রাশেদ খান মেনন
’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ ও সারাবিশ্ব পৃথিবীর অন্যতম নৃশংস হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছিল। এই দিন উষালগ্নে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। জাতির পিতার সকল আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা দানকারি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন কামাল, পুত্র লেঃ শেখ জামাল, পুত্রবধুগণসহ শিশু শেখ রাসেলও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায় নাই। রেহাই পান নাই তার ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্যরা, ভাগ্নে যুবনেতা মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনিসহ তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, ভাই মুক্তিযোদ্ধা আবু নাসেরসহ বত্রিশ নম্বরে তার বাড়ির প্রহরা ও কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিরা। বঙ্গবন্ধুর উপর আক্রমণের খবর পেয়ে ছুটে আসা তার সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জামিলকেও এই হত্যাযজ্ঞে প্রাণ দিতে হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতার ইতিহাস এখন সর্বজনবিদিত। তার আর বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন নাই।
২। বঙ্গবন্ধু হত্যার বহু বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। দায়ী খুনীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে তাদের ফাঁসির হুকুম হয়েছে। কিন্তু ঐ রায় বিচারিক প্রক্রিয়া পার হয়ে বাস্তবায়িত হতে বহু বছর সময় লেগেছে। এখনও হত্যাকারীদের বেশ কয়েকজন বিদেশের মাটিতে পলাতক জীবনযাপন করছে। এদের কয়েক জনের অবস্থান চিহ্নিত হলেও তাদের আশ্রয়দানকারী দেশসমূহের আইনের ম্যারপ্যাঁচে এইসব পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে আনা এখনও সম্ভব হয় নাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকার কথা বললেও বাস্তবে তার কোন ফলাফল নাই। এর একটি বড় কারণ হল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সত্য হলেও এর পিছনের ষড়যন্ত্র এখনও সঠিকভাবে উদ্ঘাটিত হয় নাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তার তিন দফার এই শাসনামলে পার্লামেন্টে ও পার্লামেন্টের বাইরে এই হত্যাকান্ডের পিছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন, ঐ ষড়যন্ত্রের দায় নিরুপণের প্রতিশ্রুতি দিলেও অদ্যাবধি প্রতিশ্রুত একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় নাই এবং সেই ধরণের কোন কার্যকর উদ্যোগ আছে বলেও প্রতীয়মান হয় না।
৩। বঙ্গবন্ধুর এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পিছনের ষড়যন্ত্র ও হত্যাকারীদের বিচারের পদক্ষেপ প্রথম থেকেই বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনী খন্দকার মোশতাক পনেরই আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর ঐ বিচার বন্ধ করতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। ইতিমধ্যে জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতি হয়েছে। অপরদিকে তেসরা ও সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আইন বলে সংবিধান সংশোধন করে যে অর্ডার জারি করে তাতে মোশতাকের ঐ ইনডেমনিটি আইনকে সাংবিধানিক ছত্রছায়া দেয়া হয়। ১৯৭৯-এর দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ, একতা পার্টির বিরোধিতা সত্বেও তা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।
৪। ফলে ঐ বিচারকাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আইনের বাধা সৃষ্টি হয়। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাউত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তার হত্যার পর বিচারের দাবি সেভাবে রাজনীতির এজেন্ডাভূক্ত ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই তাঁর লাশ বত্রিশ নম্বরের সিঁড়িতে রেখেই তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যরা অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী খুনী মোশতাকের মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের কর্ণধার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার জাতীয় নেতাÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে গ্রেফতার ও জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর তরুণ সহকর্মীদের গ্রেফতার করে তীব্র নির্যাতন করা হয়।
একই সময় এটাও সত্য যে দু’একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ব্যতীত বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ সংঘটিত হয় নি। এই ব্যতিক্রমের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার অনুসারিদের নিয়ে ভারত সীমান্ত থেকে প্রতিরোধ গড়ার প্রচেষ্টা, বরগুনার এসডিও সিরাজুদ্দিন আহমদের ঐ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে চারদিনের মত খন্দকার মুশতাকের অবৈধ সরকারকে অস্বীকার করা এবং ছাত্র অঙ্গনে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রচারপত্র বিলি ও মফস্বল শহরে প্রতিবাদ মিছিলের চেষ্টা।
৫। ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সকল রাজনৈতিক দল অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় দেশে আর কোন রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য ও আইনী অস্তিত্ব ছিল না। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর ন্যাপ বাকশালে একীভূত হয়েছিল। অপরদিকে বিরোধীদল জাসদ, ইউপিপি ‘লেনিনবাদী পার্টি, বর্তমানের ওয়ার্কার্স পার্টি যার অন্তর্ভুক্ত ছিল’, জাগমুই আত্মগোপনে বাকশালের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার আগেই পনেরই আগস্টের ঘটনা ঘটে যায়। এটা ইতিহাসের সত্য যে, এইসব দল কেবল বাকশাল ব্যবস্থার বিরোধী ছিল তাই নয়, মুজিব শাসনামলের সাড়ে তিন বছরে রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী, স্পেশাল পুলিশ ও আওয়ামী লীগ দল দ্বারা চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছে, জেলে গেছে, হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। পাল্টা এই সব দলগুলোর মধ্যে জাসদ ১৯৭৪-এর শেষভাগে গণবাহিনী তৈরী করে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ গ্রহণ করেছিল। এর বাইরে সিরাজ শিকদার নিহত হলেও তার অনুসারি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিসহ গোপন অতি-বাম কমিউনিস্ট গ্রুপগুলো তখনও ‘বিপ্লবে’র নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিল।
৬। এই অবস্থা বাকশালের বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবি উত্থাপিত হয় নাই। বরং বহু বছর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের প্রশ্নটি রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ ও পাল্টাপাল্টির বিষয় ছিল। ফলে এই সময়কালে পুন:সংগটিত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি উত্থাপিত হলেও তা সাধারণ রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত হতে পারেনি।
৭। ইতিমধ্যে পনেরই আগস্টের ঘটনার সময় বিদেশে থাকায় জীবনে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন ও বিচারের জন্য বিদেশের মাটিতে ব্রিটিশ এমপি স্যার টমাস উইলিয়ামসকে প্রধান করে বঙ্গবন্ধু হত্যা তদন্ত কমিশন গঠন করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান ঐ ট্রাইব্যুনালকে বাংলাদেশে প্রবেশে অনুমতি দেয় নাই। বরঞ্চ স্যার উইলিয়াম টমাসকে বাংলাদেশে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে। টমাস উইলিয়ামকে বলেছিলেন, চিলির পর বাংলাদেশে তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে।
৮। বস্তুতঃ ১৯৮১-এর ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা দলের হাল ধরে তিনিই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রধান এজেন্ডায় পরিণত করেন। এদিকে প্রথমে জিয়া বিরোধী দশ দল ও এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী পনের দল গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বিষয়টি বিরোধী রাজনীতির অন্যতম এজেন্ডায় পরিণত হয়।
৯। এই সময়কালে সবসময় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার তরফ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কালোহাতের কথা স্পষ্ট করেই বলা হত এবং চিলির আলেন্দের মতই বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে একইভাবে সিআইএ-র হাত ছিল একথাও বলা হত। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক এ বিষয়ে বিশেষ সোচ্চার ছিলেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের এককালীন তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ চৌধুরীর একটি বই রয়েছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সে সময়টা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের সময়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তার সহায়তাকারী অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে বিবেচনা করলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ সে পথ থেকে ক্রমশই দূরে সরে আসে এবং জিয়া-এরশাদ আমলে বরং সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বৈরী নীতি অনুসৃত হয়। রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগও ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার দুরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। নব্বইয়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর আর কোন বাধা রইল না। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সিআইয়ের হস্তক্ষেপের বিষয়টি হারিয়ে যায়। এ বিষয়ে এখন আর বিশেষ কোন কথা শোনা যায় না।
১০। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি এখন সবার জানা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু মেজর, সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার বাহিনী নিয়ে এই অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। এরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নৃশংস হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে এই হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে ও তা কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এর সাথে যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা হলেও সেই সব কুশীলবদের চিহ্নিতও করা হয় নাই এবং তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয় নাই।
১১। সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে এটা সুস্পষ্ট যে, সে সময়ের সেনা উপ-প্রধান জিয়াউর রহমান এই মেজরদের চক্রান্ত সম্পর্কে জানতেন। খুনী ফারুকের দেয়া সাক্ষাতকার অনুযায়ী জিয়াকে তাদের এই উদ্যোগের বিষয় অবহিত করলে তিনি তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন নাই বা বাধা দানের কোনরকম চেষ্টা করেন নাই। সেনা কর্তৃপক্ষ বা সরকার কাউকে তিনি বিষয়টি অবহিত করেন নাই। নিজে নিরাপদ থাকার জন্য বরং ঐ মেজরদের তাকে না জড়াতে বলেন। এবং নিম্ন পর্যায়ের অফিসাররা কিছু করলে করতে পারে বলে জানান। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি মনোভাব নেবে সে সম্পর্কেও খুনী রশীদ-ফারুককে মার্কিন দূতাবাসে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। এসব আমার কথা নয় ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’ শীর্ষক বইয়ে অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক প্রয়াত মীজানুর রহমান খান বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আমি এখানে তার বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখাকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। আমি সকলকে বইটি পড়তে বলব।
জেনারেল জিয়াউর রহমান ছাড়াও ঐ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সেনা দপ্তরের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সকল বাহিনী প্রধানদের খুনী মুশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, পরবর্তীকালে ঐ সেনা প্রধানদের বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে মুশতাক সরকারের যোগদান ও তৎকালীন বিডিআর প্রধান জেনারেল খলিলুর রহমানের চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ হিসাবে নিযুক্তি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থনেরই পরিচায়ক।
১২। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যপটে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন খন্দকার মুশতাক। তিনি কতবড় বিশ^াসঘাতক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৪ আগস্ট রাতে নিজ বাড়ির রান্না দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আপ্যায়িত করার ঘটনায়। খুনী ফারুক-রশীদ বিশেষ করে খুনী রশীদ এই চক্রান্ত পর্বে সবসময়ই তার সাথে আলোচনা-পরামর্শ করেছে। চক্রান্ত বাস্তবায়নের দিন সম্পর্কে সাবধানতার কারণে মুশতাককে অবহিত করা না হলেও, তাকে যে পূর্ব মানসিক প্রস্তুতি দেয়া হয় তাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরপরই খন্দকার মুশতাক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিজে ক্ষমতা হাতে তুলে নিতে এতটুকু দেরি করেনি। দেশে তখনও সাংবিধানিকভাবে একজন উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কিন্তু মুশতাক সরাসরি নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নিয়ে তিনিই যে ঐ চক্রান্তের বেসামরিক হোতা তার প্রমাণ দিয়েছে। তার সাথে অতি দ্রুততার সাথে যুক্ত হয়েছে শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ। আর আমলাদের মধ্যে যুক্ত হয়েছিল মাহবুবুল আলম চাষী যিনি মুক্তিযুদ্ধে চলাকালেই পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তের সাথে যুক্ত ছিল। সে সময়ের প্রধান আমলার কথা নাইবা বললাম, তিনি প্রয়াত। বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর যারা দলে দলে ‘বাকশালে’ যোগ দিয়েছিল তারা এক মুহুর্তেই তাদের চেহারার পরিবর্তন করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ দূরে থাক তার বিরুদ্ধে নানারকম কটুকাটব্য করতেও দ্বিধা করে নাই।
১৩। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি আজকের আলোচ্য বিষয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যায় মার্কিন যোগসাজশের বিষয়টি সম্প্রতি অবমুক্ত হওয়া মার্কিন দলিলসমূহে দেখা যায়। মীজানুর রহমান খানের ঐ বইয়ে ঐ সকল দলিলের ভিত্তিতে তিনি উল্লেখ করেছেন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরপরই ১৯৭২ সালে খুনী ফারুক অস্ত্র সংগ্রহের নামে মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিল। সে দূতাবাসকে জানিয়েছিল অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সেনাবাহিনীতে যে কমিটি করা হয়েছে তার প্রধান উপ-প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন। তাদের পক্ষ হয়ে দূতাবাসে সে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে যায়। ১৯৭৩-এ এই একই বিষয়ে সরাসরি মার্কিন দূতাবাসে আবার যোগাযোগ করেছিল। আর ১৯৭৪-এর এপ্রিলে এসে মেজর ফারুক-রশিদ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকার বিরোধী কোন অভ্যুত্থান হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কি মনোভাব হবে সেটা জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ সবই ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো টেলিগ্রাম ও রিপোর্টে উল্লেখ আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে মার্কিন যোগসাজশ অনুসন্ধানরত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজের কাছে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জন বোস্টার বলেছিলেন যে, এ ধরনের যোগাযোগের ব্যাপারে মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত সকলকে নিষেধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সিআইএ নিজ থেকে এ ব্যাপারে কোন ভূমিকা রেখেছিল কিনা তা তিনি বলতে পারেন নি। তবে ঢাকায় সে সময়ে সিআইএ-র স্টেশন চীফ চেরী বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএ-র সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করে।
মীজানুর রহমান খান তার অনুসন্ধানে বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার বিষয় সম্পর্কে নিঃসংশয় হতে না পারলেও এই হত্যাকাণ্ডে মার্কিনী হাত থাকার ব্যাপারে দীর্ঘ সময় ধরে অনুসন্ধানকারী সাংবাদিক লিফসুজ বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে জড়িত ছিল সে বিষয়টি তার লেখায় একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন। তবে মীজানুর রহমান খান মনে করেন যে, ক্রমপ্রকাশমান মার্কিন দলিলসমূহে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
১৪। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই তা’হল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলেও এর পিছনে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী যোগসাজশের ব্যাপারে তদন্ত করে ঐ ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন, ঐ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দায় নিরূপণ করা জরুরি। মাননীয় আইনমন্ত্রী সংসদের আলোচনার বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে ‘জাতীয় তদন্ত কমিশন’ গঠনের কথা বলেছেন। মুজিববর্ষে সংসদের আলোচনায় সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ বহু সিনিয়র সংসদ সদস্য এই দাবি তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার জাতীয় এই শোক দিবসে কেবল তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, মিলাদ অনুষ্ঠান, কাঙালিভোজ ও আলোচনা সভা করেই শেষ করা ঠিক হবে না। এ বছর জাতীয় শোক দিবসে সকল জায়গা থেকে এই ‘জাতীয় তদন্ত কমিশন’ গঠনের দাবি তুলতে হবে। তা না হলে দেশে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি মাঝে মাঝেই দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, সাত দিনের মধ্যে সরকার ফেলে দেয়ার হুংকার দেয় তার স্বরূপ উন্মোচন করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। এখনই সময় অঙ্কুরেই তার বিনাশ সাধন। বাংলাদেশে আরেকটি পনেরই বা একুশে আগস্ট ঘটতে দেয়া যাবে না।
১৫। বঙ্গবন্ধু হত্যা কোন ব্যক্তি হত্যা ছিল না। ছিল না কিছু ‘বিপথগামী সেনা সদস্য’র হঠকারিতা। এই হত্যার জন্য ’৭২ সাল থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট তার বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পথভ্রান্ত হয়েছে, সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে অস্পষ্টতা রেখে দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলংকমুক্ত করা যাবে না, শংকামুক্ত করা যাবে না।
লেখক- সভাপতি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, ১৪ দলের অন্যতম নেতা
তথ্যসূত্র – ১। মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড; মীজানুর রহমান খান, প্রথমা।