নিরঞ্জন রায়
আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ। তবে এটাও ঠিক যে খেলাপি ঋণ আমাদের দেশের একার সমস্যা নয়। এটি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। বিশ্বের সব দেশেই খেলাপি ঋণ আছে।
কোথাও বেশি, আবার কোথাও কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংক্রান্ত খেলাপি ঋণ কেলেঙ্কারির কথা সবার জানা। আবার মাত্র কিছুদিন আগে ভারতের ব্যাংকিং খাতে যে খেলাপি ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়েছে তা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথেষ্ট শক্তিশালী এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তদারকি করার ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতা। তাই সেখানে উচ্চ হারের খেলাপি ঋণ মোটেই প্রত্যাশিত ছিল না। ইউরোপের গ্রিস ও ইতালিতে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও তাদের ব্যাংকিং খাত এখনো খেলাপি ঋণ সমস্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্বের অনেক ব্যাংকই এখন আর এই দুটি দেশের ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে আগ্রহ দেখায় না শুধু সেসব দেশের ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে।
ওভারড্রাফট খেলাপি ঋণ সমস্যার অন্যতম কারণ : আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সমস্যার ধরন এবং গভীরতা একটু ভিন্ন। আমাদের দেশের খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এক সমস্যা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ঋণগ্রহীতার কারণে যেমন কোনো একটি ঋণখেলাপি হয়, তেমনি ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেও কোনো ঋণখেলাপি হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে সব ধরনের খেলাপি ঋণের দায়ভার ঋণগ্রহীতাকেই বহন করতে হয়। যেমন—আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে এখনো ওভারড্রাফট হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং খুবই সহজ ঋণদান পদ্ধতি। অথচ এই ওভারড্রাফট পদ্ধতি খুবই সেকেলে এবং এটি যেকোনো ভালো ঋণকে খেলাপি ঋণে পরিণত করতে খুবই সহায়ক ভূমিকা রাখে। ওভারড্রাফটের মধ্যমে গৃহীত ঋণের অর্থ ব্যবহারের ওপর ঋণগ্রহীতা এবং ব্যাংক কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কেউ জানে না বা বুঝতে পারে না যে কোথাকার ঋণ কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ আবর্তনশীল মেয়াদি ঋণ (রিভলভিং টাইম লোন) ব্যবস্থার প্রবর্তন করে খুব সহজেই এই সমস্যার সমাধান করা যায়।
ঋণের সুদ ও কিস্তি : আমাদের দেশে ঋণগ্রহীতারা ঋণের সুদ সাধারণত নগদে পরিশোধ করেন না। ব্যাংকঋণের ওপর প্রদেয় সুদ ঋণগ্রহীতার ঋণ স্থিতির সঙ্গে যোগ করে ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে দেখায়, যা কোনো অবস্থায়ই একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হতে পারে না। এই পদ্ধতিও কোনো ঋণখেলাপি হওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। অথচ সাধারণ নিয়ম হলো যে একজন ঋণগ্রহীতা ঋণের ওপর প্রদেয় সুদ নগদে পরিশোধ করবেন। তা ছাড়া ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদ এবং পরিশোধিত কিস্তির পরিমাণ যেভাবে নির্ধারণ করে তা-ও ত্রুটিপূর্ণ। বেশির ভাগ ঋণগ্রহীতা অর্থের প্রয়োজন থাকায় ব্যাংক কর্তৃক আরোপিত সব শর্ত বিনা বাক্যে মেনে নেয় ঠিকই; কিন্তু বাস্তবতার আলোকে ঋণগ্রহীতা পরবর্তী সময়ে আর সেসব শর্ত পালন করতে পারেন না এবং ঋণের টাকাও সময়মতো পরিশোধ দিতে পারেন না। ফলে ঋণখেলাপি হতে বাধ্য। যেমন—কোনো কম্পানিকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে পাঁচ বা দশ বছর পরে তা পরিশোধ করতে বললে খুব কমসংখ্যক ব্যবসায়ীই এই ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবেন। কেননা ব্যবসায়ীরা কখনোই এত বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়মমাফিক জমা করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। ব্যবসায়ীদের অর্থ সব সময়ই বিনিয়োগের মধ্যে নিয়োজিত থাকে। এ কারণেই প্রদত্ত ঋণের মেয়াদ এবং ঋণের কিস্তির পরিমাণ এমনভাবে নির্ণয় করতে হয়, যাতে করে ঋণগ্রহীতা সহজভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে এই ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করতে পারেন।
সেকেলে পদ্ধতির খেলাপি ঋণ নির্ধারণ : আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করার পদ্ধতিটিও আধুনিক নয়। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সিএল (ক্লাসিফিকেশন অব লোনস) তৈরি করে থাকে, যার মাধ্যমে তাদের প্রদত্ত ঋণের শ্রেণিবিন্যাস করা হয় এবং সে অনুসারে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এতে দেখা যায় খেলাপি ঋণের বিপরীতে সম্পূর্ণ বা শতভাগ প্রভিশন কখনোই রাখা হয় না। ফলে শুরু থেকেই এক ধরনের প্রভিশন ঘাটতি আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোতে বিরাজ করে। অথচ সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের কোন ঋণ খারাপ হতে পারে এমনটা মনে হওয়া মাত্র তার বিপরীতে সম্পূর্ণ প্রভিশন রেখে দেওয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে যদি সত্যিকার অর্থেই সেই ঋণখেলাপি হয় এবং আদায় করা সম্ভব না হয়, তাহলে যেন খেলাপি ঋণ খুব সহজেই অবলোপন করা যায়। কিন্তু এই মানসম্মত নীতির অনুসরণ আমাদের দেশের ব্যাংকিংব্যবস্থায় একেবারে অনুপস্থিত। এ কারণে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম প্রভিশন রেখে বেশি করে মুনাফা দেখিয়ে লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিয়ে যায়। যে কারণে ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে খেলাপি ঋণ ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয় এবং ক্রমাগত এই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ছদ্মবেশী খেলাপি ঋণ : আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ছদ্মবেশী খেলাপি ঋণ একটি মারাত্মক সমস্যা। এখানে ভালো ঋণের অন্তরালে যে পরিমাণ খারাপ ঋণ ছদ্মবেশে আছে তার পরিমাণ নেহাত কম নয়। এই ছদ্মবেশী খেলাপি ঋণ মূলত খেলাপি ঋণ। নানা রকম নিয়মের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে, বিশেষ করে তথাকথিত পুনঃ তফসিলের সুযোগ নিয়ে এসব নিম্নমানের ঋণকে ভালো ঋণ হিসেবে দেখিয়ে দুই ধরনের ক্ষতি সাধন করা হয়ে থাকে। একদিকে এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় না। অন্যদিকে এই ঋণের ওপর অর্জিত সুদ নগদে আদায় না হওয়া সত্ত্বেও ঋণস্থিতির সঙ্গে যোগ করে ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়। শুধু তা-ই নয়, সেই মুনাফার বড় একটি অংশ লভ্যাংশ এবং বোনাস প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকের হিসাব থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এতে করে ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ তো কমেই না, উল্টো দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেননা এসব ছদ্মবেশী খেলাপি ঋণ যখন সত্যিকার অর্থেই খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়, তখন ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত প্রভিশন থাকে না, যা দিয়ে এই খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হবে। এর ওপর আছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, দুর্নীতির মাধ্যমে গৃহীত ঋণখেলাপি, ঋণ জালিয়াতিসহ নানা ঘটনা, যা আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছে।
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা : খেলাপি ঋণসংক্রান্ত অনিয়মগুলো বন্ধ করে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সন্তোষজনকভাবে কমিয়ে আনতে হলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ প্রদান এবং ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এগুলোকে আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলতে হবে। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। আমাদের দেশের খেলাপি ঋণ দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময় ধরে চলে আসা এক পুঞ্জীভূত সমস্যা। তাই রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি এক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তদুপরি এটি এখন এক জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কোনো একটি ব্যাংকের একার পক্ষে এখন আর তার খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান করা মোটেই সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় বিস্তৃত এক কর্মপরিকল্পনা।
খেলাপি ঋণ আদায়ে অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন : খেলাপি ঋণ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘদিনের ঋণ ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতা আছে এমন ব্যাংকারদের নিয়োজিত করতে হবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের দেশে খেলাপি ঋণ আদায়ে অভিজ্ঞ ব্যাংকারের সংখ্যা অনেক কম আছে। বেশির ভাগ ব্যাংকার খেলাপি ঋণ আদায়ের উপায় বলতে শুধু আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় করাকে বুঝে থাকেন। অথচ তাঁরা বেমালুম ভুলে যান যে হাতে গোনা দু-একটি ঋণখেলাপি হলে তা আদালতে মামলা করে আদায় করা যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিনের জমে থাকা বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ মামলার মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব নয়।
লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা