Search
Close this search box.
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা

বিএনপি-জামাত রাজনীতিতে বিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়

বিএনপি-জামাত রাজনীতিতে বিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়

অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান

আজ রক্তাক্ত বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ আগস্ট একটি নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। একটি নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার ১৮তম বার্ষিকী। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এই দিনে রাজধানী ঢাকার বুকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশে চালানো হয় নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হিংসার দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে। আক্রান্ত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। হামলার ধরন ও লক্ষ্যস্থল থেকে এটা স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনাকে হত্যা করাই ছিল ওই গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণের উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় আয়োজিত সমাবেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এসে সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই ঘটনায় দলীয় নেতাকর্মীরা মানববর্ম রচনা করে সভাপতি শেখ হাসিনাকে রক্ষা করলেও গ্রেনেডের আঘাতে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। গ্রেনেড হামলার বিচারের রায়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি জোট সরকারের মন্ত্রী ও তৎকালীন সরকারের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততায় প্রমাণ মেলে ওই সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই হামলাটি পরিচালিত হয়েছিল।

তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। সেদিন ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ শান্তি মিছিলের আয়োজন করেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিলের আগে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে স্থাপিত অস্থায়ী ট্রাকমঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরপরই তাকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহুর্মুহু ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণের বীভৎসতায় মুহূর্তেই মানুষের রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে। স্পিøন্টারের আঘাতে মানুষের হাত-পাসহ বিভিন্ন অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় রক্তাক্ত নিথর দেহ। লাশ আর রক্তে ভেসে যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর সামনের পিচঢালা পথ। নিহত-আহতদের জুতা-স্যান্ডেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভেসে আসে শত শত মানুষের গগনবিদারী আর্তচিৎকার। বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টারত মুমূর্ষুদের কাতর-আর্তনাদসহ অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। সেদিন রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালে আহতদের তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ভাগ্যগুণে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও শেখ হাসিনার দুই কানের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্য শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন দেখে তার গাড়ি লক্ষ্য করে ১২ রাউন্ড গুলি করা হয়। তবে টার্গেট করা গুলি ভেদ করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ। হামলার পরপরই শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার তৎকালীন বাসভবন ধানমন্ডির সুধা সদনে। ২১ আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। গ্রেনেডের স্পিøন্টারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ আরও কয়েকজন পরাজিত হন। এই আর্জেস গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে ।

হামলায় আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়ে শরীরে স্পিøন্টার নিয়ে আজও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আহত হয়েছিলেন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা। এখনও অনেক নেতাকর্মী সেদিনের সেই গ্রেনেডের স্প্রিন্টারের মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। অনেক নেতাকর্মীকে তৎক্ষণাৎ দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করালেও তারা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি।

এদিকে গ্রেনেড হামলার পর ভয়, শঙ্কা ও ত্রাস গ্রাস করে ফেলে গোটা রাজধানীকে। এই গণহত্যার উত্তেজনা ও শোক ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলের ওপর বেধড়ক লাঠি-টিয়ার শেল চার্জ করে। একইসঙ্গে নষ্ট করা হয় সেই রোমহর্ষক ঘটনার যাবতীয় আলামত। আহত মূমুর্ষ রোগীদের চিকিৎসা ব্যহত করার জন্য বিএনপি-জামাত সমর্থিত চিকিৎসকরা পেশার অমানবিকতম উদাহরন সৃষ্টি করে সেদিন হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায় । পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ মদতে ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে ও ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিতসহ হেন কোনও কাজ নেই, যা করেনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এমনকি সংসদে দাঁড়িয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভেনিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলেন খোদ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই।

বিচার প্রক্রিয়া : ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মামলার বিচার শুরু হয়। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারে এসে এর অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপির নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর দুই অভিযোগপত্রের মোট ৫২ আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়। আদালত দুটি মামলার রায়ে জীবিত ৪৯ জন আসামির মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। বাকি ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন। যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া এই ১৯ আসামির মধ্যে ১৩ জনই পলাতক। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।
এ হামলার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা এবং শেখ হাসিনাকে হত্যাসহ বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করে হত্যা, ষড়যন্ত্র, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দুঃশাসনকে চিরস্থায়ী করা। ভয়াবহ ও নৃশংস ওই হামলার যেন বিচার না হয় এবং আসল আসামিরা ধরা না পরে সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো দেশে-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র চলছে । একটি রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করতে এরূপ নারকীয় হামলার ঘটনা পৃথিবীতে আর হয়নি। আমাদের একটু গভীরভাবে ভাবতে হবে যদি সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যা করার তাদের লক্ষ্য পুরণ হতো তাহলে আজকে বাংলাদেশের কি অবস্থা হত ? নির্দ্বিধায় বলা যায়, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো একটি মৌলবাদী, জঙ্গি, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত হতো ।

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কালো অধ্যায়। বিশ্বে গণতন্ত্র চর্চাকারী যে কোনও রাষ্ট্রে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এ ধরনের বর্বর হামলার নজির বিরল। তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রধানসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের হত্যার উদ্দেশে পরিচালিত ওই ন্যাক্কারজনক ঘটনা দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের স্থায়ী ‘অবিশ্বাসের’ জন্ম দিয়েছে। আর এই ক্ষত নষ্ট করে দিয়েছে রাজনীতির পারস্পরিক ন্যূনতম বোঝাপড়ার জায়গাটিও। মতপার্থক্য থাকলেও দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে আগে যে ধরনের সমঝোতার সম্পর্ক চলে আসছিল ২১ আগস্টের নৃশংস ঘটনার পর তা দৃশ্যত আর অবশিষ্ট নেই। বরং ঘটনার পরম্পরায় অবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ২১ আগস্ট পৈশাচিক গ্রেনেড হামলার পর দেশের আপামর জনতা, রাজনৈতিক কর্মী, সচেতন পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিক কর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ এর জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃতে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি বিএনপি-জামাত জোটকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহন করে ।

এহেন নৃশংস ঘটনার সকল দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে । তাই, দেশের গনতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে ১৮তম একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার এই দিনে আমাদের প্রত্যাশা-

১) ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক আদালতের রায় বিষয়ে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি উচ্চ আদালতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হবে এবং বিচারিক আদালত আসামিদের যে সাজার রায় প্রদান করেছেন তা যেন বহাল থাকে ।

২) ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত সকল ব্যাক্তির চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে । ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটে অনুমোদিত বিধির মাধ্যমে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে । আশা করি এ ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে ।
একাত্তরের গনহত্যা, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার প্রচেষ্টা একই সুত্রে গাঁথা । সকল হত্যাকান্ডের পেছনে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্র । বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, হচ্ছে, হবে । আমদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও প্রগতির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আওয়ামী লীগসহ সকল প্রগতিশীল শক্তিকে সজাগ থাকতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে যা এখন আবার সময়ের দাবী । অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমদের এই স্বাধীন দেশে আমরা আর কোন ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টের মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাত দেখতে চাইনা । এজন্য জরুরিভাবে এখন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করে এসবের পেছনের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করে চিরতরে বাংলার মাটিতে সকল ষড়যন্ত্রের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে ।

লেখক- সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ