আনিস আলমগীর \ সম্প্রতি রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে চলমান মামলায় মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে)। গত ২২ জুলাই এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, আইসিজের রায় আইনি ও পদ্ধতিগত ভিত্তিতে মিয়ানমারের চারটি প্রাথমিক আপত্তি প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে রোহিঙ্গা সঙ্কটের একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, রোহিঙ্গাদের বৈধ অধিকার পুনরুদ্ধার করে মিয়ানমারে তাদের নিজভূমে টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য একটি আস্থা তৈরির ক্ষেত্রে এ রায় কাজে আসবে। নেদারল্যান্ডসের হেগে কোর্টের প্রেসিডেন্ট জন. ই. ডোনোগুয়ে প্রায় ৫০ মিনিটের রায়ে মিয়ানমারের চারটি আপত্তি খারিজ করে দেন। এখন আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন তার মধ্যে বর্তমান রোহিঙ্গা সমস্যা একটা কঠিনতম সমস্যা। রোহিঙ্গা নিয়ে আশির দশক থেকে বাংলাদেশ সমস্যায় পড়লেও ২০১৭ সালে এসে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে এবং এখন তার ৫ম বর্ষ চলছে। সমস্যা উত্তরণে বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে সত্য, কিন্তু সেটা যে কাজে আসছে না তা এখন আরও স্পষ্ট। জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে যা বলেছেন,২০১৭ সাল থেকে তা-ই বলে আসছেন। তার কণ্ঠে উঠে এবার এসেছে হতাশার সুরও। জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের এক ভারচুয়াল বৈঠকে যোগ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘গত চার বছর ধরে আমরা এই উচ্চাশাই পোষণ করে আসছিলাম যে এসব স্থানচ্যুত লোকজন নিজেদের দেশ, তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে নিরাপদে, সুরক্ষিতভাবে সসম্মানে ফেরত যেতে পারবে। আমরা তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সমাবেশে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আস্থা রেখেছিলাম। আমাদের কথা শোনা হয়নি, আমাদের আশা অপূর্ণই থেকে গেছে।’
এখন প্রশ্ন আসতে পারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা এতদিনেও সাফল্যের বিন্দুমাত্র কিছু চোখে দেখছি না কেন? কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি বা তারা কেন এগিয়ে আসেনি? আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা নেই তো? আমার চোখে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরুতেই ভুল ছিল। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর তিন মাসের মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন সমঝোতা করেছিল বাংলাদেশ। এ সমঝোতা এত দ্রুততার সঙ্গে হয়েছে যে সমঝোতার মাধ্যমে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখিয়েছে যে সংকট সমাধানের জন্য তারা কাজ করছে, যদিও সমঝোতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি। প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চার বছরে কোনও অগ্রগতি হয়নি। বরং এ সমঝোতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় বিষয় হিসেবে আবদ্ধ করা হয়েছে। একমাত্র সান্ত্বনার বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিক পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত আছে।
টেবিলের উল্টোদিকে বসলে সবকিছু বুঝা সম্ভব হয় না। মিয়ানমার যখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তখন বাংলাদেশ সরকার খাদ্যমন্ত্রীকে মিয়ানমার পাঠিয়ে চালের ব্যবসা করে কী কূটনৈতিক প্রয়াস চালাতে চেয়েছিল তাও আমাদের কাছে বোধগম্য হয়নি। ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়ার সহমত ও সমর্থনের কারণে মিয়ানমার একটা সুরক্ষিত অবস্থানে বসে রোহিঙ্গা হত্যা ও বিতাড়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সত্য, অন্যরা তো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে ছিল। আমরা তাদেরও আমাদের কাজে লাগাতে পারিনি। মুসলিম বিশ্বও এগিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের পাশে। বিশেষ করে তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা বিতাড়নের ব্যাপারে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছিল। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সফরে আমেরিকা গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয় ছাড়াও রোহিঙ্গা বিষয়ে ট্রাম্পকে বিস্তারিত বলেছেন। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান তার স্ত্রীকে রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরজমিন দেখার জন্য বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে কেঁদেছেন। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারও সফর করেছেন। আবার ঢাকাও সফর করেছেন। মালয়েশিয়া আদালত বসিয়ে মিয়ানমারের যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারও করেছে। বাংলাদেশের উচিত ছিল অব্যাহত কূটনৈতিক যোগাযোগ সতেজ রেখে মুসলিম দেশগুলোকে সক্রিয় রাখা।
ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে খুবই সহানুভূতিশীল, তাদের সহানুভূতিকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। ঘটনার প্রায় এক বছর পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে গেছেন। ওআইসির পক্ষে গাম্বিয়া ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে যে মামলা করেছে, তারও কোনও সুফল দেখা যাচ্ছে না। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট প্রায় আট লাখ মিয়ানমারের রাষ্ট্রহারা নাগরিকরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর আগে আসা রোহিঙ্গা শরাণার্থী মিলিয়ে এখন তার সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। কোভিড-১৯-এর চ্যালেঞ্জের মুখেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দিকে দৃষ্টি রেখেছে। নিজস্ব বাজেট থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ভাসানচরের উন্নতি সাধন এবং সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ করেছে।
শরণার্থী ঢলের এক মাস পরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ৫ দফা সুপারিশ পেশ করেছিলেন। সে প্রস্তাবে তিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত জাতিসংঘের উদ্যোগে মিয়ানমারে সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে চাইলে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে মিয়ানমারের সমর্থক চীনের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা থাকায় তা বারবার পেশ করা হলে অনুমোদন পাওয়া যায়নি। চীনের সঙ্গে রাশিয়াও যোগ দিয়েছে কয়েকবার। এই ইস্যুতে বাংলাদেশ কাছে পায়নি ভারত ও জাপানের মতো বন্ধু রাষ্ট্রকেও।
মিয়ানমারে এখন সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেকছে। রোহিঙ্গাদের আদৌ পাঠানো যাবে কিনা সে সংশয় রয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার রাজি হলে বাংলাদেশ ২০১৮ সালের নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের আগস্টে দু’দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একজন রোহিঙ্গাও যেতে রাজি হয়নি। মিয়ানমারে আর কোনও নির্যাতন চালানো হবে না, এই মর্মে তারা মিয়ানমার থেকে কোনও আশ্বাস পায়নি। এখন পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে তার কোনও হদিস নেই। এরমধ্যে বিশ্বের ঘাড়ে এসেছে নতুন সমস্যা আফগানিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যদি তাদের কাছে থাকা আফগানিস্তানের সংরক্ষিত তহবিল উন্মুক্ত না করে তবে আফগান অর্থনীতি ধসে পড়বে। তালেবান শাসনে সেখানে মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যুর ওপর ফোকাস কমে যেতে থাকবে।
রোহিঙ্গা নিয়ে এর আগে যতবার সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সমাধান হয়েছে মিয়ানমারের সামরিক শাসন থাকা অবস্থাতেই। বাংলাদেশ মিয়ানমারের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে ভালোই করেছে কিন্তু সামরিক সরকারকে চাপে রাখার কোনও উদ্যোগ দৃশ্যত নেই। সারা বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নত দেশে রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা ছড়িয়ে আছে। মিয়ানমারকে চাপ দিতে বাংলাদেশ তাদের কাজে লাগাচ্ছে না। শুধু তা-ই না, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কোনও নেতৃত্বকেও স্বীকৃতি দিচ্ছে না, যাদের সারা বিশ্বে জনমত সৃষ্টিতে পাঠানো যেতে পারে। বিশ্ব রাজনীতিতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র এখন মুখোমুখি। উত্তর কোরিয়াকে সামাল দেওয়ার জন্য আমেরিকা বারবার চীনকে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু চীন আমেরিকার সেই অনুরোধ আমলে নেয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে চীন তার ভূ-রাজনীতির স্বার্থে মিয়ানমারে আরেক কিম ইল সাংয়ের জন্ম দিচ্ছে। সুতরাং আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বোধোদয় হওয়া স্বাভাবিক। জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনে মিয়ানমারের জান্তার কোনও প্রতিনিধি আমন্ত্রণ পায়নি। এই জান্তা সরকারের ওপরও বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু চীন ও ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকলে রোহিঙ্গাদের এই মাটি থেকে কখনও সরানো যাবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।