সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
কার সাথে সংলাপ করব? সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কাতার সফর শেষে আলোচিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে একথা বলেছেন। কিন্তু রাজনীতিতে কি সংলাপ একেবারে হয় না? নিশ্চয়ই হয়। যেমনটা হয়েছিল ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে আমি সংলাপ করেছি। তার ফল কী? নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। বিএনপি তো তার নিজের গঠনতন্ত্র নিজে ভঙ্গ করছে। তাদের গঠনতন্ত্রে আছে যে, সাজাপ্রাপ্ত আসামি দলের নেতা হতে পারে না, কিন্তু তারা সেই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেই দলের নেতা বানিয়ে রেখে দিয়েছে। এখন সেই দলের কাছে কী আশা করবেন?’
এর দুই দিন পর প্রতিক্রিয়া এসেছে বিএনপি থেকেও। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়ে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে কোনো সংলাপে বিএনপি যাবে না।
রাজপথে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করার অর্থ হলো সহিংসতার পথে চলা। সহিংসতা মানে সম্পদ ধ্বংস, মানুষের জানমালের ক্ষতি, অর্থনীতির গতি স্তব্ধ হওয়া। এখানেই সংলাপের গুরুত্ব। যে রাজনীতি সংলাপকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, সে রাজনীতি ও তার নেতারা অপ্রিয় সত্য শুনতে সক্ষম। তাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, সত্য ভাষণের ভিত্তিতে যে আলাপ, তাতে ঝুঁকি আছে; কিন্তু সুফল অনেক।
বোঝা গেল আগামী নির্বাচনের আগে সংলাপের ব্যাপারে অনাগ্রহ দুই পক্ষ থেকেই যদিও ২০১৮-সালে চরম বৈরি পরিবেশেও ঘটা করে সংলাপ হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে বিএনপি নেতারা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে দেখা করেছিলেন।
আমরা জানি যোগাযোগ, কথোপকথন, সংলাপ, কথাবার্তা রাজনীতিতে পরিচিত শব্দ, রাজনৈতিক কাজকর্মের অঙ্গ। কিন্তু কথোপকথন বা সংলাপকে ঘিরেও আবার রাজনীতি হয়, সংলাপকে সম্বল করে সমস্যার সমাধান হয়। সংলাপ একেবারে হবেনা, এমন ভাবনায় আমরা বিচলিত।
সংলাপী রাজনীতি এবং প্রশাসন পদ্ধতির অবয়ব, রূপ ও চরিত্র নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা কেন ভাবেন না সেটা আলোচনার বিষয়। নিশ্চয়ই এর কারণ আছে। আমাদের রাজনীতিতে বেশ কিছু বিষয় আছে যা দুটি বড় দল তথা দুটি পক্ষকে একেবারে তীক্ষ্ণভাবে বিভাজিত করে রেখেছে। একটি হলো মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ শক্তি আমাদের রাজনীতিতে বাস্তবতা এবং সেটি দিন দিন আরও পরিষ্কার হচ্ছে।
আরেকটি ঘটনা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এদিন একাত্তরের পরাজিত শক্তি স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন নস্যাৎ করে দিয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডর সাথে কোন কোন রাজনীতির সংশ্রব, ব্যক্তি ও দলের সমর্থন ও ভূমিকা, সেই রাজনীতিকে ধারণ করা, সর্বোপরি ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি ও ১৯৭৫-এর দায়ী গোষ্ঠিকে মন্ত্রী এমপি বানানোর রাজনীতি বিভাজন রেখা টেনে রেখেছে রাজনীতিতে।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬-এ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সর্বশেষ বড় ঘটনা একুশে আগস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দলের পুরো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বিলীন করে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করানো হয়েছিল।
বেগম খালেদা জিয়ার সরকার এই ভয়ংকর ঘটনার বিচার করেনি, বরং বিচারকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়া নাটক করেছিল এবং এখনও এর দায় দায়িত্ব না নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে হিংসার পরিবেশ জিইয়ে রাখছে। যেটুকু আলোচনার জায়গা ছিল, একুশে আগস্টের ঘটনা সেটুকু নষ্ট করে চিরস্থায়ীভাবে রাজনীতিকে বিভক্ত করেছে।
তবুও সংকট কাটাতে আমরা সংলাপ চাই। সংলাপ যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না তার প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালে সংলাপ করেছিলেন। একুশে আগস্টের ভয়াবহ স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে, তবুও তিনি বসেছিলেন তাদের সাথে।
একতরফা রাজনীতি, অসংলাপী রাজনৈতিক আচরণ এবং সমাজকে কুক্ষিগত করে তার বহুত্বকে নষ্ট করার কুফল আমাদের জানা বলেই সংলাপের রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হই আমরা। কারণ, সমস্যাকে কেন্দ্র করেই সংলাপ হয়। খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় দু’পক্ষের সমান লাভ হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে সংলাপ করতে হয় মানুষকে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দিতে।
আগামী সংসদ নির্বাচনের সময় আর বেশি নাই। একটা অনঢ় অবস্থান আমরা দেখছি বড় দুই দলে। শাসক দল আওয়ামী লীগ বলছে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং সবাইকে নির্বাচনে আসার আহ্বানও জানিয়ে রেখেছে দলটি। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, তারা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। এবং দলটির নেতারা বলছেন, এই সংকটের ফায়সালা হবে রাজপথে।
রাজপথে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করার অর্থ হলো সহিংসতার পথে চলা। সহিংসতা মানে সম্পদ ধ্বংস, মানুষের জানমালের ক্ষতি, অর্থনীতির গতি স্তব্ধ হওয়া। এখানেই সংলাপের গুরুত্ব। যে রাজনীতি সংলাপকেন্দ্রিক হয়ে উঠে, সে রাজনীতি ও তার নেতারা অপ্রিয় সত্য শুনতে সক্ষম। তাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, সত্যভাষণের ভিত্তিতে যে আলাপ, তাতে ঝুঁকি আছে; কিন্তু সুফল অনেক।
সংলাপ হয়ে উঠুক রাজনীতির পদ্ধতি বা স্টাইল। আমাদের রাজনীতিকরা কোন পথে হাঁটবেন, তাঁরাই জানেন। কিন্তু সমাজে কথোপকথনের যে চাহিদা তার প্রবণতা ক্রমশ গতি পাচ্ছে, তাকে বিচারের মধ্যে আনতেই হবে। যদি আমাদের এখনকার রাজনীতিকরা সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন, তাঁরা সাধুবাদ পাবেন। তবে উপরে বর্ণিত তিনটি প্রেক্ষাপট – ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫-এর বিয়োগান্ত ঘটনা এবং ২০০৪ সালের একুশ আগস্ট নিয়ে জড়িত পক্ষের দায় নেওয়ার ভাবনা না এলে সংলাপ সফল হবে না, রাজনীতিও বিভাজনের পথে ছেড়ে সমঝোতার পথে হাঁটবে না।
যদি এখনকার রাজনীতিকরা এটা করতে পারেন তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিছুটা হলেও এর যথার্থতা পাবে, বুঝবে উন্নয়নের এক স্বীয়, স্বতন্ত্র পথ আছে আর তা হলো সংলাপ ও কথোপকথন।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।