জিনাতুন্নেসা সরকার
স্বাভাবিক জীবনে পশু-পাখি যতটা আত্মনির্ভর, মানুষ কিন্তু তা নয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আত্মনির্ভরতা ও পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে আমরা গড়ে তুলেছি আন্তর্জাতিক বিশ্ব। শান্তি ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের সকল নারীর জন্য রইল আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এই দিন সারা বিশ্ব ব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ। আসলে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে নারীর অর্জন বা এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্যপট সচেতন ভাবে সকলের ভাবনায় আনা। যেহেতু এখনও নারীর প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা পুরোপুরি লাভ করা যায় নি। তাই একটি দিন উদযাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্বসমাজকে দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করা।
মানু্ষ হিসেবে শুধু নিজেদের প্রতি নয়, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি এবং দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ থাকা প্রয়োজন। এ দায়িত্ব হচ্ছে মানবিক। এই দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য মনের বিকাশ দরকার। আর মনের বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিক্ষার।
আজও আমাদের সমাজে কিছু সংকীর্ণমনারা মনে করে নারীর নিজের কোন ইচ্ছা বা স্বপ্ন থাকা উচিৎ নয়। নারীর প্রধান দায়িত্ব পরিবার ও সমাজের চাহিদা পূরণ করা। নারী যখন সংকটে পড়ে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে নিজের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই করে। তখনো সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের অলিতে গলিতে প্রতি মুহূর্তে নিষ্ঠুরতার শিকার হয় নারী। তারপরও যারা এগিয়ে যেতে চায় বা এগিয়ে যায় তাদের হতে হয় বৈষম্যের শিকার। সাহসের সাথে অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে তবেই তাঁরা এগিয়েছে। সহজ ভাবে নারী কিছুই পেতে পারে না। শিক্ষার আলো পেতেও বলা হয় এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। এটা তো সুযোগ নয় অধিকার।
পুরুষতন্ত্র কেবল পুরুষ নয়, নারীর চিন্তা চেতনায় ও রয়েছে। কিছু সম্পর্কের বেড়াজালে নারী দ্বারা নারী নিগ্রহের ঘটনা আজো আমাদের সমাজে টিকে আছে। তাই নারী-পুরুষ উভয়েরই এই প্রথাগত মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা অনেক এগিয়েছি। কিন্তু পারিবারিক সমর্থন ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ায় নারীর অবদানকে ছোট করে দেখার প্রবণতা এখনো রয়ে গেছে। ছোট বেলা থেকেই ছেলে বা মেয়েকে শেখানো হয়, সে কি করবে, কি করবে না। সমাজ ও পরিবার ছেলে মেয়েদের জন্য আলাদা আলদা নিয়ম করে দেয়। যা মোটেও ঠিক নয়। নারীর নিজের অধিকার, সম্মান ও সত্ত্বাকে চিনতে হবে। নারী-পুরুষ সকলের মানসিকতায়ও চিন্তা-চেতনায় সুস্থ পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের লক্ষ্য রাখতে হবে সবক্ষেত্রে যেন পরিপূর্ণ ভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় নারী। এবং নারী-পুরুষ সকলের আন্তরিকতায় নারী বান্ধব কর্ম পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে আমরা ইতিবাচক ফল পেতে পারি।
অতএব, নারীর এগিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষা, যোগ্যতা ও সচেতনা বাড়াতে হবে। আমরা একে অন্যের পাশে থাকবো, আন্তরিকভাবে সাহায্য সহযোগিতায় করবো। কেবল সমতার জন্য নয়, ন্যায্যতার চর্চাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। জাতির কল্যাণে জাতীয় জীবন থেকে বৈষম্য দূর করা এবং মানবিকবোধের চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাই আমাদের লক্ষ্য। তাই আমাদের সুস্থ, সুন্দর জীবনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা, আইনগত অধিকার নিশ্চিত, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও মানবিকতার বিকাশ ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই।
একটি পরিবারে নারী ও পুরুষের ভূমিকা যেমন সমান গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও নারী-পুরুষের সমান প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি নারীর অগ্রযাত্রার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ ও চর্চার ক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়েছি। আমাদের সরকার প্রযুক্তি নির্ভর একটি আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যার ফলে বর্তমানে নারী ও পুরুষের সম অবস্থান প্রায় নিশ্চিত হয়েছে। জাতির উন্নয়নে নারী-পুরুষ যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতিচর্চায়, বিজ্ঞান গবেষণায়, রাজনীতিতে, খেলাধুলায় এমনকি পাহাড় চূড়া অরোহণে নারীরাও থাকছে পুরুষের পাশে।
শুধু নারী বা পুরুষ নয়, সবার আগে আমরা মানুষ। মানব জীবনের পরিপূর্ণতা পেতে হলে বিচার বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার দ্বারা মানুষ হিসেবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্ব এগিয়ে চলেছে। এদেশের নারীরাও বসে নেই। নিজের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, মেধা ও সামর্থকে কাজে লাগিয়ে উপার্জনমূলক কাজ করছে এবং অন্যকে উপার্জনে সহায়তা করছে। আজ তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে নারী ঘর সামলানোর পাশাপাশি ঘরে বসেই বিভিন্ন ধরনের আজ ও ব্যবসা করে নিজে যেমন লাভবান হচ্ছে। তেমনি পণ্য আনা নেয়ার কাজে অনেক বেকার যুবকেরাও খুঁজে পেয়েছে উপার্জনের পথ। অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে নারীরা আজ আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে যা নিঃসন্দেহে জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে সমাজকে প্রভাবিত করবে।
আমরা আশাবাদী প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে আগামীর পথ চলায় আমরা সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দময় জীবন উপভোগ করতে সক্ষম হবো।
সবশেষে আমাদের জাতীয় কবি, সাম্যের কবির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই –
“কোন কালে একা হয় নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষী নারী।”
লেখক – শিক্ষক