Search
Close this search box.

প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর, বন্ধুত্ব ও বানিজ্যিক সম্পর্কে নজর

প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর, বন্ধুত্ব ও বানিজ্যিক সম্পর্কে নজর

তাপস হালদার

বাংলাদেশের সাথে ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের তিনদিক ঘিরে আছে ভারতের সীমান্তরেখা। কূটনীতিতে একটা কথা আছে, চাইলেই বন্ধুত্ব বদল করা যায় কিন্তু প্রতিবেশী বদল করা যায় না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরকার ও জনগনের অবদান দুই দেশের সম্পর্ককে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ প্রায় তিন বছর পর ৫ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লি গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত সরকারও এই সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। একজন সরকারপ্রধান একটি রাষ্ট্র সফর করবেন, এটি কুটনীতির একটি সাধারণ বিষয়। এখানে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম থাকে। কিন্তু সফরটা যদি হয় বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্রপ্রধানের ভারত সফর, তাহলে সফরটি আপামর জনগনের আবেগ, উচ্ছাস ও আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়। সরকার সমর্থক ও বিরোধীদলের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ভারত থেকে কি আনল, ভারতকে কি দিয়ে দিলো- এসব নিয়ে অংক কষা শুরু হয়। মনে হয় আর্জেন্টিনা -ব্রাজিল ম্যাচের টানটান উত্তেজনা। অথচ দ্বিপাক্ষিক সফরগুলোতে এসব কিছুই হয় না। দেয়া- নেওয়ার কোন বিষয় থাকে না। প্রতিটি দেশই তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই আলাপ-আলোচনা করে থাকে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচীতে দেখা যাচ্ছে, দুই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের বৈঠক ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের প্রতিনিধি সভায় ভাষণ দেবার কথা রয়েছে। ভারতের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে কীভাবে উভয়পক্ষই উপকৃত হতে পারে, সেই চিত্রই তিনি সেখানে তুলে ধরবেন। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে।

১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ-ভারত বানিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারপ্রধান জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৫ বছর মেয়াদি এক ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাপুরুষোচিত হত্যাকান্ডের পর মৈত্রী চুক্তি মুখ থুবড়ে পড়ে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি অন্যান্য সম্পর্কেও দ্রুত অবনতি ঘটে। তারপর বাংলাদেশে দুই সামরিক শাসন ও বিএনপির শাসনামলে তাদের ভারতবিরোধী নীতির কারণে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে সমস্যাগুলোর সমাধান তো হয়ইনি বরং আরো বেড়েছিল। দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হন। বিশেষ করে ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর দ্রুতই সমস্যাগুলোর জট খুলতে শুরু করে।

বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বাংলাদেশেরও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে ব্যবসায় বাণিজ্য সম্প্রসারিত করার বিকল্প নেই। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ বাণিজ্য পরিচালিত হত। এছাড়া রেলপথেও চলতো বানিজ্য। কিন্তু ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে পাকিস্তান সরকার ভারতের ট্রানজিট অধিকার বাতিল করে দেয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নদীপথে ট্রানজিট পুনরায় চালু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত দুটি দেশই ট্রানজিট আর ট্রানশিপমেন্টের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। এজন্য যোগাযোগ বাড়াতে নতুন নতুন সড়ক, রেল ও নৌপথ চালু হচ্ছে।

২০১৯ সালে ৩-৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে ঢাকা-শিলিগুড়ি-গ্যাংটক এবং ঢাকা- শিলিগুড়ি-দার্জিলিং বাস সার্ভিস চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল বৈঠকে নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে পশ্চিমবঙ্গের হলদিবাড়ী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ উদ্বোধন করেন, যা ১৯৬৫ সালের পর বন্ধ ছিল। দুই প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের ৯ মার্চ আরেকটি ভার্চুয়াল বৈঠকে ফেনী নদীতে মৈত্রী ব্রিজ চালু করেছেন। এই ব্রিজের মাধ্যমে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ের সাথে ত্রিপুরার সাবরুমকে যুক্ত করা হয়েছে।

শুধু সড়ক বা রেলপথ নয়, বরং নৌপথেও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। ‘প্রোটকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড’ (পিআইডব্লিউটিটি) চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ-ভারতের জন্য গোমতী নদীতে সোনামুড়ি-দাউদকান্দি রুট এবং পদ্মায় ধুলিয়া-গোদাগারি থেকে আরিচা পর্যন্ত রুটে নৌপথে যোগাযোগ স্থাপন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে একটি ব্যবসায়িক হাব গঠনের চেষ্টা চলছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, পানি বণ্টন, কানেকটিভিটিসহ এক ডজন চুক্তি, সমঝোতা ও ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের সম্ভাবনা আছে। সফরে বাংলাদেশ -ভারত বাণিজ্য চুক্তি বা ‘সেপা’ (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শত শত পণ্যের অবাধ ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যর জন্য এটিকে একটি ‘ল্যান্ডমার্ক’ বা যুগান্তকারী সমঝোতা বলে গণ্য করা হচ্ছে। এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে দু-দেশের মধ্যে মুক্ত বানিজ্যিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হবে। দু-দেশেরই পন্য দুই দেশে শুল্ক মুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তোরণ হওয়ার পর ভারতে রপ্তানিসহ বাণিজ্য সুবিধা বাড়াতে বাংলাদেশের আগ্রহে এ চুক্তি হতে যাচ্ছে। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বহুগুন বাড়বে এবং ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১.৭২ শতাংশ বেড়ে যাবে, যা ভারতেরও অনুরূপভাবে বাড়বে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফর আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সফরে উদ্বোধন হতে চলেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প ‘মৈত্রী’র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৩২০ মেগাওয়াট ‘মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার স্টেশন’ যৌথভাবে উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এটি হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কম্পানি লিমিটেড’। ভারতের এনটিপিসি এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে এটি একটি ৫০:৫০ যৌথ উদ্যোগ। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উদ্বোধন হলে দেশে চলমান বিদ্যুৎ সমস্যা অনেকটা কমে আসবে।

বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের সময় দু-দেশের বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ছিটমহল সমস্যার সমাধান, সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ও বানিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পন্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা। তবে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি ও সীমান্ত হত্যা শূণ্যতে নামিয়ে আনাসহ কিছু বিষয়ের সমাধান এখনও করা যায়নি। দু-দেশের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই চায় উপমহাদেশের এই অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকুক। বাংলাদেশ-ভারতের পারস্পরিক সহযোগিতা, বন্ধুত্ব উভয়দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের যে কোনো অস্থিতিশীলতা যেমন বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলেও ভারতের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ভারতীয় সরকার ও জনগণ এবং বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে যে বন্ধুত্বের বন্ধন তা আজ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ