স্বদেশ রায়
উনবিংশ শতাব্দী থেকে পৃথিবীতে যেখানে যত প্রগতিশীল আন্দোলন হয়েছে– তার প্রতি ভারতবর্ষের মানুষ ও বিশেষ করে প্রগতিশীল বাঙালিদের সমর্থন দেখা গেছে সবসময়ই। এমনকি আফ্রিকান আমেরিকানদের ভোটাধিকার দাবির আন্দোলনেও আমেরিকাতে নেতৃত্ব এবং প্রাণ দিয়েছেন বাঙালি মেয়ে। ভারতবর্ষ এখন তিন খণ্ডে বিভক্ত। কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করছি, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কোথাও ইরানি মেয়েদের ব্যক্তিস্বাধীনতার আন্দোলনের সমর্থনে তেমন কোনও কিছু দেখা যাচ্ছে না।
সভ্যতার ইতিহাসের একটা পর্যায় থেকে নারীকেই বন্দি করার একটা চেষ্টা চলমান। অথচ সত্য হলো, এই নারীর হাত ধরেই আজকের এই পরিবার ও সমাজ কেন্দ্রিক সভ্যতা। তারপরেও তাকে বন্দি করার চেষ্টা এবং ধর্ম সৃষ্টি হওয়ার পরে যখনই এবং ধর্ম ও শাসক শ্রেণির মধ্যে মেলবন্ধন হয়েছে তখন থেকেই নারীকে বন্দি করা হচ্ছে আরও বেশিভাবে। নারীকে কেন এই বন্দি করার চেষ্টা তা নিয়ে অনেক গবেষণা ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বিস্তর এর কারণ। তবে খুব সহজভাবে বলা যায়, নারী পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পেলে, সমাজ যেমন প্রকৃত স্বাধীন সমাজ হয় তেমনি সমাজ হয় দুরন্ত গতিশীল। যে সমাজকে ইচ্ছেমতো সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ও শাসক শ্রেণি তার নিজের সুবিধামত ব্যবহার করতে পারে না। এই সুবিধাবাদী, স্বৈর-মানসিকতার স্বার্থেই সভ্যতার একটা পর্যায় থেকে নারীকে বন্দি করা হচ্ছে নানান কৌশলে। তাই সে আচরণ দিয়ে হোক, ধর্ম দিয়ে হোক আর মোহ দিয়ে হোক। এমনকি, এই কৌশল এ পর্যায়ে গেছে যে ইরানের মেয়েরা আজ রাজপথে, তারা অন্তত জানে, ধর্মের নামে রাষ্ট্র তার পোশাকের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সমাজের অনেক শ্রেণির মেয়েরা যে রাতের পর রাত স্বামীর কল্যাণের জন্যে উপবাস পালন করে তার কিন্তু এটুকু ভাবারও ক্ষমতা নেই– স্ত্রীর কল্যাণের জন্যে তো কোনও স্বামী উপবাস করে না!
হাজার হাজার বছর ধরে বাস্তবে এই বন্ধন শুধু শরীরে পরানো হয়নি, মগজের কোষে কোষে বা প্রতিটি নিউরনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি এটা প্রগতিশীল পুরুষের মগজের কোষে কোষেও। এর থেকে বাদ যাননি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সব থেকে প্রগতিশীল নেতা সুভাষচন্দ্র বসুও। চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে যে সময়ে কংগ্রেস ও স্বরাজ পার্টির আন্দোলন তুঙ্গে ওই সময়ে একদিন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী জানান, আগামীকাল তাঁর নেতৃত্বে মেয়েরা মিছিলে গিয়ে গ্রেফতার বরণ করবেন। সুভাষ বসু সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি করে বলেন, আমরা ছেলেরা থাকতে মেয়েরা কেন এই কারাবরণের কষ্ট ভোগ করতে যাবেন। অর্থাৎ ওই হাজার বছরের মগজ। মেয়েদের এখনও ছেলেরা তার সমান উচ্চতায় বা তার থেকে বেশি উচ্চতায় নিতে পারেনি। কিন্তু সেদিন এই হাজার বছরের রক্তের বাইরে গিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেছিলেন, ‘দেখ, সুভাষ যতদিন মেয়েরা সমানভাবে সবকিছুতে অংশগ্রহণ করতে না পারবে ততদিন ভারতবর্ষ প্রকৃত স্বাধীন হবে না।’ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বহু মেয়ে অংশ নিয়েছিলেন। তাই ভারতবর্ষ এক ধরনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা পায়। কিন্তু নারী পশ্চাতে থাকার কারণে স্বাধীন জনগোষ্ঠী হতে পারেনি। আমাদেরও ষাটের দশকে, সত্তরের দশকে বহু মেয়ে রাজপথে নেমেছিলেন বলেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জনগোষ্ঠী যে প্রকৃত স্বাধীন হয়নি তার প্রমাণ তো এ মুহূর্তে এই ইরানের মেয়েদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বোঝা যাচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পীঠস্থান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে বহু মেয়ে রাইফেল নিয়ে মার্চ পাট করেছে। যেখানে বহু মেয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মিছিলের সামনের সারিতে থেকেছে- সেখানে আজ ইরানের মেয়েদের ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে কোনও সংহতি নেই।
তাই ইরানের মেয়েদের এই ব্যক্তিস্বাধীনতার আন্দোলন দুটো বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে আসছে। এক, ইরানে ধর্মের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে রাজনীতি ও শাসন ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে রাখার ফলে সেখানে মেয়েরাই ব্যাপকভাবে রাজপথে এসেছে। তারা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে অনেক ইনোভেটিভ প্রতিবাদ করছে। ইরানে শিশুসহ ৮ হাজার নারী গ্রেফতার হয়েছে, ২’শ বা তার কিছু কম বেশি নারী মারা গেছে। তারপরেও তারা প্রতিবাদ করছে। অর্থাৎ যেসব দেশে ধর্মে ও সামাজিক আচরণের কারণে নারীর স্বাধীনতা নেই সে সব দেশের মধ্যে ইরানেই এবার নারীরা বড় আকারে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এ আন্দোলনও হয়তো রাষ্ট্রীয় শক্তি একপর্যায়ে নির্মমতা দিয়ে দমন করতে সমর্থ হলেও হতে পারে। তবে সেখানে নারীরা ৭৯ থেকে যে ব্যক্তিস্বাধীনতার আন্দোলন বারবার করার চেষ্টা করছে এটা তার ভেতর সব থেকে বড় আন্দোলন। তাই আজ না হোক কাল তাদের জন্যে সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু এর বিপরীতে এখান থেকে মাত্র কয়েক দশক আগেও যে ভারতের সিভিল সোসাইটি সারা পৃথিবীর প্রগতিশীল আন্দোলনকে সমর্থন করতো তারা এখন ইরানের বিষয়ে প্রায় নিশ্চুপ। নিশ্চুপ উনবিংশ শতাব্দীর রেনঁসার পীঠস্থান কলকাতা, পাকিস্তানেও নেই আসমা জাহাঙ্গীর বা ফায়েজ আহমদের মতো প্রগতিশীলরা। আর সব থেকে আশ্চর্যজনক হলো যে বিশ্ববিদ্যালয়টির একক কৃতিত্ব একটি ভাষা আন্দোলন ও একটি স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরও নিশ্চুপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিশ্চুপতা কিন্তু আগামী দিনের বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির জন্যে এক অশনি সংকেত। এই অশনি সংকেত শুধু একটি ক্ষেত্রে নয়, অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে। বিস্তারিত একটি কলামে লেখা সম্ভব নয়। কলামের শিরোনামে উল্লেখ করেছি, আগামী নির্বাচনের কথা। এ কারণে নির্বাচনের জন্যে কী সংকেত দেয় তা একবার ভেবে দেখা যেতে পারে।
বাংলাদেশে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ অবধি নির্বাচনের মধ্যে তিনটি নির্বাচন তুলনামূলক ভালো নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮-এর নির্বাচন। এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটি নির্বাচনেও প্রশাসনের সূক্ষ্ম সমর্থন কোনও না কোনও পক্ষের প্রতি ছিল। তারপরেও একটু বিশ্লেষণ করলে, ১৯৯১ এবং ২০০৮-এর নির্বাচনে অভাবনীয় নির্বাচনি ফল দেখা যায়। ১৯৯১ মাঠের একজন সাংবাদিক হিসেবে ওই সময়ে ঢাকার বস্তি, পুরানো ঢাকার নারিন্দা ও ধোলাই খাল এলাকা, অন্যদিকে বিক্রমপুর ও নোয়াখালীর গ্রাম এবং কমলাপুর রেল স্টেশনের রেলের যাত্রী– প্রতিটি স্থানে সাধারণ দরিদ্র মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে– আর সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হল ও রোকেয়া হলের শিক্ষিত মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েরা খালেদা জিয়াকে ভোট দিতে চায়। তবে সেটা বুঝতে হচ্ছিলো তাদের কথার ধরন থেকে। প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। ১৯৯৬ সালে মহিলাদের ওভাবে কোনও দলের প্রতি বেশি আকর্ষণ দেখা যায়নি। আর ২০০৮-এর নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগের থেকে যেমন তেমনই নির্বাচনের দিনে, মানিকগঞ্জ, সাভার, বিক্রমপুর, ঢাকার কেরানিগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর সর্বত্র সাধারণ মহিলারা প্রকাশ্যে বলতে থাকেন, এবার ভোট দেব শেখ হাসিনাকে। কেউ বলেন, শেখের বেটিকে। এর থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়, ১৯৯১-এ সকল রাজনৈতিক বিশ্লেষণের বিপরীতে বিএনপি যে বেশি আসন পায় তার অন্যতম কারণ ছিল এই মহিলাদের ভোট। আবার ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ একাই ২৩০ এবং তার জোট যে সংসদের মোট ৩’শ আসনের মধ্যে ২৭০ আসন পায় তারও অন্যতম কারণ ছিল মহিলাদের ভোট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৮ তারিখ তাঁর দলীয় সাংগঠনিক সভায় বলেছেন, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ বা তার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের জন্যে কঠিন হবে। একটি নির্বাচনে জয় পরাজয় অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। কোনও একটি কারণের ওপর নির্ভর করে না। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সরকারি দল ও তার জোটকে অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। তবে ইরানের নারীদের ব্যক্তিস্বাধীনতার আন্দোলন ও বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের নিশ্চুপতাকে বিশ্লেষণ করে আগামী নির্বাচনে গ্রাম ও শহরের মহিলাদের ভোটের একটা ধারার ইঙ্গিত খুঁজে দেখার মনে হয় সময় এসেছে। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর দেখে কি গ্রাম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অধিকাংশই এসেছে কোনও না কোনও গ্রামের পরিবার থেকে। তাই তারা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের নয়, গ্রামের পরিবারের প্রতিনিধিত্বও করে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।