্ত্রটি ফাঁস হয়ে যায়। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি। লেখক- সম্পাদক, দৈনিক পথে প্রান্তরে

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ