স্বদেশ রায়
যুদ্ধে ও নিজস্ব আধিপত্য ধরে রাখা এবং তার বিস্তারের কাজে স্যাংকশনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই প্রাচীন গ্রিসের সিটি স্টেটের আমল থেকে। যেকোনও নতুন শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ছাড়া তখনও এ অস্ত্র ব্যবহার হতো। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই অনেক বড় অস্ত্র হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকা অর্থনৈতিক স্যাংকশনকে যেকোনও সরাসরি যুদ্ধে ও কোল্ড ওয়ারে ব্যবহার করে আসছে। তাদের দেশের অনেক ডিফেন্স ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, সরাসরি যুদ্ধের থেকে অর্থনৈতিক স্যাংকশনের ক্ষমতা অনেক বেশি। কারণ, এতে বেশি সংখ্যক সাধারণ মানুষকে কোনোরূপ মারণাস্ত্র প্রয়োগ না করে ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়। যাতে করে প্রতিপক্ষ অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইউরোপ বেশি ক্ষেত্রে শুধু যুদ্ধে অর্থনৈতিক স্যাংকশনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে আমেরিকা উইলসন ও জেফারসনের আমল থেকেই মনে করে, তাদের গণতান্ত্রিক নীতি পৃথিবীতে যত বেশি প্রতিষ্ঠিত করা যাবে ততই আমেরিকা শক্তিশালী হবে। বিশ্বে তার আধিপত্য বজায় থাকবে। এবং সেটা আমেরিকার সামরিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতেও সহায়ক হবে। এ কারণে শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত বা রুগ্ন গণতন্ত্রকে সংস্কার করাও তাদের কূটনীতির অংশ হিসেবে মনে করে। আর এসব কাজেই তারা স্যাংকশনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। আমেরিকার প্রতিপক্ষ হিসেবে যেকোনও ধরনের শক্তিশালী একনায়কতন্ত্রের প্রভাব যখনই কোনও না কোনোভাবে বেড়েছে তখনই আমেরিকাকে সরাসরি হস্তক্ষেপের বাইরে এই স্যাংকশনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। বর্তমানে আমেরিকা তার প্রতিপক্ষ হিসেবে দুটো একনায়কতন্ত্রকে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখছে। এক. রাশিয়া। দুই. চীন। পুতিনের রাশিয়া তাদের জন্যে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যেহেতু পুতিন তার ‘বেলি স্টেট’গুলোকে সম্মান না করে বরং তার বেলি স্টেটের একটি ইউক্রেনকে গ্রাস করার জন্যে সরাসরি যুদ্ধে নেমেছে। অন্যদিকে, আমেরিকা মনে করছে এশিয়া ও আফ্রিকার যে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতন্ত্র বিকাশের বিপরীতে গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন সৃষ্টি হচ্ছে, এর পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তার নামে অনিয়ন্ত্রিত ও অনৈতিক বাণিজ্য। তাদের মতে, চীন ওইসব দেশগুলোতে অনৈতিক অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলছে। যার ফলে রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্রের যেমন বিকাশ ঘটছে না তেমনি অনৈতিক অর্থের কারণে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ও শক্তি চলে যাচ্ছে নীতিহীন কিছু লোকের হাতে। যে অর্থ শুধু ওই দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, অন্য দেশকেও করছে। এ কাজগুলো আমেরিকার সংজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত বা রুগ্ন গণতন্ত্রের মধ্যে পড়ে। তারা এগুলো সংস্কারের জন্যে স্যাংকশনকে ব্যবহার করছে। বর্তমানে তাদের কাজ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, ট্রাম্পের চার বছরে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আমেরিকার দৃষ্টি না থাকার কারণে অনেক দেশে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত বা রুগ্ন বলে তারা মনে করছে। এগুলো সংস্কার করার জন্যে বাইডেন প্রশাসন শুরু থেকেই তৎপর। আর ডেমোক্র্যাটরা সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরে সে দেশের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, বাইডেনকে আরও বেশি বিদেশ নীতিতে জোর দেওয়া উচিত।
অন্যদিকে, চীনের ‘উল্ফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসি’তে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব ফোরামের আজ থেকে বিশ বছর আগের চীনের কূটনীতিকদের সেই নীরব বা সংকুচিত অবস্থান আর নেই। ওয়ার্ল্ড ফোরামে তারা নিজেদের বড় শক্তি হিসেবে উপস্থিত করছে। যেকোনও দেশের যেকোনও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে তারা কোনও দ্বিধা করছে না। অবশ্য বেশ কৌশলে তারা নিজেদের এ মুহূর্তে কোনও সামরিক অভিযান বা সশস্ত্র যুদ্ধের সঙ্গে জড়ানোর বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে– তাই সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হোক, তার তাইওয়ান সম্পর্কিত উত্তেজনা হোক। এমনকি দোকলামে ভারতের সঙ্গে কিছুটা সীমান্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও তারা সেটা অনেকখানি মিটিয়ে নিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির পরে আরেকটি শক্তি যে সামরিক শক্তি সেটাকে তারা মোটেই অস্বীকার করছে না। বরং তাদের সেখানে যে উত্থান হচ্ছে তাও তারা বিশ্বকে দেখাতে পিছপা হচ্ছে না। আমেরিকার স্যাংকশনের ও চীনের উল্ফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসির প্রকাশ ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও চীন দুই দেশই করেছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রশ্নে কয়েকজন র্যাব কর্মকর্তার ওপরে আমেরিকা স্যাংকশন দিয়েছে। এই স্যাংকশন প্রশ্নে তারা এখনও অনমনীয় থাকলেও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটে পরোক্ষভাবে আমেরিকা এগিয়ে এসেছে। কারণ, এ সত্য মানতে হবে আমেরিকার কোনোরূপ অদৃশ্য বিরোধিতা থাকলে আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে এগিয়ে আসতো না। এখানে আমেরিকার এই সদিচ্ছার অন্যতম কারণ ‘চীন’। আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সহযোগিতার শর্তই দিয়েছে অর্থনৈতিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। হয়তো তারা মনে করছে, অর্থনৈতিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরলে চীনের অনেক অনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে বন্ধ হবে বা কমবে। এর ফলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাবও কমবে বাংলাদেশের ওপর থেকে।
অন্যদিকে উল্ফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসি বাংলাদেশের প্রতি ইতোমধ্যে পরোক্ষভাবে আমেরিকা ও প্রত্যক্ষভাবে চীন প্রয়োগ করেছে। চীনের মিডিয়া বিভিন্ন সময়ে পদ্মা সেতুকে তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভের অংশ হিসেবে বলছে। তাদের দেশের থিংকট্যাংকরাও একই কথা বলছেন। বাংলাদেশের তরফ থেকে নানানভাবে এ ধরনের কথা না বলার জন্যে বলার পরেও তারা তাদের অবস্থানেই থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রদূত তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন অনেকটা নিজের ইচ্ছেমতো। কারণ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, চীনের রাষ্ট্রদূত সেখানে গেছেন সেটা তিনি মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছেন। চীনের রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকরা শুধু বাংলাদেশে নয়, অনেক দেশেই এমনভাবে কাজ করছেন। অবশ্য এটা পৃথিবীতে নতুন নয়। আগের পরাশক্তির (আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন) রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকরা এ ধরনের কাজই ভূরি ভূরি করতেন। তারা বিভিন্ন দেশে দিনের আলোয় ও রাতের অন্ধকারে তাদের ইচ্ছেমতোই চলাচল করতেন। এবং ওই রাষ্ট্রের অনেক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত হতেন। সে সময়ে তারা এই উল্ফ ওয়ারিয়র কূটনৈতিক পদ্ধতিই ব্যবহার করতেন। তারা হয়তো সেদিন রাজনৈতিক নেতার মতো প্রেসকে বলতেন না। চীনের রাষ্ট্রদূত এবার প্রেসকে অনেক কথা বলেছেন। তবে তার ভেতর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘চীন তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে অপেক্ষা করছে। কারণ, তারা এ প্রকল্প নিয়ে অন্য দেশের চাপের বিষয়টি দেখতে চায়।’
নির্বাচনের এক বছরের কিছু বেশি সময় আগে এই অপেক্ষার কথা বলার ভেতর অনেক ইঙ্গিত থাকে। নির্বাচনসহ অনেক কিছুই সে ইঙ্গিতের মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সব থেকে বড় ডোনার জাপানের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। ২০১৮-এর নির্বাচনের অনিয়ম ও রাতের বেলা পুলিশের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভরা হয়েছে- এমনটিই তিনি বলেছেন। জাপান তার নিজ দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি তাদের নিজের মতো করেই পরিচালনা ও পরিবর্ধন করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে সবসময়ই জাপান আমেরিকার কথামতোই চলে। যে কারণে রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থানের ক্ষেত্রে অনেকেই জাপানকে এশিয়াতে আমেরিকার আরেকটি মুখ হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকেন। জাপানের এই অবস্থান আরও সক্রিয় হয়েছে ‘কোয়াড’ গঠনের পরে এবং চীনের চলমান উত্থানের কারণে। কারণ, কোয়াড বা এই ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের কাছে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাদের কাছে বঙ্গোপসাগরও গুরুত্বপূর্ণ। তাই জাপানের মুখে নির্বাচন প্রসঙ্গে এ কথা অবশ্যই চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের মতোই নানাদিক থেকে ইঙ্গিতপূর্ণ। এছাড়াও জাপানের রাষ্ট্রদূতের এ কথা- জাপান ও আমেরিকার মিলিত কথা হিসেবেও যদি কেউ বিশ্লেষণ করেন, তিনি খুব বেশি ভুল করবেন না।
রাজনীতি বা কূটনীতিতে বড় রাষ্ট্রগুলোর এই কাজ ঠিক কিংবা বেঠিক সে বিতর্কে না গেলেও এটা সত্য, সবসময়ই ছোট ইঁদুরগুলো শিকার করা বিড়ালের পক্ষে সহজ। আর এ শিকার বিড়াল তার নিজের প্রয়োজনেই করে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।