স্বদেশ রায়
রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম রেখা আছে। যা বিভেদের নয়, স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে মিলনের, যেমনটি থাকে প্রকৃত দম্পতির মধ্যে। এই রাষ্ট্র ও সমাজকে বজায় রাখায় বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ, তিনি গভীরভাবে জানতেন, সমাজের ভেতর দিয়ে একদিন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। আর তা মানুষের কিছু বিশেষ প্রয়োজনে, সব প্রয়োজনে নয়। যে কারণে সমাজ থাকে ওপরে, রাষ্ট্রকে থাকতে হয় নিচে। সভ্যতার হাজার হাজার বছর ধরে এই সমাজই মানুষকে লালন করেছে। রাষ্ট্র তার সহায়ক হয়েছে মাত্র। তবে সেটা সারা পৃথিবীতে ততটা বেশি নয়। যতটা বেশি করে সমাজতন্ত্রের আধিপত্য দেখা গেছে ভারত ও চীনের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের মতে, এই দুটি সমাজ সব অবস্থাতে মানুষের রক্ষাকর্তা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তার ভাষায়, ‘স্বদেশি রাজায় রাজায় নিয়তই রাজত্ব নিয়ে হাত কাড়াকাড়ি চলল, বিদেশি রাজারা এসে সিংহাসন কাড়াকাড়ি করতে লাগলো– লুটপাট ও অত্যাচারও কম হলো না– কিন্তু তবু দেশের আত্মরক্ষা হয়েছে যেহেতু সে আপন কাজ আপনি করেছে। অন্ন বস্ত্র ধর্মকর্ম সবই তার আপনারই হাতে। এমনই করে দেশ ছিল দেশের লোকের, রাজা ছিল তার এক অংশে মাত্র। মাথার ওপর যেমন মুকুট থাকে।’
সমাজের বয়স যেহেতু রাষ্ট্রের থেকে অনেক বেশি। তার গ্রন্থিও অনেক অটুট। তাই সমাজ মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে পরিচালিত করতো। রাজা যেখানে আধিপত্য করতে গেছে সেখানেই অর্থাৎ পশ্চিমে মানুষ তার নিজের পরিচয় হারিয়ে রবীন্দ্রনাথের ওই রক্ত করবীর ৪৭ এর ঘ হয়েছে। সে আর মানুষ থাকেনি। রাষ্ট্র তাকে গিলে ফেলেছে।
রাষ্ট্র ও সমাজের পার্থক্য যেমন অতি সূক্ষ্ম রেখায়, রাজনীতি ও সমাজনীতির পার্থক্যও তেমনি সূক্ষ্ম রেখায়। এই উপমহাদেশ ( যা ভারতবর্ষ নামে বেশি পরিচিত) যেহেতু সমাজের স্নেহ ছায়ায় বেড়ে উঠেছে, তাই সমাজ আর রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও পার্থক্য বজায় রেখেই এখানে রাষ্ট্র গড়ার দরকার ছিল। রাজনীতিকেও হতে হতো না সর্বগ্রাসী। তাহলে সমাজ তার আপন শক্তিতে বের হয়ে আসতে পারতো, নিজেকে শুদ্ধাচারের রেল লাইনে ফেলে- সরল পথে চলে। অন্যদিকে রাজনীতি ও সমাজনীতি যদি তার সূক্ষ্ম পার্থক্য বজায় রাখতো তাহলে রাজনীতি এমন সর্বগ্রাসী হতো না। সমাজকে ভেঙে চুরে, মানুষের সব অস্তিত্বকে শেষ করে রাষ্ট্রের পায়ের নিচে এনে সমর্পণ করতো না। বাস্তবে রাষ্ট্র ও সমাজের এই যে পার্থক্য, আর রাজনীতি ও সমাজনীতির যে পার্থক্য তা রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে একমাত্র কাজী আব্দুল ওদুদ ছাড়া আর কেউই জোরের সঙ্গে এ নিয়ে কোনও আলাপ আলোচনা বা লেখালেখি ওই ভাবে করেননি। তাই রবীন্দ্রনাথের এই সমাজকে বাঁচিয়ে রেখে রাষ্ট্র্রও সমাজনীতি থেকে পৃথক করে রাজনীতির এই স্রোতধারা- কী রবীন্দ্রনাথের বাংলায়, কী তাঁর বৃহত্তর ভারতবর্ষে ওইভাবে প্রচারিত হলো না।
এর বিপরীতে বড় বড় গুণীজন অনেক বেশি মুগ্ধ হয়ে চলে গেলেন গান্ধীর কাছে। তাঁরা দেখতে পেলেন গান্ধী রাজনীতি ও সমাজ সংস্কার করবে বলে রাজনীতিকে এক করে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তাঁরা গান্ধীর চরকা কাটার ভেতর রাষ্ট্র ও সমাজের মুক্তি দেখলেন। যাকে রবীন্দ্রনাথ ওই সময়েই চিহ্নিত করে বলেছিলেন, “আজ আমাদের দেশে চরকালাঞ্ছনা পতাকা উড়িয়েছি। এ যে সম্পূর্ণ জড় শক্তির পতাকা- এতে চিত্ত শক্তির কোনও অবদান নেই। সমস্ত জাতিকে মুক্তির পথে যে আমন্ত্রণ সে তো কোনও বাহ্য প্রক্রিয়ার অন্ধ পুনরাবৃত্তির আমন্ত্রণ হতে পারে না। তার জন্যে আবশ্যক পূর্ণ মনুষ্যত্বের উদ্বোধন- সে কী এই চরকা চালনায়। চিন্তাবিহীন মূঢ় বাহ্য অনুষ্ঠানকেই ঐহিক পারত্রিক সিদ্ধিলাভের উপায় গণ্য করেই কি এতকাল জড়ত্বের বেষ্টনে আমরা মনকে কর্মকে আড়ষ্ট করে রাখেনি।’
বাস্তবে কোনও সমাজে বুদ্ধির বিকাশ কমে গেলে তখন জড়ত্ব রাজত্ব করে। অর্থাৎ আচরণসর্বস্ব সব কিছুই তখন ওই সমাজে বড় হয়ে ওঠে। আর যেহেতু সমাজকে গিলে ফেলেছে রাষ্ট্র ও রাজনীতি– তাই রাষ্ট্র ও রাজনীতির জড় বুদ্ধির আচরণ ও কর্মকাণ্ড তখন ওই মানুষ গোষ্ঠীর জন্যে বরাদ্দ হয়। তারা তখন ধীরে ধীরে সরে যায় বুদ্ধিবৃত্তির জীবনাচরণ থেকে। ভারতবর্ষে বা এই উপমহাদেশে কংগ্রেসের মাধ্যমে যে পশ্চিমা রাজনীতি শুরু হয়, সেখানে যে বুদ্ধিবৃত্তির জীবনাচারণ ও তাকে মুক্ত করার জন্যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল– তা বলা যায় না। কারণ, তা ছিল সমাজের ওপর তলায়। যেখানে কেবল ছিল ব্রাহ্মণের জলচলের মতো ইংরেজির চল। এটাকে ভাঙার জন্যে রবীন্দ্রনাথ রাজশাহী ও ঢাকার কংগ্রেস সম্মেলনে ইংরেজির বদলে বাংলাকে ব্যবহার করেছিলেন। যাতে সমাজের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে কংগ্রেসের একটা যোগ হয়। কিন্তু তিনি তার জন্যে সাধুবাদের বদলে নিন্দাবাদই পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় বাঙালির জন্যে সব থেকে বড় গালিটি ‘ইংরেজি জানে না’ এটাই তাঁকে শুনতে হয়েছিল। এই গালিতে অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে দমানো বা তাঁকে এতটুকু সরানো সম্ভব ছিল না। কারণ, তিনি যে বাড়িতে বেড়ে উঠেছিলেন, ওই বাড়িতে সাহেবী কায়েদা সব বজায় থাকলেও বাংলা ভাষা ও বাঙালিয়ানার ছিল অনেক বেশি গুরুত্ব। তার পিতাদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যদি জানতেন, কেউ বাংলার বদলে ইংরেজিতে চিঠি লিখেছে ওই বাড়িতে। তিনি খুশি হতেন না। তাছাড়া তাঁর বাড়ি অর্থাৎ এই ঠাকুর বাড়ি তিন পুরুষ ধরে বাঙালি সমাজকে যে আধুনিকতা দিয়েছে সমাজের সকল কিছু বজায় রেখে শুধুমাত্র কুসংস্কারকে সংস্কার করে এবং সমাজের সঙ্গে মিল রেখে আধুনিকতাকে যোগ করে, তা কিন্তু কোনও রাজনীতি বা রাষ্ট্র দেয়নি।
রবীন্দ্রনাথ সমাজের ঘরে বসে, বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক হিসেবে, বাঙালির মননে, বাঙালির সংস্কৃতিতে, বাঙালির ভাষায় যে পরিবর্তন এনেছেন তা কোনও রাষ্ট্র ও রাজনীতি করতে পারেনি। বরং এর বিপরীতে রাষ্ট্র আজ সমাজে এই সংস্কৃতি ও মনন প্রচারে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ, ভোটের রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি, রাজকর্মচারীর রাজনীতি সর্বোপরি দুর্নীতির রাজনীতি আজ রাষ্ট্রের সহযোগী। তাই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে তৈরি বাঙালির আধুনিক সংস্কৃতির বদলে সমাজে যাতে পশ্চাৎপদ ধর্মীয় সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে সেটাতেই সমস্ত রসদ জোগান দিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের ওই সকল সহযোগীরা। যার ফলে সমাজ এখন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের মতে একটি রাষ্ট্র বা সমাজকে কেবলমাত্র বণিকের মতো পণ্য উৎপাদনে ব্যস্ত থাকতে নেই। তাকে নিয়োজিত করতে হয় বা নিয়োজিত হতে হয় ‘বিদ্যা-অর্জনে, বুদ্ধির আলোচনায়, লোকহিতে, শিল্পসাহিত্য- সৃষ্টিতে, মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশে।’
রাজনীতি যখন সমাজনীতিকে একেবারে ঝেঁটিয়ে দূর করে দেয়, রাষ্ট্র যখন সমাজকে সম্পূর্ণ ভেঙে চুরে নিজের কর্মচারীদের আওতায় নিয়ে আসে- তখন বাস্তবে ওই জনগোষ্ঠীর অবস্থা কী হয়। বাস্তবে রাষ্ট্র তখন তার টুটি চেপে ধরে একটি বুলি শেখানো পাখি তৈরি করে। যাকে সারাক্ষণ রাষ্ট্রের ও রাজার শ্রেষ্ঠত্ব জপ করতে হয়। সেখানে রাজার থেকে সমাজে আর কেউ শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে না। সেখানে রাজার বুদ্ধিই সেরা বুদ্ধি বলে বিবেচিত হয়। সেখানের রাজাই মহাজ্ঞানী হন। আর জ্ঞান হয় সমাজ থেকে নির্বাসিত। অন্যদিকে সমাজের সকল শুদ্ধাচার পড়ে যায় রাজকর্মচারী অর্থাৎ রাজার কোটালের লাঠির নিচে। আর তখন ভালোবাসা নয়, প্রতাপই সমাজে বড় হয়ে ওঠে। প্রতাপ কেবল দুঃখই দিতে পারে, ভালোবাসার মতো সুখ দেবার ক্ষমতা বা স্বভাব তার নেই। তাই আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে ভালোবাসার বদলে প্রতাপই সব সময় চেঁচিয়ে দুঃখ দেবার বড়াই করে। আর সেই দুঃখ পাবার ভয়ে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের পরে আমরা দুবার রাষ্ট্র গড়েছি। আমরা রবীন্দ্রনাথকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করি। গোটা ভারত উপমহাদেশ করে। তারপরেও এই উপমহাদেশজুড়ে কেবল রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী রূপ দিন দিন বেড়ে চলেছে। রাজনীতিও হয়ে উঠেছে মানুষকে দলবদ্ধ জীবের মতো পরিচালিত করার এক বুদ্ধিবৃত্তিহীন উপাদান।
সেই যে সমাজ ছিল, যে সমাজ মানুষকে রক্ষা করতো। রাজা মাথার ওপর শুধু মুকুট হয়ে থাকতো। তাতে মানুষের মাঝে তার শোভা বর্ধন হতো অনেক বেশি। সেই সমাজকে সমাজের ভেতরের শক্তি থেকে গড়ে ওঠা ধর্ম নয়, পরকালের ধর্ম দিয়ে, রাষ্ট্রের শৃঙ্খল দিয়ে, রাজকর্মচারী ও রাজনৈতিক দলবদ্ধতা দিয়ে ভেঙেচুরে ফেলা হয়েছে। তাই এখন সবখানে জড়তার জয়গান। বণিকের উৎপাদনের জয়গান। মনুষ্যত্ব, শিক্ষা, বিদ্যা-অর্জন, বুদ্ধির আলোচনা, লোকহিত থেকে শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি সবই যেন ধীরে ধীরে পাততাড়ি গুটাচ্ছে।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক