Search
Close this search box.
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা

শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিলো লক্ষ্য – অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান

শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিলো লক্ষ্য - অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান

আজ থেকে ১৮ বছর আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রচিত হয় কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। দিনটি ছিলো ২১ অগাস্ট, শনিবার দুপুরবেলা। হঠাৎ গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। তারপর ছিন্নভিন্ন মরদেহ, আহতদের আর্তনাদ, রক্তাক্ত নেতা-কর্মীদের ছুটোছুটিতে সেদিন ওই এলাকা হয়ে উঠেছিল বিভীষিকাময়। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ওই গ্রেনেড হামলা ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত। নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞ ও অপরাধ কর্মকাণ্ডের পেছনে ঘাতকদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আসলে কী ছিলো- এসব প্রসঙ্গে দৈনিক পথেপ্রান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধবজ্ঞিান সোসাইটির পরিচালক, বাংলাদেশ সোসাইটি অব ক্রিমিনোলজির সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন-শাহনাজ পারভীন এলিস

শাহনাজ পারভীন এলিস: ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে আপনি কীভাবে ব্যাখা করবেন?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ইতিহাসের ঘৃণিত একটি হত্যাকাণ্ড; যা খুবই দু:খজনক। কারণ এই গ্রেনেড হামলার আগে বাংলাদেশে যত সন্ত্রাসী হামলা বা জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আঘাত করা। সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী বা পুরোহিত-যাজককে হত্যা করে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা তাদের শত্রু মনে করে। কিন্তু ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, তার উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যা করা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা।

শাহনাজ পারভীন এলিস: ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যে হত্যার ঘটনা তার সঙ্গে এর কোন যোগসূত্র রয়েছে কী?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: অবশ্যই যোগসূত্র রয়েছে। ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনিবার্যভাবে ওই গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। ১৫ আগস্টে শেখ হাসিনা এবং তার ছোটবোন বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুকে যে চক্রটি সপরিবারে হত্যা করেছে, সেই একই শক্তি বা রাজনৈতিক ফোর্স এ ঘটনার সাথে জড়িত তা মামলার তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে।

শাহনাজ পারভীন এলিস: দেশের সর্ববৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশে এ ধরনের নাশকতা ও হত্যাযজ্ঞের পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিলো বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি যে চক্রটি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের যে মিশন পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি, তার জন্য বরাবরই তারা মরিয়া ছিলো। ষড়যন্ত্রের পথ থেকে তারা কখনো একচুলও সওে যায়নি। তাই শুধু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নয়, ওই ঘাতক চত্রু এর আগেও অনেকবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। কারণ তারা চেয়েছে শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ভেঙ্গে দিয়ে দলটিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে। তারা জানতো শেখ হাসিনাকে শেষ করতে পারলে আওয়ামী লীগকে বধ্ করা যাবে। ওইসব হামলায় বরাবরই ঘাতকদের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

শাহনাজ পারভীন এলিস: ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার দায় কী সেসময় ক্ষমতায় থাকা তৎকালীন চারদলীয় জোট এড়াতে পারে?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: আমি মনে করি, ওই হামলার দায় তারা কখনো এড়াতে পারে না। এছাড়া বিশ্লেষণও বলছে, ২০০৪ সালে এই গ্রেনেড হামলা যখন ঘটে, তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল। হামলায় সে সময়কার রাষ্ট্রীয় শক্তি যে ব্যবহার করা হয়েছিলো তা প্রমাণিত সত্য। গ্রেনেড হামলার আগেও তাদের আমলে আরও অনেক জঙ্গি হামলা হয়েছে। তবে সেসব ঘটনায় বিএনপির সম্পৃক্ততার অভিযোগ কেউ করেনি। অথচ ২১ আগস্টের হামলায় দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠাটাই স্বাভাবিক। কারণ ওই হামলা মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্যে বিএনপির একাধিক নেতা-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিএনপি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সেসব খণ্ডন করা হয়নি। অনেক প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি।

শাহনাজ পারভীন এলিস: গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন সরকারের অবস্থান সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটি আওয়ামী লীগের কাজ। আওয়ামী লীগ জনগণের সহানুভূতি পেতেই নাকি এ হামলা চালিয়েছে। পরবর্তীকালে নানা তথ্য-উপাত্ত এবং আক্রমণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে হুজি বি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানই এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে শেষ করে দিতে ঘৃণ্য এ পথ বেছে নিয়েছিলেন। এর আগেও মুফতি হান্নান ও তার সংগঠন হুজি বি একাধিকবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

শাহনাজ পারভীন এলিস: মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ার সময় এতো নাটকীয়তার কারণ কী?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: ক্ষমতাসীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সেসময় ওই হামলার সুষ্ঠু তদন্ত না করে সরাসরি দায় চাপায় আওয়ামী লীগের ওপর। এর ফলেই শুরু হয় নানা নাটকীয়তা। সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, প্রশাসন, গোয়েন্দা- সবাই একই সুরে কথা বলে। এমনকি বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশন দাবি করে বসল, এ হামলার পেছনে কোন জঙ্গিগোষ্ঠী নেই। সীমান্তের ওপারের শক্তিশালী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সেখানে পলাতক সন্ত্রাসীদের দিয়ে এ হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। নির্বাহী বিভাগের তদন্তের প্রতি মানুষের আস্থা কম বলেই বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে। আর বিচারপতি জয়নুল আবেদিন সেই বিচার বিভাগীয় তদন্তের নামে যা করেছেন, তা কেবল হাস্যকর নয়, লজ্জাজনকও বটে।

শাহনাজ পারভীন এলিস: তদন্ত চলাকালে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: ২১ আগষ্টের হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা ধামাচাপা দিতে ক্ষমতাসীনরা সব ধরনের চেষ্টা চালালেন। কী করলেন তারা? জজ মিয়া নাটক সাজালেন। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে দরিদ্র জজ মিয়াকে বলা হয়েছে, ‘যদি সে তাদের শিখিয়ে দেওয়া কথা বলে, তাহলে মাসে মাসে টাকা পাবে। আর এর অন্যথা হলে ক্রসফায়ার।’ পুলিশ প্রশাসন কয়েক বছর সেই টাকা তাকে দিয়েছেও। ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস হয়। সেসময় জজ মিয়ার মা জোবেদা গণমাধ্যমকে জানান, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। এসব তথ্যই প্রমাণ করে, ওই গ্রেনেড হামলার দায় তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট কখনো এড়াতে পারে না।

শাহনাজ পারভীন এলিস: তদন্তে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পরও বিএনপির অনেক নেতার দায়সাড়া মন্তব্যেও কারণ কী হতে পারে?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: আমি বলবো সেটা তাদের রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থান। সেই সরকার কেবল অপরাধীদের বাঁচাতেই নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেয়নি, প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীসহ সরকার ও প্রশাসনের অনেকেই এ তৎপরতায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন। বিএনপির নেতারা এখনও বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তাদের দলের অমুক নেতাকে জড়ানো হয়েছে। তাই যদি হবে, তাহলে গ্রেনেড হামলার পরও তারা দু’বছর সময় পেয়েছিলেন। অথচ মামলার তদন্তকাজ শেষ করলেন না কেন? কেন তারা জজ মিয়া কাহিনী সাজালেন?জঙ্গিদের পাকড়াও না করে দেশ থেকে পালানোর সুযোগ করে দিলেন? ওই মামলার তদন্ত তারা যেভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছিলেন, তাতে এ ধারণা অমূলক নয় যে তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের একাংশ এর পেছনে ছিল। প্রকৃত হামলাকারীদের বাঁচাতে কেন বিএনপি আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছিল, কেন জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান ও মাওলানা তাজউদ্দিনকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল- সে প্রশ্নের জবাব তাদেরই দিতে হবে।

শাহনাজ পারভীন এলিস: গ্রেনেড হামলার পেছনের কুশীলব আসলে কারা ছিলো?
অধ্যাপক জিয়া রহমান: ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পেছনে ছিলো প্রভাবশালী রাজনৈতিক দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি এবং পাকিস্তান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে মতোই ছিলো গ্রেনেড হামলার নীল নকশা; যার মাস্টার মাইন্ড ছিলেন ঐ সময়ের কিছু সামরিক কর্মকর্তা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জানা গেছে, হামলায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের পাকিস্তানে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। পরে তাদের গ্রেনেডও সরবরাহ করে পাকিস্তান। হামলা শেষে পাকিস্তান অনেক ঘাতককে আশ্রয়ও দেয়।

শাহনাজ পারভীন এলিস: শত ব্যস্ততার মাঝে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক জিয়া রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ। পাশাপাশি দৈনিক পথেপ্রান্তরেরপুরো টিমের জন্য শুভকামনা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ