Search
Close this search box.

শিক্ষা নিয়ে ভাবনা-দুর্ভাবনা ও নতুন অফিস টাইম

বিভুরঞ্জন সরকার

শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে বলতেই হবে যে আমাদের জাতির মেরুদণ্ড ভালো নেই। এক সময় বলা হতো, বৃটিশরা ভারতবর্ষে কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল। কিন্তু বিদায় হওয়ার পর আমরা দুটি দেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। প্রথমে পাকিস্তান। তারপর রক্তের দামে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন।

বৃটিশের শিক্ষা যদি কেরানি তৈরির হয়ে থাকে তাহলে এখনকার শিক্ষাকে কি বলা হবে? বর্তমান দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে, তা কি মানুষ গড়ছে? পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার সরকার পর্যন্ত কত শিক্ষা কমিশন হলো কত শিক্ষা নীতি হলো, সেগুলোর পক্ষে বিপক্ষে আন্দোলন হলো, গণবিরোধী শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রদের রক্তও দিতে হয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক একমুখী শিক্ষা চেয়ে শেষপর্যন্ত আমরা যে শিক্ষা নীতি পেয়েছি, তা না একমুখী, না প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানভিত্তিক। কেতাবে নীতির কথা যা লেখা আছে, বাস্তবে তা-ও আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। বুধবার থেকে সকাল ৮ থেকে দুপুর ৩ টা পর্যন্ত অফিস চলবে। ব্যাংকের সময়সূচি ৯টা থেকে ৪টা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুদিন ছুটি। আমাদের সরকারি অফিসগুলো ওয়ার্ককালচার বা কর্মসংস্কৃতি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা অজুহাতে কাজে ফাঁকি দিতে পছন্দ করেন। অফিসের সময়সূচি বদলের চেয়ে বেশি প্রয়োজন কাজে মনোযোগী হওয়া। আমাদের দেশের ট্রেনের সময়সূচি নিয়ে কৌতুক আছে। বলা হয়, ১০টার ট্রেন কয়টায় আসে?

আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে, উচ্চশিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। একসময় মেয়েরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকলেও এখন আর খুব পিছিয়ে নেই। সংখ্যায় হয়তো সমতা পুরোপুরি না হলেও কাছাকাছি আসা গেছে। উচ্চশিক্ষায় হয়তো মেয়েদের সংখ্যা এখনও সাম্যের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু এসবই তো বাইরের। দেশে সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম নেই। স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বাড়ছে। কোথাও কোথাও অপরিকল্পিতভাবেও বাড়ছে। শিক্ষার মান বাড়ছে না। শিক্ষা লাভ করে মানুষ কুসংস্কার মুক্ত হতে পারছে না। উদারতার শিক্ষা নয়, সংকীর্ণতা ও বিভক্তির শিক্ষারই যেন বিস্তার ঘটছে।

আমি শিক্ষা নিয়ে মতামত দেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি নই। তারপরও এই লেখাটি লিখছি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত আমার কিছু পরিচিত সহৃদ-সুজনের অনুরোধে। তারা মনে করেন গোড়ায় গলদ রেখে কাজ করলে ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে এখন সমস্যা বহুমুখী। একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষ পর্যন্ত গলদ কোথায় নেই? শিক্ষকদের মধ্যে যারা আন্তরিক, যারা সীমিত সুযোগেরও সদ্ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ভেতরে আলো ছড়াতে চান, তাদের জীবন যদি হয় সমস্যা সংকুল, তাহলে তারা শিক্ষার্থীদের কি পাঠদান করবেন? নিজের ও পরিবারের জন্য সম্মানজনক একটি বেতন-ভাতা না পেলে একজন শিক্ষক কীভাবে উন্নত জীবনের পাঠদানে উৎসাহ পাবেন? প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন ভাতা কোনোভাবেই সম্মানজনক বলা যাবে না। আলোচনা লম্বা না করে কয়েকটি প্রস্তাব এখানে উল্লেখ করছি। এগুলো মেনে চললে

কিছু সুবাতাস বইলেও বইতে পারে। প্রস্তাবসমূহ :
১. সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১২তম গ্রেড ও প্রধান শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দান
২. চাকরিকাল ৩ বছর হলেই বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে কলেজ বা পিটিআই পর্যন্ত প্রমোশন (প্রাইমারি>হাইস্কুল>কলেজ/পিটিআই) অথবা প্রশাসনে প্রধান শিক্ষক>এটিও> টিও>।

সিনিয়র হোক, জুনিয়র হোক- বিভাগীয় পরীক্ষায় টিকলেই প্রমোশন নিশ্চিত করতে হবে।
৩. ৩ বছর পর পর অনলাইনে কম্পিউটারে লটারির মাধ্যমে সবার জন্য বাধ্যতামূলক ট্রান্সফার।
৪. শুক্র-শনি ২ দিন ছুটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুই দিন ছুটির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে শুধু বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে, তাই নয়, ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী সবারই মানসিক অবসাদ দূরে ভূমিকা রাখবে।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সময়সূচি সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত করা (হাইস্কুল ও কলেজে ২টা/আড়াইটা পর্যন্ত)।
৬. প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবস্থা করা।
৭. শিক্ষকদের ল্যাপটপ কেনার জন্য বিনাসুদে ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া।
৮. শ্রান্তিবিনোদনসহ সব আর্থিক ভাতা ও পাওনাদি অনলাইনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৯. প্রতিষ্ঠানের ভেতরে-বাইরে ওয়াশরুম ব্যতীত সব কক্ষ, শিক্ষক মিলনায়তন সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হলে নারী-পুরুষ সবাই একসঙ্গে বসলেও অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না। তাছাড়া ছোট-বড় অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই মতো প্রধান শিক্ষকদের কক্ষ আলাদা করা।
১০. স্থানীয় লোকজন দিয়ে গঠিত কমিটিগুলো বিলুপ্ত করে ইউএনও, কমিশনার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, এসপি/ওসি দ্বারা কমিটি গঠন।
১১. পড়াশোনা ছাড়া শিক্ষকদের দিয়ে সব রকম জরিপ করানো বন্ধ করা।
১২. শিক্ষা অফিসগুলোকেও সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা।
১৩. শিক্ষকদের দিয়ে অফিসের কোনো কাজ না করানো।
১৪. প্রাক-প্রাথমিকের পদগুলো উঠিয়ে দেওয়া। অথবা আড়াই ঘন্টা ব্যাপী একজনকে দিয়ে টানা ক্লাস করিয়ে তাকে দিয়ে আবার অন্যান্য ক্লাসও না করানো। অথবা প্রাকের ক্লাসটি প্রতিদিন ৪৫ মিনিট করা।
১৫. আগামী বছর থেকে ৫ বছরের নিচে শিশু ভর্তি করা হবে। সে জন্য তাদের জন্য আয়া নিয়োগ দেওয়া।
১৬. ছাত্র ভর্তি এবং অফিশিয়াল কার্যক্রমের জন্য অফিস সহকারী নিয়োগ দান করা।
১৭. হঠাৎ দুর্ঘটনায় পতিত বা অসুস্থ কোনো শিক্ষককে ভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বা শিক্ষা অফিসে সমগ্রেডে ডেপুটেশনের সুযোগ দেওয়া। যাতে তিনি তার পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে পারেন।
১৮. একই কারণে গুরুতর দুর্ঘটনা বা অসুস্থতায় যদি কোনো শিক্ষক চাকরি করতে একেবারেই অক্ষম হন, তাহলে পোষ্য কোটায় তাদের সাবালক ছেলে-মেয়েদের তার জায়গায় পদায়ন করা।

প্রস্তাবগুলো সবই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের সুযোগসুবিধা নিয়ে। মনে রাখতে হবে শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকরাই মূল শক্তি। তারা যদি জীবন-জীবিকা নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন, তাহলে শিক্ষা দেবেন কীভাবে।

এবার আরও কিছু বিষয়ে পরামর্শ :
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও তদারকির জন্য প্রতিটি স্কুলে এটিও নিয়োগ করা (ক্যান্ট পাবলিকগুলোতে যেমন প্রিন্সিপাল হন- আর্মি পার্সনরা। সেটা এডুকেশন বা নন-এডুকেশন কোর থেকে)। ফলে সেখানে শৃঙ্খলা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা ভালো থাকে। একইভাবে প্রতিটি হাইস্কুল এবং কলেজের জন্যও ব্যবস্থাপক বা তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেওয়া।
★ শিক্ষক হাজিরায় সারা বাংলাদেশে বায়োমেট্রিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট চালু করা।
★ স্কুলগুলোতে সরাসরি ভবন সংস্কার, শিক্ষা উপকরণ ক্রয় বা অন্যান্য খাতে নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য ব্যয় বরাদ্দ বন্ধ করা।
★ শিক্ষকদের জন্য দরখাস্ত ও লেখার জন্য কাগজ, কলম ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম পরিচালনার জন্য ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করা।
★ শিক্ষার্থীদের ওপর বইয়ের বোঝা কমানো। প্রাথমিক পর্যন্ত ৬টির বেশি পাঠ্যপুস্তক না রাখা।
★ জাতীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে ব্যবসা, সমিতি বা যে কোনো রকম অর্থনৈতিক লেনদেন অবৈধ ও নিষিদ্ধ করা।
★ অসাম্প্রদায়িকতার চর্চায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের লিয়াজোর মাধ্যমে উদীচী, ছায়ানট, সুরের ধারা ইত্যাদি সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় স্কুলগুলোতে নিয়ম করে শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক চর্চায় অংশ গ্রহণ করানো।
এটিও প্রতি বৃহস্পতিবার গণ সংগঠনগুলোকে দিয়ে খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক চর্চায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরসহ অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলকভাবে নিশ্চিত করবেন।

প্রতি মাসে প্রতিটি স্কুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে মঞ্চ ও থিয়েটারগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নেবে। ডিসি/এসপি/ইউএনও/চেয়ারম্যান/এমপি প্রধান অতিথি হবেন।
★ প্রতিটি স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য লাইব্রেরি করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রতিটি ক্লাসরুমকে লাইব্রেরির আদলে সাজানো।
★ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবার জন্য ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক।
★ সকল শিক্ষককে রোটেশনের মাধ্যমে সকল বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া।
★ শিক্ষক ও অফিসারের জন্য স্কুলে কোয়ার্টার বা হোস্টেল নির্মাণ।
★ সকল শিক্ষকদের বদলি, ভাতা, প্রশিক্ষণ, প্রমোশন, ডেপুটেশন ইত্যাদিতে কোনো প্রকারের অবৈধ লেনদেন যেন না হয়, সে জন্য সবকিছু অনলাইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করা এবং সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তদারকি ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখা।
★ প্রতি বছরে অন্তত একবার প্রাথমিক শিক্ষক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের কমচারীদের দিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন এবং সিলেবাস প্রণয়ণে গণশুনানি করা।
★ প্রতিটি প্রাথমিক স্কুলে অন্তত ১টি কারিগরি ট্রেডের পদ রাখা। ৩য় শ্রেণি থেকে তাদের উপযোগী একটি ট্রেডের উপর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং মেলায় শোকেসিং করা। মাসে বাধ্যতামূলক ভাবে একবার। যেমন- খেলনা তৈরি, গবাদি পশুর খাবার প্রস্তুতি, ঝুড়ি বানানো, ফুল-লতা-পাতা দিয়ে গৃহ সজ্জার উপকরণ বানানো, বাড়ির বা রান্নাঘর বা স্কুলের ফেলে দেওয়া বর্জ্য দিয়ে সার বানানো, উন্নত মাটির চুলা তৈরি, পরিবারের সদস্যের মাথার চুল সংগ্রহ, মোমবাতি- সাবান বানানো ইত্যাদি।
★ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা ও শেখা বাধ্যতামূলক করা।
★ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ঠিক করা। তার বেশি ভর্তি না করা।
★ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা, যৌন নির্যাতন রোধ, বাল্য বিবাহ ও যৌতুকের অপরাধ, ইভটিজিং, বুলিং, যৌন সচেতনতা, টয়লেট প্রশিক্ষণ, মেয়ে শিশুদের মাসিকের সময় করণীয় ইত্যাদি প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা।

এই পরামর্শগুলো কয়েকজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারেন। সব কিছু ভেঙে পড়ার আগেই সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়াই ভালো।

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের নামে অফিস টাইম বদলে টেবিলে ফাইলের স্তুপ জমিয়ে ফেললে চলবে না। লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার অবস্থা যেন না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ