মিথুন আশরাফ : টি-টোয়েন্টি সিরিজের পর ওয়ানডে সিরিজেও বাংলাদেশকে নাকানিচুবানি খাওয়ালো জিম্বাবুয়ে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৫ উইকেটে জিতে ওয়ানডে সিরিজও জিতে নিল জিম্বাবুয়ে। এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জয় করে নিল জিম্বাবুয়ে। সিকান্দার রাজা (১১৭*) ও রেগিস চাকাবভার (১০২) জোড়া সেঞ্চুরিতে সহজেই জিতে জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশকে খেলা যেন শিখিয়ে দেয়। প্রথম ওয়ানডেতেও ৫ উইকেটে জিতেছিল জিম্বাবুয়ে।
হারারে স্পোর্টস ক্লাবে এই ম্যাচেও টস হেরে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের অপরাজিত ৮০, তামিম ইকবালের ৫০, আফিফ হোসেন ধ্রুবর ৪১, নাজমুল হোসেন শান্তর ৩৮ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ২৯০ রান করে বাংলাদেশ। সিকান্দার রাজা ৩ উইকেট শিকার করেন। জবাব দিতে নেমে রাজা ও চাকাবভার সেঞ্চুরিতে ৫ উইকেট হারিয়ে ৪৭.৩ ওভারে ২৯১ রান করে জিতে জিম্বাবুয়ে। হাসান মাহমুদ ও মেহেদি হাসান মিরাজ ২টি করে উইকেট নিতে পারেন।
চোটে ছিলেন হাসান মাহমুদ। ওয়ানডেতে ফিরেই দেখিয়েছেন ঝলক। ১৩ রানের মধ্যেই ২ উইকেট হারিয়ে বসে জিম্বাবুয়ে। গতির ঝড় তুলে উইকেট দুটি শিকার করে নেন হাসান। চাপে যে পড়ে জিম্বাবুয়ে, সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ২৭ রান হতেই ওয়েসলি মাধেভেরেকে আউট করে দেন মেহেদি হাসান মিরাজ (২)। বিপদে পড়ে যায় জিম্বাবুয়ে। ১০ ওভারে গিয়ে ৩০ রান করে জিম্বাবুয়ে। তাতেই বোঝা হয়ে যায়, বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণেই থাকে ম্যাচ।
ওপেনার মারুমানি ও সিকান্দার রাজা মিলে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খুব দুরে যেতে পারেননি। দলের ৪৯ রান হতেই তাইজুল ইসলাম বোলিংয়ে এসে নিজের প্রথম ওভারেই মারুমানিকে (২৫) আউট করে দেন। বাংলাদেশ স্বস্তিতে থাকলেও অস্বস্তি ধরার জন্য রাজাই যথেষ্ট হতে পারেন। রাজা ও রেগিস চাকাবভা মিলে অস্বস্তি ধরানও। ২০ ওভারে গিয়ে ৮১ রান করে জিম্বাবুয়ে। ৫০ রানের জুটিও হয়ে যায়। স্কোরে ১০০ রানও হয়ে যায়। ২৫ ওভারে গিয়ে ১০৯ রান করে জিম্বাবুয়ে। ২৬তম ওভারে যেতেই মিরাজের করা দ্বিতীয় বলেই রাজাকে রান আউট করার সুযোগ হাতছাড়া করে বাংলাদেশ।
রাজা তখন ৪২ রানে। রাজা ও চাকাবভার জুটি ৬১ রানে থাকে। এমন সময়ে রান নিতে গিয়ে নিশ্চিত আউটের হাত থেকে বাঁচেন রাজা। রান নিতে গিয়ে পপিং ক্রিজ থেকে অনেক দূরে থাকেন রাজা। মিরাজের হাতে বল থাকে। স্টাম্পেও লাগান। কিন্তু বল থাকে ডান হাতে। স্টাম্পে লাগান বাম হাত। টিভি আম্পায়ার অনেক সময় দেখার পর রাজা যে আউট হননি, সেই সিদ্ধান্ত দেন। বেঁচে যাওয়ার পর মিরাজের বলে এক্সট্রা কাভার দিয়ে ছক্কা হাকিয়েই রাজা হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা শেষ ৫ ম্যাচের চারটিতেই ৫০ উর্ধ্ব ইনিংস খেলেন রাজা। ২১তম হাফসেঞ্চুরি করে জিম্বাবুয়েকে আশাও দেখান রাজা।
চাকাবভাও মারমুখি ব্যাটিং করতে থাকেন। ৩৬ বলে হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন। তাসকিন আহমেদের করা ৩০তম ওভারে টানা ৪ বলে চারটি চার হাকান চাকাবভা। দুইজন মিলে পঞ্চম উইকেটে শতরানের জুটিও গড়ে ফেলেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে এ উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি গড়েন রাজা ও চাকাবভা। রাজা একদিক আগলে রাখেন। চাকাবভা আরেকদিকে ধুমধারাক্কা ব্যাটিং করতে থাকেন। রানের গতি সচল রাখেন। ১৫০ রানের জুটিও হয়ে যায়। ৩৮তম ওভারে গিয়ে ২০০ রান করে ফেলে জিম্বাবুয়ে। ধীরে ধীরে যেন জয়ের দিকেই এগিয়ে যেতে থাকে।
আবারও সেঞ্চুরি হাকান রাজা। ১১৫ বলে সেঞ্চুরি করেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা দুই ওয়ানডেতেই সেঞ্চুরি হাকান। ৪২তম ওভার শেষে হাসান মাহমুদ বোলিংয়ে আসেন। রাজা সেঞ্চুরি হাকানোর পর একই ওভারে ছক্কা হাকিয়ে সেঞ্চুরি হাকান চাকাবভাও। ৭৩ বলে সেঞ্চুরি করেন চাকাবভা। ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি হাকান। সেঞ্চুরি হাকানোর পরই মিরাজের বলে ছক্কা হাকাতে গিয়ে ক্যাচ আউট হন চাকাবভা। ৭৫ বলে ১০ চার ও ২ ছক্কায় ১০২ রান করে তামিমের তালুবন্ধি হন। রাজার সাথে ২০১ রানের জুটি গড়ে আউট হন। পঞ্চম উইকেটে জিম্বাবুয়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ জুটি গড়ে ৭৫ বে আউট হন। দলের ২৫০ রানে চাকাবভার আউটে যেন একটু স্বস্তিও মিলে। রাজাকে যদি কোনভাবে আউট করা যায়, তাহলেই জয়ের সম্ভাবনা তৈরী হয়ে যাবে। কিন্তু তাই হলো না। ১২৭ বলে ৮ চার ও ৪ ছক্কায় অপরাজিত ১১৭ রান করে জিম্বাবুয়েকে জেতান রাজা। টনি মনইয়ঙ্কা অপরাজিত ৩০ রান করেন। ১৫ বল বাকি থাকতেই ১৯১ রান করে জিতে জিম্বাবুয়ে।
লিটন কুমার দাস ইনজুরিতে পড়ে সিরিজ থেকে ছিটকে পড়েন। তার স্থানে শান্ত একাদশে খেলার সুযোগ পান। এই পরিবর্তনের সাথে একাদশে আরও দুটি পরিবর্তন আনা হয়। তিন পরিবর্তন নিয়ে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে খেলতে নামে বাংলাদেশ। মুস্তাফিজুর রহমান হালকা চোট পাওয়ায় পেস আক্রমনে তার স্থানে হাসান মাহমুদকে নেওয়া হয়। আর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে একাদশের বাইরে রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে ৫ উইকেট শিকার করা স্পিনার তাইজুল ইসলামকে নেওয়া হয়।
লিটনের জায়গায় শান্ত খুব বেশি ভালো করতে পারেননি। তবে চেষ্টা করেছেন। ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের শুরুটা ভালোই হয়। ৭১ রান পর্যন্ত দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও এনামুল হক বিজয় এগিয়ে যান। কিন্তু প্রথম ১০ ওভারে, পাওয়ার প্লেতে হতাশ করেন তারা। ৬২ রান করে। ডট বলই হয় ৪০টি।
প্রথম ওয়ানডেতে ৫ উইকেটে হারের পর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সতর্ক শুরুই করেন ব্যাটসম্যানরা। তাই বলে এতটা স্লো খেলা হবে! দলের ৭১ রানে গিয়ে তামিম ইকবাল আউট হয়ে যান। ৪৩ বলে ৫০ রান করার পর আর ২ বল খেলতে পারেন। চিভাংগার এক্সট্রা বাউন্সেই আউট হয়ে যান তামিম। আর ৬ রান যোগ হতেই এনামুল হক বিজয়ও (২০) সাজঘরে ফিরেন। তবে রান আউটটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয়। বোলারের হাতে লেগে স্টাম্পে বল লাগে। তামিম ও বিজয় আউটের পর শান্ত ও মুশফিকুর রহিম দলকে শতরানে নিয়ে যান। ১২০ রানও অতিক্রম করে ফেলে। বড় স্কোর যোগ করার আশাও দেখান। কিন্তু ১২৭ রানে গিয়ে ৫০ রানের জুটি গড়ে আউট হয়ে যান মুশফিক (২৫)। স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ডিপ মিডউইকেটে ক্যাচ আউট হন।
মুশফিক আউটের পর শান্তও খুব বেশিদুর যেতে পারেননি। গড়তে পারতেন বড় ইনিংস। কিন্তু দলের ১৪৮ রানে গিয়ে উইকেটকিপারের তালুবন্ধী হন। এরপর রিয়াদ ও আফিফ মিলে উইকেট আকড়ে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন। দল ৪০তম ওভারে গিয়ে ২০০ রান করে। মনে করা হয়, এই জুটিই বোধহয় শেষটা করবেন। কিন্তু ২২৯ রানে গিয়ে রিভার্স সুইপ করে থার্ড ম্যানে থাকা চিভাংগার হাতে ক্যাচ আউট হন। দুইজন এত সুন্দর খেলছিলেন। ৮১ রানের জুটিও হয়ে যায়। আর বেশিদুর যেতে পারেননি।
একটা সময় মনে হচ্ছিল, ২৫০ রান করাই কঠিন হয়ে পড়বে। রান তুলতে যে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের বেগ পেতে হচ্ছিল। ৫ পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামা জিম্বাবুয়ে যে উজ্জ্বীবিত, তা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু রিয়াদ নিজেকে মেলে ধরেন। আফিফ আউটের পর আরও ৪টি উইকেট পড়ে। মেহেদি হাসান মিরাজ (১৫), তাসকিন আহমেদ (১), তাইজুল ইসলাম (৬), শরিফুল ইসলাম (১) আউট হন। কিন্তু রিয়াদ একাই স্কোর বাড়িয়ে নিতে থাকেন। শেষ ১০ ওভারেই ৮৪ রান হয়। শেষের ১০ ওভারে রিয়াদই করেন ৫৩ রান। ৬৯ বলে ৫০ রান করার পর, ২৬তম হাফসেঞ্চুরি করার পর ৮৪ বলে ৩ চার ও ৩ ছক্কায় অপরাজিত ৮০ রান করে দলকে ২৯০ রানে নিয়ে যান রিয়াদ। রিয়াদের ব্যাটে চড়ে ৩০০ রানের কাছে যায় বাংলাদেশ। দশ বছর আগে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সর্বশেষ জিম্বাবুয়ের কাছে সিরিজ হেরেছিল। আবারও সিরিজ হারল বাংলাদেশ। এখন ১০ আগস্ট তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে যদি বাংলাদেশ হারে, তাহলে হোয়াইটওয়াশ হবে।