রেজা সেলিম
তথ্য-প্রযুক্তির ক্রমাগত উৎকর্ষের ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানাক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখার জন্যে প্রযুক্তির যে ব্যবহার, এখন তা সাধারণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, ২০১০ সালে মার্কিন প্রাপ্তবয়স্ক ট্যাবলেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫ শতাংশ হয়। এটা এখন আরও বেড়েছে। ২০০০ সালে মার্কিনিদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের সংখ্যা ছিল ৫৩ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে দাঁড়ায় ৯২ শতাংশে, ইতোমধ্যে তা প্রায় শতভাগ ছুঁয়েছে। এখন উন্নত অনেক দেশের মতোই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, এমনকি বাংলাদেশেও প্রায় শতভাগ মানুষ এখন মোবাইল ফোন ডিভাইসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কথা বলা ছাড়াও নিত্যদিনের অনেক কাজ এখন মোবাইলে সেরে নেওয়া হয়, এরমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ ছাড়াও কেনাকাটা, ম্যাসেজিং, ব্যাংকিং বা টাকা-পয়সা লেনদেন বেশ জনপ্রিয়। সাধারণের ঘরে ছবি তোলার ক্যামেরা এখন আর নেই বললেই চলে, তার জায়গা দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা।
আমরা নানা সময়ে বলে থাকি, সামাজিক ও সহজতর জীবনযাপনের জন্যে প্রযুক্তি একটি ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে এবং করছেও। এই নিয়ে গবেষণা জগতের জন্যে এখনও অনেক বিষয় উন্মুক্ত হয়ে আছে, যা নিয়ে আরও বেশি মূল্যায়নের অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির উপস্থিতি মানুষের আন্তসম্পর্ক নিরূপণ, এমনকি সামাজিক অবস্থানের পুনর্বিন্যাসেও প্রযুক্তি এখন অন্যতম প্রভাব সৃষ্টিকারী নিয়ামক হয়ে উঠেছে। সমাজ মনোবিজ্ঞানী ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদেরা সমন্বিত গবেষণায় এমন উপাদান খুঁজে পেয়েছেন যে, দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির একীকরণের ফলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে গভীর প্রভাব পড়ছে। আরও সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, কেমন করে প্রযুক্তির প্রায় সবক’টি শক্তির ব্যবহারই পারস্পরিক সম্পর্কগুলোতে জড়িয়ে থাকে, সম্পর্কের মধ্যে আচরণ করে এবং আবেগ-ভালোবাসার প্রদর্শনসহ অনুভূতি এবং ভাবনাগুলো কীভাবে প্রভাব ফেলে বা হস্তক্ষেপ করে। সর্বোপরি, নতুন নতুন উদ্ভাবনগুলোও দেখা যাচ্ছে মানুষের মনে নতুন ভাবনা সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মানুষকে বেশ কিছু ইতিবাচক নির্দেশনা এনে দিয়েছে, যেমন- পারস্পরিক যোগাযোগ, একে অপরকে জানা বা বোঝা বা মানুষের নানারকম পেশাগত ও সামাজিক-ব্যক্তিগত অবস্থান, ভূমিকা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা এসব বুঝতে সাহায্য করছে। তথ্যবিনিময় এখন সামাজিক যোগাযোগের বেশ বড় একটি কনটেন্ট দখল করে আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নাগরিক সাংবাদিকতার দায়িত্বও নিয়ে নিয়েছে ফেসবুক ও টুইটার। ইনস্টাগ্রামের একটি ছবি এক মুহূর্তে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে বিশেষ কোনও বার্তা নিয়ে। কেবল মনের ভাব প্রকাশের জগত ছাপিয়ে এখন গবেষণা তথ্য বিনিময়ে ব্লগ সাইটগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।
অপরদিকে যেসব নেতিবাচক ভাবনা এখন তথ্য-প্রযুক্তি উন্নয়নে সমালোচিত হচ্ছে সেগুলো নেহায়েত কথার কথা নয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে উদ্বেগজনকও বটে। বিশেষ করে মিথ্যা ও গুজব রটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি করা হয়েছে। ফটোশপের কারসাজি এমন ঘটনার সবচেয়ে বাজে উদাহরণ, যা প্রযুক্তির উন্নয়ন সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সত্য-মিথ্যার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে মানুষের বুদ্ধিচর্চাকে, বিজ্ঞানের জন্যে এর চেয়ে খারাপ চ্যালেঞ্জ আর কিছু হতে পারে না, বিশেষ করে বুদ্ধি ও মনন যখন যুগপৎ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ব্যবহার করে গবেষণা উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনী অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সামাজিক সঙ্গতি উন্নত করার সুযোগ নিতে এখন বিশ্বব্যাপী নানারকম চিন্তা চলছে। কিন্তু বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে যে বিষয় তা হলো মানুষের আন্তসম্পর্কে তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব। সামাজিক যোগাযোগের বাইরেও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও মনোজাগতিক জগতে দ্বন্দ্ব এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ব্যক্তি-সংস্কৃতি ও সামাজিক সংস্কৃতির জন্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এর অন্যতম পটভূমি তৈরি হয়েছে নানারকম ডিভাইসের ব্যবহার ও এসব ডিভাইসের কার্য-প্রক্রিয়া, ভাষা ও বৈজ্ঞানিক পরিধির মাধ্যমে। বেশ কিছু প্রায়োগিক ও পর্যবেক্ষণ গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু-কিশোরদের মনোজগতে ডিভাইসের ও অপারেটিং পদ্ধতি ও অ্যাপের প্রভাব পড়েছে অনেক বেশি, যার ফলে চিন্তার বহু বিচিত্র জগতে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়ে মানুষকে একটি সীমিত পরিসরে প্রযুক্তি আটকে ফেলেছে। ফলে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জগতে কি প্রযুক্তি না মানব বুদ্ধি নেতৃত্ব দেবে এটা নিয়ে সংশয় দানা বেঁধেই আছে। যার ফলে প্রযুক্তি দর্শন গত প্রায় এক দশক বিস্ময়ে থমকে আছে।
আশির দশক থেকে তথ্য-প্রযুক্তি যখন নির্বিচারে তরঙ্গপ্রবাহে তার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে তখন গণমাধ্যম তার সংস্কৃতির একটি নতুন মাত্রা খুঁজে নিয়েছে। ফলে ব্রডকাস্ট সংস্কৃতির যে চলমান কাঠামো, সেখানেও বেঁধেছে বিপত্তি, এমন এমন কনটেন্ট এসে নাটক, সিনেমা বা টকশো-তে হাজির হচ্ছে, সেসবের সঙ্গে মানবসমাজ তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। কারণ, তাদের জীবনাদর্শনের সঙ্গে সেসব মিলছে না। সংবাদ পরিবেশনে সত্য-মিথ্যার মিশেলে এমন এক পারিপার্শ্ব গড়ে উঠেছে, ‘বস্তুনিষ্ঠ’ বলে এখন কিছু খুঁজে পাওয়া ভার। এই যে ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে আমাদের চলমান সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, তা মিটিয়ে নিতে হয়তো নানা অভিজ্ঞতা ও গবেষণায় একটা উপায় একদিন বের হবে ঠিকই, কিন্তু যা হওয়ার তা ততদিনে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সমাজতত্ত্ববিদেরা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। এসবের পেছনে মূলত আদি কারণ মুনাফা–এটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সব জেনে বুঝেও দক্ষিণের দেশগুলো পশ্চিমা বেনিয়া দেশগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছে না। এর সবচেয়ে বড় কারণ সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব। আমি কী জানি ও বুঝি তা কেমন করে দেশের কল্যাণে নিয়োজিত করবো সেই মূল্যবোধ হারিয়ে আমরা ব্যক্তিগত মুনাফার বা লাভালাভের কথা ভাবছি। এই মুনাফা অর্জনের সংস্কৃতি আমাদের মানবিক আদর্শ থেকে যেমন বিচ্যুত করছে, তেমনই বিজ্ঞান-বুদ্ধির চর্চাকে মানবিক হতে অন্তরায় তৈরি করছে। পুঁজিবাদী সমাজের ভোগবাদী দর্শন আমাদের যদি একটুও রেহাই দিতো, শুধু গরিব দেশগুলো মিলেই সারা দুনিয়া থেকে প্রযুক্তির অপশাসন দূর করে কল্যাণের রাজকতা প্রতিষ্ঠা করতে পারতো; কিন্তু সে খেয়াল আমাদের নেই।
বাংলাদেশের মতো ডিজিটাল সংস্কৃতি নিয়ে যেসব দেশ নিজেদের উন্নতির স্বপ্ন দেখছে, এখন সময় হয়েছে প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী মিশেল থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে উদ্ভাবনী উপায় বের করা। বহুজাতিক দুঃস্বপ্নে বিভোর না থেকে আমাদের নিজেদের মতো করে প্রযুক্তিকে যদি বশে না রাখতে পারি, তাহলে বাজারও আমাদের হাতে থাকবে না, সেবা প্রাপ্তির নামে আমরা শুধু ক্রেতা হয়েই থাকবো, বিক্রেতা হতে পারবো না। আমাদের পরিশ্রমগুলো তখন কাঁচের ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে আর ঘরে ঘরে শোভা পাবে মুনাফা মোড়ানো পশ্চিমা ‘ইনোভেশন’।
লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প