ড. মিল্টন বিশ্বাস
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হয়ে যারা দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলেছেন তাদের অন্যতম ড. এ কে আব্দুল মোমেন (জন্ম ১৯৪৭-)। তিনি ২০১৯ সাল থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি পরিচিত একজন মেধাবী, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল, সজ্জন ও কর্মপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। উপরন্তু মন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে, বলা যায় আশির দশক থেকেই তিনি একজন কলাম লেখক। অবশ্য তার বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল কিংবা আওয়ামী লীগের দলীয় ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।
ইতোমধ্যে নানা সময়ের নানা ঘটনাজারিত লেখা নিয়ে এ কে আব্দুল মোমেনের একাধিক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আমাদের অর্থে আমাদের পদ্মা সেতু’ (২০২২) পাঠকসমাজে নন্দিত হয়েছে। ড. এ কে আব্দুল মোমেন কেবল মন্ত্রী কিংবা লেখক নন, তিনি অনেক পরিচয়ে গৌরবান্বিত। তিনি সংগঠক, সম্পাদক, গবেষক, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রদূত, প্রশাসক, অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদ। প্রধানত তিনটা কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। একটা হলো করোনা মহামারি। দ্বিতীয়ত হলো যুদ্ধ। আর তিন নম্বর হলো যুদ্ধের ফলে চেপে বসা বিভিন্ন রকম নিষেধাজ্ঞা ফলে আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। ফলে সব দেশেই অর্থনীতি একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে। বাংলাদেশের অবস্থাও আগের তুলনায় কিছুটা খারাপ।
তিনি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি। দীর্ঘ সাড়ে ৩৭ বছর বিদেশে বসবাস করে এবং ২০১৫ সাল থেকে ছয় বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন শেষে দেশে ফিরে স্থায়ীভাবে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন। তিনি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সাল থেকে তিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদের অন্যতম একজন সদস্য। তার মতো মেধা, অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের খুব কম মানুষেরই আছে। এজন্য তাকে নিয়ে কুচক্রী মহলের নিন্দাবাদ প্রচারের অপতৎপরতা থাকাটা স্বাভাবিক। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যসঞ্জাত দুটি ইস্যু নিয়ে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে সরব হয়েছে বিভিন্ন পক্ষ। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তিলকে তাল করে প্রচার করছে তারা। দুটি ইস্যুর একটি হলো- ‘বেহেশত ইস্যু’। তারা প্রচার করছেন যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে’। আরেকটি হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ভারতের সাহায্য চেয়েছেন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে’।
এই দুটো বক্তব্যই একেবারে বানোয়াট এবং বিকৃতভাবে প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে উদ্দেশ্যে, যেভাবে কথাগুলো বলেছেন, তার ধারেকাছেও না গিয়ে তার খণ্ডিত বক্তব্য নিয়ে নেহায়েত অসৎ উদ্দেশে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন অত্যন্ত দক্ষ কূটনৈতিক। শেখ হাসিনার নির্দেশনায় তার নির্ভুল পদচারণায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে উজ্জ্বল অবস্থানে রয়েছে। ফলে তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়েই কুচক্রী মহল অত্যন্ত জঘন্যভাবে নিন্দাবাদ প্রচার করছে, যা খুবই দুঃখজনক। উল্লেখ্য, ১২ আগস্ট (২০২২) সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণবিষয়ক এক মতবিনিময় সভা শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। আমরা সুখে আছি, বেহেশতে আছি। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, একটি পক্ষ এমন প্যানিক ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এটার কোনো ভিত্তি নেই।’
অন্যদিকে ২২ আগস্ট (২০২২) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমী উদযাপনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কয়েকটি প্রশ্নের জবাব চেয়েছিলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সম্প্রতি ভারত সফরের সময় দেশটির সরকারের কাছে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়টি তুলে ধরেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই সফরে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আলাপ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুয়াহাটিতে গিয়েছিলেন (২৮-২৯ মে, ২০২২)। সেখানে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ হওয়ায় আসামে স্থিতিশীলতা এসেছে ও অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সরকারকে বলেছিলেন, ‘দুই দেশের মঙ্গল ও উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।’
কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করে যাতে দুই দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ভারতে সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দিলে এটা বাংলাদেশেও আঘাত হানে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রতীক। তিনি থাকলে অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে।সুতরাং তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, তা করা হবে। বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের সহায়তা চেয়েছিলেন। ২৫ আগস্ট নয়াদিল্লিতে সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচির কাছে ড. মোমেনের বক্তব্য নিয়ে সাংবাদিকরা ভারতের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জবাবে তিনি বলেন, ‘এ সংক্রান্ত মিডিয়া রিপোর্ট তিনি দেখেছেন। মন্ত্রী (মোমেন) ঠিক কী বলেছেন, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছে।’ অর্থাৎ বিষয়টি মিডিয়ায় বিকৃতভাবে প্রচারিত হয়েছে- ভারত এ সম্পর্কে অবগত। কারণ তারাও জানে ওই বক্তব্য নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তিলকে তাল করা হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনগণের কাছে পরিষ্কার করেছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার নিজের বক্তব্যের। আশ্চর্য হলো ২১ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের অতিউৎসাহী এক আইনজীবী। এহেন হাস্যকর ঘটনা চলছে দায়িত্বশীল মন্ত্রী মহোদয়কে হেয়প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে। বৃহত্তর সিলেট এলাকায় ভালো জিনিস বোঝাতে যখন-তখন ‘বেহেশতে’র উপমা দেওয়া হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেটের স্থায়ী বাসিন্দা বলে এমন উপমা দিয়েছিলেন। ১২ আগস্ট তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, তুলনামূলকভাবে আমরা অনেক ভালো আছি। আমাদের মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। অথচ অনেক দেশেই মুদ্রাস্ফীতির হার অনেক বেশি। যেমন আমেরিকা- যেখানে ২-৩ শতাংশের বেশি কখনো মুদ্রাস্ফীতি হয় না, সেখানে এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। ইংল্যান্ডের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানকার মানুষ খুব কষ্টে আছে। তুরস্কের মতো একটা বড় অর্থনীতির দেশেও প্রায় ৭৩ শতাংশের মতো মুদ্রাস্ফীতি। ইরানের মুদ্রাস্ফীতি ৩৯ শতাংশ। আর্জেন্টিনায় ৫৮ শতাংশ। পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতি ৩৭ শতাংশ। সেখানে আমাদের মাত্র ৭ শতাংশ। ওইসব দেশের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সব দেশেই অর্থনীতির অবস্থা নাজুক।
প্রধানত তিনটা কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। একটা হলো করোনা মহামারি। দ্বিতীয়ত হলো যুদ্ধ। আর তিন নম্বর হলো যুদ্ধের ফলে চেপে বসা বিভিন্ন রকম নিষেধাজ্ঞা যার ফলে আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। ফলে সব দেশেই অর্থনীতি একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে। বাংলাদেশের অবস্থাও আগের তুলনায় কিছুটা খারাপ। কিন্তু অন্যান্য দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা বিবেচনায় আমরা এখনো বহু দিক থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছি। কোভিডের সময়ও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ অনেক দিক থেকে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মূলত সেই কথাটাই বলতে চেয়েছেন। ‘বেহেশত’ শব্দটি ‘ভালো অবস্থা’কে বর্ণনার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে বলেই এদেশের অর্থনৈতিক সূচকের স্থিতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সামনে আনা হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ নানারকম সমস্যায় জর্জরিত। বিভিন্নরকম সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী গ্রুপ দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। আফগানিস্তানে মসজিদে-মসজিদে হামলা করে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা।
আমেরিকায় স্কুলের বাচ্চাদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণের সংবাদ কারও অজানা নয়। বাচ্চারা বাড়ি থেকে স্কুলে গিয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফিরছে। যখন-তখন শপিংমলে হামলা ও গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে নিরীহ মানুষ। বাংলাদেশে আমরা এসব থেকে অনেক ভালো অবস্থানে আছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, ‘আপনারা বলতে পারেন ওদের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি।’ এই হলো ‘বেহেশতে’র ঘটনা। একেবারেই একটি সাধারণ কথাকে টেনেহিঁচড়ে যে যেভাবে পারছেন মন্ত্রী মহোদয়কে তুলোধুনা করছেন। কেউ বুঝে আর কেউ না বুঝে সমালোচনা করছেন, এটা তাদের দৈন্য ছাড়া আর কিছু নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা প্রসঙ্গে অন্য দেশের সাথে তুলনা করতে গিয়ে ‘কথার কথা’ হিসেবে শুধু যে বেহেশতের কথা বলেছেন, তা নয়। এর সাথে তিনি আরও বলেছেন, আমাদের দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, সরকার চাচ্ছে কীভাবে এ মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কারণ শেখ হাসিনার সরকার গরিবের বন্ধু সরকার। এ সরকারের কাছে জনগণের কল্যাণ সবার আগে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। এ কারণে সরকার সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে ব্যয় সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আমাদের অবস্থা খারাপ। বাংলাদেশে সাশ্রয়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে পূর্ব সতর্কতা হিসেবে। সংকট আরও গভীর হলেও আমরা যেন তা মোকাবিলা করতে পারি।
শেখ হাসিনার সরকার সব সময় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পণ্যসামগ্রীর দাম রাখতে সচেষ্ট। পণ্যসামগ্রীর দাম যেন আরও কমে, সস্তায় যেন মানুষ চাল, ডাল, তরিতরকারি কিনে খেতে পারে, সরকার সব সময় সেটাই চায়। তাছাড়া সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দেশের এক কোটি দরিদ্র পরিবারের কাছে স্বল্পমূল্যে খাদ্য প্রদান করবে এবং এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই আপদকালীন অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের এসব প্রসঙ্গকে গুরুত্ব না দিয়ে বাকি সব ভুলে গিয়ে শুধু ‘বেহেশতে’ রয়েছে কথাটুকু উদ্ধৃত করে জোরেশোরে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পুরো বক্তব্য আমলে না নিয়ে তার বক্তব্যের খণ্ডিত একটি অংশ দিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে যে কথাটুকু আমাদের মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করেছে, অনেক টকশোজীবী প্রাসঙ্গিক পূর্বাপর বিশ্লেষণ না করে টকশোতে বড় বড় করে এর বিরুদ্ধে কথা বললেন, তা খুবই দুঃখজনক। একজন সজ্জন মানুষের সাধারণ বক্তব্যকে কর্তিত করে তা নিয়ে জল ঘোলা করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের এ চক্রান্ত অত্যন্ত ঘৃণ্য ও জঘন্য। কোনো সুস্থ, বিবেকবান মানুষ পরিস্থিতি না বুঝে কারও কথার অংশবিশেষ নিয়ে এভাবে মেতে উঠতে পারেন না। কেবল অসুস্থ, হতাশাগ্রস্ত, নেতিবাচক, স্বার্থান্বেষী মানুষদের পক্ষেই সম্ভব এভাবে মেতে ওঠা।
একইভাবে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতের প্রসঙ্গ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যেভাবে জঘন্য অপপ্রচার ও সুস্পষ্ট মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাও দুঃখজনক। তারা বলছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের সাহায্য চেয়েছেন। আদতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে গিয়ে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথাই বলেননি বরং কথা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেখা দেওয়া অস্থিরতা নিয়ে। আমাদের এ অঞ্চলেও বিভিন্নরকম অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। সেজন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতকে বলেছেন, বাংলাদেশ এই অস্থিতিশীলতা চায় না। কোনোরকম অস্থিরতা কাম্য নয়। এবং এটাও বলেছেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার কারণেই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আছে এবং এর ফলে শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতিভূ, স্থিতিশীলতার প্রতীক। তিনি সরকারে আছেন বলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে। ‘শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে বলতে’ শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই-এটাই বুঝিয়েছেন তিনি।
মূলত ভারতের সহায়তা চাওয়া প্রসঙ্গে ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি আসামের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকালে মুখ্যমন্ত্রী তাকে বলেন, ‘আপনাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’ এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, তার কারণে ভারত নানাদিক থেকে লাভবান হচ্ছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন, কোনো প্রকারের সন্ত্রাস তিনি সহ্য করবেন না মর্মে যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তা ভারতকে মুগ্ধ করেছে। তার কারণে বাংলাদেশে এখন সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নেই। তার এই নীতির কারণে মুখ্যমন্ত্রীরাও লাভবান হয়েছেন। এখন বাংলাদেশের মতো আসাম, মেঘালয়েও আর তেমন কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা নেই। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ত্রাসী তৎপরতা না থাকায় বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি এখন আসামের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, বিনিয়োগ বাড়ছে। আগে যেখানে এক-দুইটা হাসপতাল ছিল, এখন সেখানে ১৭টা নতুন হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এজন্যে তারা শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানান। সে সময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা খুব দরকার। এই স্থিতিশীলতা যেন আমরা বজায় রাখতে পারি পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারত, বাংলাদেশ সব জায়গায়, সেটা আমাদের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ স্থিতিশীলতা থাকলেই কেবল উন্নয়ন সম্ভব। স্থিতিশীলতা থাকলে শুধু একটি দেশের নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরও উন্নয়ন হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে বলেই চলতি বছর (২০২২) প্রায় ২৮ লাখ মানুষ ভারত সফর করেছে। বাংলাদেশ আজ উন্নত হয়েছে বলেই ভারতের অনেক মানুষ বাংলাদেশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। স্থিতিশীলতার কারণে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে এগুলো সম্ভব হয়েছে।’
মুখ্যমন্ত্রীর কথার জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশেই কিছু দুষ্ট লোক বা উগ্রবাদী আছে যারা বিভিন্নভাবে তিলকে তাল করে উভয় দেশের সাম্প্রদায়িক সুসম্পর্ক বিনষ্ট করতে চায়। ছোট্ট ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রচার করে। যার ফলে সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমরা কোনো আইসোলেটেড কান্ট্রি বা বিচ্ছিন্ন দেশ না। ভারতে যদি সাম্প্রদায়িক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়ে। এজন্য আমরা উভয় দেশ যেন কোনো উসকানিমূলক আচরণ না করি, সেদিকে সতর্ক থাকলে উভয় দেশেরই লাভ।’ একথা সর্বজনবিদিত যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় একদিনে ৪৯৫টি বোমাবাজি হয় দেশের ৬৪ জেলার ৬৩টিতে এবং একই সময়ে। বোমাবাজির ফলে এজলাশে বিচারকের মৃত্যু ঘটে। ‘বাংলাভাই’, ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ (জেএমজেবি), ‘জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ’ (জেএমবি) এগুলোর কথা আমরা ভুলিনি। ব্রিটিশ হাইকমিশনার একটি মাজার সফরে গেলে সেখানেও বোমাবাজি হয়; হিন্দুদের অনেক বাড়িঘর ও নারীরা উগ্রবাদীদের আক্রমণের শিকার হন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা এখনো আমরা ভুলিনি। সন্ত্রাস আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ফলে ২৪ জন মারা যান এবং প্রায় ৩৭০ জন আহত হন। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা এখনো আছেন বলে দেশে শান্তি ফিরে এসেছে, বোমাবাজি, সন্ত্রাস বন্ধ হয়েছে, ‘বাংলাভাই’দের অত্যাচার এখন নেই। এখন সন্ত্রাসীরা বা ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে। কিছু কিছু ছোট ঘটনা রয়েছে, যেমন সীমান্তে হত্যা, গরু ব্যবসায়ীকে হত্যা- এগুলো যদি আমরা বন্ধ করতে পারি, তাহলে স্থিতিশীলতা জোরদার হবে। ভারত স্থিতিশীলতা চায়, বাংলাদেশও স্থিতিশীলতা কামনা করে।
সুতরাং মুখ্য উদ্দেশ্য হলো এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা যেন বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করা। আর স্থিতিশীলতার প্রতীক হচ্ছেন শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের আদর্শ, তিনি স্থিতিশীলতার শক্তি। বাংলাদেশের মানুষ তাকে টিকিয়ে রেখেছে- মানুষ ভালোবেসে তাকে টিকিয়ে রাখবে ভবিষ্যতেও। কারণ বাংলাদেশের জন্য, এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। ‘বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য যা যা করা দরকার, সে ব্যাপারে ভারতের সহায়তা চাই’-এই কথাটা বলেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই হলো ভারতের কাছে তার সাহায্য চাওয়ার মূল বক্তব্য। মনে রাখতে হবে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠানটি ছিল জন্মাষ্টমীর এবং অধিকাংশ অতিথি ছিলেন সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু এটাকে কোনো কোনো ব্যক্তি মনে করছেন এবং প্রচার করছেন যে, মন্ত্রী মহোদয় বোধহয় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিলেন- বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে গিয়ে শেখ হাসিনাকে আবার নির্বাচনে জয়ী করার জন্য সাহায্য চাইলেন। তাদের জানা উচিত, শেখ হাসিনার দায়বদ্ধতা এ দেশের জনগণের কাছে- তাই ক্ষমতায় আসতে তার বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মাধ্যমে শেখ হাসিনার নীতিকে সহায়তার কথাই বুঝিয়েছিলেন ড. মোমেন সেদিন। বাংলাদেশের মানুষই তাকে ভোট দিয়ে বিজয়ীর আসনে বসাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে যা বলেছেন, তার মর্মার্থ হলো, তিনি চাচ্ছেন এই অঞ্চলে যেন স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। মিয়ানমারের মতো ধর্মীয় সহিংসতার ফলে যেন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না হয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট না হয়। ১১ লাখ রোহিঙ্গার মতো ভিটেমাটি ছাড়া না হয় এদেশবাসী। ইউরোপের মতো যেন এ অঞ্চলেও যুদ্ধের দামামা বেজে না ওঠে। এরই মধ্যে এশিয়ায়ও একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শক্তিশালী দেশ ভারত চাইলে সবাইকে নিয়ে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায়ে ভূমিকা রাখতে পারে। সেদিক বিবেচনা করেই ভারতের সহায়তা কামনা করেছেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, যে প্রেক্ষাপটে তিনি এ কথা বলেছেন, সেদিকে না গিয়ে পুরো বক্তব্যটিকে ভুল দিকে টেনে নিয়ে গেছে একটি মহল। এ মহলের উদ্দেশ্য যে অসৎ, এ মহল যে চক্রান্তকারী তা স্পষ্ট করেই বলা যায়।
ড. আব্দুল মোমেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন গোটা বিশ্বের সামনে। তার মতো গ্লোবাল বিশেষজ্ঞদেশে খুব কমই আছে। অথচ তাকে হেয় করতে যেন উঠে পড়ে লেগেছে একটি মহল। আসলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নয়, তাদের মূল লক্ষ্য শেখ হাসিনা। যে কোনো উপায়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই যেন তাদের মূল উদ্দেশ্য। ভারত প্রসঙ্গে অলীক গল্প ফেঁদে আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার ফিল্ড নষ্ট করার অসৎ অপচেষ্টায় সরব এই মহল। কিন্তু তারা যতই চক্রান্ত করুক, কোনোভাবেই সফল হবে না। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় ধস নামাতে পারবে না কেউ। বাংলাদেশের মানুষ তার সাথে আছে। বস্তুত উপরে আলোচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য ধরে বিশ্লেষণের পর বলা যায়, তার কথা দিয়ে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে প্রচার করার কোনো সার্থকতা নেই। কারণ তিনি মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প বাংলাদেশে নেই। শুধু বাংলাদেশে কেন, গোটা এশিয়ার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শেখ হাসিনা। তাকে টিকিয়ে রাখতে হবে দেশের আপামর জনগণের মঙ্গলের জন্য এবং এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে। কারণ তিনি স্থিতিশীলতার এক অনন্য ও আদর্শ প্রতীক।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে তার হাত ধরে। তিনি থাকলে সবার উন্নয়ন সম্ভব। ভারতের উন্নয়নও তার ওপর নির্ভর করে। পুরো এশিয়া তার জন্য লাভবান হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। শেখ হাসিনা এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশ্বাস করেন। কারণ সবার উন্নয়ন না হলে সেটা টেকসই হয় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘চবধপব রং রসঢ়বৎধঃরাব ভড়ৎ বপড়হড়সরপ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ’ -শান্তি ও স্থিতিশীলতা উন্নয়নের জন্যে অপরিহার্য। যে সব অঞ্চলে বা দেশে স্থিতিশীলতা নেই সেই সব এলাকা অনুন্নত।গত ১৩ বছর বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আছে বলেই দেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার যে ধারা চলমান আছে তা যদি অব্যাহত থাকে তবে বাংলাদেশের জনগণ একটি উন্নত সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশে উন্নত জীবনযাপন করার সুযোগ লাভ করবে। এই কথাগুলোই বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যা কোনোক্রমেই অযৌক্তিক কোনো কথা নয়। তবে বিরোধী মহল চক্রান্ত করবেই, নানা কুৎসা রটাবেই, তার ভেতর দিয়েই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ এবং জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জিত হবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই। আর সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবেন সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেই।
লেখক ড. মিল্টন বিশ্বাস : বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং সাধারণ সম্পাদক- বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম ও অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়