Search
Close this search box.

একান্ন বছর পেরিয়ে বিজয় দিবসে কী ভাবতে পারি

একান্ন বছর পেরিয়ে বিজয় দিবসে কী ভাবতে পারি

স্বদেশ রায়

পঞ্চাশটি বিজয় দিবস পার করে জাতি আজ ৫১ তম বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ বিজয় দিবসে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিলো তারও বয়স ৫১ হতে চলেছে। সাধারণত এমন একটি সময়ে দাঁড়িয়ে কোনও জাতি কীভাবে বিজয় দিবস পালন করে? তাদের গর্বটি কোথায় থাকে? তাদের দুঃখগুলো কোথায় থাকে? বাঙালির বিজয় দিবসের মাত্র একদিন আগে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বিজয়ের আগে অনেক বড় বড় শোকের দিন বিভিন্ন রাষ্ট্রবিপ্লবে দেখা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসটি জাতি অনেক শোক ও অনেক আবেগের সঙ্গে পালন করে। তখন বলা হয়, জাতি হিসেবে আমাদের ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে, আমরা যাতে বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি হিসেবে দাঁড়াতে না পারি, সেজন্য বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিলো। আজ থেকে ৫০ বছর আগে যখন বলা হতো বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিলো তখন সেটা যেমন সত্য ছিল আর এখন শুধু কেন তাদের হত্যা করা হয়েছিলো তার কারণ হিসেবে এটা সত্য। পাশাপাশি আজ এটা চরম সত্য হওয়া উচিত যে, পঞ্চাশ বছরে জাতি সেই বুদ্ধিবৃত্তিক ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছে। বাঙালির কয়েকটি প্রজন্মের নতুন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী দাঁড়িয়ে গেছে। বাঙালি আজ যদি চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তারা ১৯৭১ সালে যে মাপের বুদ্ধিজীবীদের হারিয়েছিলো সেই মাপের বা তার থেকেও অনেক ক্ষেত্রে অনেক বড়মাপের বুদ্ধিজীবী তারা সৃষ্টি করতে পেরেছে তাহলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগও সফল হয়েছে, সফল হবে বিজয় দিবস পালন করা।

বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজন্ম থেকে যে নতুন নতুন প্রতিনিধি দাঁড়ায়নি এমনটা বলা ঠিক নয়। দাঁড়িয়ে গেছে। তারা সমাজকে ও জাতিকে অনেক কিছুই দিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা সত্য যে, পঞ্চাশ বছরে একটি স্বাধীন ও রাষ্ট্রবিপ্লবে বিজয়ী দেশে যে মাপের, যে সংখ্যক বুদ্ধিজীবী দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেটা হয়নি। এই না হওয়ার কারণ বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিপ্লবের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রতিবিপ্লব হয়। আর প্রতিবিপ্লবীরা টানা একুশ বছর ক্ষমতায় থাকে। শুধু যে টানা একুশ বছর ক্ষমতায় থাকে তা নয়, তারা অনেক কিছু বদলে দিতে সফল হয়েছে। বিশেষ করে চিন্তার জগতে তারা এই পরিবর্তন আনতে সফল হয়েছে। রাষ্ট্রবিপ্লবের জন্যে টানা ২২ বছরের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জাতি যে হেজিমনি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো, রাষ্ট্রবিপ্লবের ভেতর দিয়ে যা শুরু হয়েছিলো, তার বেশি অংশ প্রতিবিপ্লবীরা বদলে দিতে সমর্থ হয়েছে। শুধু তারা রাষ্ট্রের মানুষের একটি অংশের মধ্যে বদলে দেয়নি, যে মানুষেরা রাষ্ট্রবিপ্লবে অংশ নিয়েছিলো, যারা তাদের উত্তরাধিকার বলে দাবি করে, তাদেরও মনোজগতে প্রতিবিপ্লবীদের হেজিমনি বা সংস্কৃতির ধারা তারা প্রবাহিত করতে সমর্থ হয়েছে। যে কারণে জাতি যখন ৫১ তম বিজয় দিবস পালন করতে যাচ্ছে সে সময়ে সংস্কৃতির বড় ধারাটি প্রতিবিপ্লবী ধারা। আর এই সংস্কৃতির ধারা তারা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে শক্তভাবে গোটা জাতির চিন্তাচেতনায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে বলেই এখনও মনে হয়, ১৯৭১ সালে যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জাতি হারিয়েছে তাদের স্থান পূরণ হয়নি। বাস্তবে বাঙালি জাতি এখন যে অবস্থানে আছে তাতে খুব সহজে কেন, কোনও দিন যে তাদের অভাব পূরণ হবে তা কেউ বলতে পারে না। কারণ, বাঙালির রাষ্ট্রবিপ্লবের মূল চেতনা ছিল একটি আধুনিক জাতি গড়া, একটি আধুনিক চেতনাপ্রবাহ তৈরি করা। সেখান থেকে বাঙালি এখন অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে। আর শুধু প্রতিবিপ্লবী চেতনা জাতিকে এখানে নিয়ে গেছে তাও নয়, বর্তমানের বিশ্ব-রাজনীতি ও সংস্কৃতির-চেতনার পরিবর্তনও বাঙালির এই চেতনা পরিবর্তনকে সাহায্য করছে, সাহায্য করছে এগিয়ে যেতে প্রতিবিপ্লবের সংস্কৃতি ধারাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর যেখানে যেখানে ৫০, ৬০, ৭০ ও ৮০’র দশকে রাষ্ট্রবিপ্লব হয়েছিলো সবখানেই এখন বদলে গেছে সে চেতনা। কিউবাতে একদিন ফিদেল যে মাপের জনসভা করেছিলেন সেই মাঠে সেই মাপের জনসভা এখন করেন পোপ। এই বদলে যাওয়া পৃথিবীতে বাঙালি তার ৫১তম বিজয় দিবস উদযাপন করছে।

এখন এই ৫১তম শহীদ ও বিজয় দিবসের সব থেকে বড় বিষয় হলো বাঙালি কী করবে? বাঙালি কি প্রতিবিপ্লবী এই সংস্কৃতির ধারাও বদলে যাওয়া পৃথিবীর হাওয়া নিয়ে এগিয়ে যাবে, না তার রাষ্ট্রবিপ্লবের শেকড়ে পা রেখে বর্তমান পৃথিবীর পথে ভালো ও মন্দকে বাছাই করে সে ভালোর পথে এগিয়ে যাবে? লেখার শুরুতেই বলেছি, বাঙালি ৫১তম বিজয় দিবস কীভাবে পালন করবে? যদি অন্যান্যবারের মতো শুধু আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে সে বিজয় দিবস পালন করে তাহলে সে পালনের অর্থ হলো কেবলই একটি রাষ্ট্রাচার রক্ষা করা। আর যদি বাঙালি ৫১তম এই বিজয় দিবসে অন্তত এই আত্ম-উপলব্ধিটুকু করতে পারে যে, সংস্কৃতির ধারায় এখনও প্রতিবিপ্লবীরা এ দেশে বিজয়ী, যাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে বিপ্লব ছিল, ২২ বছরে যে চিন্তাধারার বিরুদ্ধে আধুনিক চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম করেছিলো জাতি, তাদের চিন্তাধারাই সচেতন বা অবচেতনভাবে বহন করা হচ্ছে, করে চলছে গোটা জাতি। এই উপলব্ধি ছাড়া যদি বিজয় দিবস পালিত হয় তাহলে সেখানে দুঃখগুলো বড় হয়ে ভেসে উঠবে। সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সেই দুঃখের দীর্ঘশ্বাসই বড় হয়ে দেখা যাবে। আর এখানেই জাতির দুঃখগুলো বড় হয়ে দেখা দেবে।

আর গর্ব! গর্বগুলো ফিরে আসতে পারে শুধু সেই পথে যদি এ জাতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আধুনিক জাতি গড়ার জন্যে বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি করতে পারে। মনে রাখা দরকার, যে জাতির স্কলার নেই ওই জাতি পৃথিবীতে টিকে থাকে না। এমনকি এটাও মনে রাখা দরকার, কোনও মানুষের মধ্যে যদি তিল পরিমাণ হলেও আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তি কাজ না করে তাহলে সে যতই মানুষের মতো দেখতে হোক না কেন সে মানুষ নয়। তাই জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে হলে বা একটি নরগোষ্ঠী হিসেবে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে হলে তাকে প্রতিটি প্রজন্মে বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ সৃষ্টি করে যেতে হয়। ৫১তম শহীদ দিবসে ও বিজয় দিবসে গর্বগুলো ফিরে আসার নতুন আলো দেখা যাবে যদি আধুনিক নরগোষ্ঠী গড়ে তোলার চেতনা কিছুটা হলেও জাগ্রত করার পথে জাতি হাঁটা শুরু করতে পারে।

লেখক- একুশে পদকপ্রাপ্ত সিনিয়র সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ