স্টাফ রিপোর্টার – মোবাইলের সেবা তথা প্যাকেজ নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় গ্রাহকরা অপারেটরগুলোর একাধিক প্যাকেজ নিয়ে তাদের অভিযোগ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, একাধিক প্যাকেজের কারণে গ্রাহকেরা বিভ্রান্তিতে পড়েন।
ডাটা প্যাকেজের সংখ্যা কমিয়ে দামও কমার পক্ষে মত দিয়েছেন অনেকে। আবার বেশি প্যাকেজ থাকায় তাদের পছন্দের কথা জানিয়েছেন কিছু গ্রাহক।
মঙ্গলবার (৩০ মে) রাজধানীর রমনায় বিটিআরসিতে মোবাইল অপারেটরসমূহের সেবা (প্যাকেজ এবং ডাটার মূল্য) সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে গ্রাহকরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। অনলাইনেও কয়েকজন গ্রাহক সরাসরি অংশ নিয়ে মতামত দেন।
বিটিআরসি’র স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদের সভাপতিত্বে সভায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ, সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ এবং মোবাইল অপারেটরের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
বিক্রমপুর থেকে আসা টেলিটক সিম ব্যবহারকারী একজন গ্রাহক বলেন, টেলিটকের ঠিকমতো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এজন্য আগে নেটওয়ার্ক ঠিক করতে হবে, পরে প্যাকেজের বিষয়টি আসবে। আগে কাভারেজ পরে প্যাকেজ।
রাজধানীর মিরপুর থেকে আসা এক গ্রাহক বলেন, এত প্যাকেজ দিয়ে গ্রাহককে কনফিউজড করা হয় কেন? আমি নিজেও কনফিউজড হয়ে যাই। প্যাকেজের পাশাপাশি নেটওয়ার্ক নিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ চলে গেলে নেটওয়ার্কও থাকে না। এ বিষয়ও দেখতে হবে।
শাহ আলম নামে একজন গ্রাহক বলেন, আনলিমিটেড প্যাকেজে অনেক উপকার হয়েছে। কারণ যারা বেশি ডাটা ইউজ করি তারা প্যাকেজ নেওয়ার কথা ভুলে যাই। তবে আনলিমিটেড ফ্রি ডাটার বিপক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, এমন কিছু কনটেন্ট দেখার জন্য ডাটা দেওয়া হয়, যাতে সেই ফ্রি ডাটা দিয়ে দেখে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে এটা করা উচিত নয়।
ফরিদ উদ্দিন নামে একজন গ্রাহক বলেন, এত প্যাকেজ নিয়ে গ্রাহক বিভ্রান্ত হয়। ৩ দিন, ৭ দিন ও ৩০ দিন করা যায় কিনা বিটিআরসি এ বিষয়টি দেখতে পারে।
দিনাজপুর থেকে আসা আবু রায়হান নামে একজন গ্রাহক বলেন, প্যাকেজের মেয়াদ এক দিন, তিন দিন, পাঁচ দিন তুলে দিয়ে সর্বনিম্ন সাত দিন মেয়াদ রাখা হোক। বলা হয় ফোরজি ফাস্ট, কিন্তু এটা সবক্ষেত্রে নয়।
সিমের মালিককানা বদল নিয়ে তিনি বলেন, ছয় মাস ব্যবহার না করলে সিমটি রিজেক্টেড হয়ে যাবে, এটা কেমন ধরনের কথা। তাহলে সিম নিবন্ধনের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হোক। বর্তমানে একজন গ্রাহক ১৫টি সিম নিবন্ধন করতে পারে। সে তো ১৫টি সিম এক সাথে ব্যবহার করতে পারবে না। তাহলে তো সিম পড়ে থাকবে। একজন অনেক দিন পর হয়তো সেভ করা নম্বরে কল দিল তখন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
এ বিষয়ে বিটিআরসির নাসিম পারভেজ বলেন, বাবা-মা, ছেলে-মেয়, শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য নেয়। একেক অপারেটরের একেক সুবিধার কারণে সিম নেয়। সংখ্যা কমিয়ে দিলে সেই সুযোগটা থাকবে না।
কাপাসিয়া থেকে আসা টেলিটক ব্যবহার করা একজন ছাত্র বলেন, আমাদের জনপ্রিয় সিম টেলিটক। টেলিটকের ব্যাপারে আরেকটু গুরুত্ব দিলে মানুষ উপকৃত হবে। ঢাকায় নেটওয়ার্ক পাচ্ছি, ঢাকার বাইরে গেলে নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাচ্ছি না।
এক অপারেটরের কাছে প্রতারণার শিকার হয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, ১৮ টাকায় এক জিবির অফার দিল, কিন্তু কিনতে গিয়ে পেলাম না। কল সেন্টারে ফোন করে সেখান থেকে বলা হলো যে, ২০ টাকা রিচার্জ করে নিতে হবে। এটা প্রতারণা। একটার ভেতরে আরেকটা অফার কেন?
বাগেরহাট থেকে আসা একজন গ্রাহক বলেন, রবি ও এয়ারটেলের ডাটা কিনলে ডাটা ক্যারি ফরোয়ার্ড হয়। কিন্তু অন্য অপারেটরে কেন হয় না?
অনলাইনে মতামত দিতে অংশ নিয়ে এক গ্রাহক বলেন, ওটিটি প্লাটফর্ম থেকে একেক নেটওয়ার্ক কেন দরকার। এতগুলো নেটওয়ার্ক দরকার নেই। এতে আমরা কনফিউজড হয়ে যাই।
ওয়াইফাই ব্যবহারকারী গ্রাহক মিঠুন সিকদার বলেন, বিদ্যুৎ চলে গেলে নেটওয়ার্কও চলে যায়। এটা ঠিক করতে হবে।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে অনলাইনে অংশ নেওয়া ছাত্র রায়হানুর রহমান বলেন, আমাদের এলাকায় ফোরজি থাকে না। ছাত্রদের সমস্যা হয়। বাধ্য হয়ে একাধিক অপারেটর ব্যবহার করি। বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে নেটওয়ার্কও পাই না। ছাত্রদের জন্য আলাদা প্যাকেজ করা যায়, মেয়াদ বাড়ানো যায়, এক মাসের বেশি করা যায় কিনা। বার বার চাইলে বলে এই তো দিলাম, আবার দেব? এটা সমস্যার সৃষ্টি করে।
গ্রাহকদের অভিযোগের বিষয়ে বিটিআরসির মহাপরিচালক নাসিম পারভেজ বলেন, আমরা প্যাকেজ কমিয়েছি, আরও কীভাবে কমানো যায় তা দেখব। আপনারা যদি প্রমাণ দিতে পারেন কোন অপারেটর চারটির বেশি কমার্শিয়াল এসএমএস দিয়েছে, আমাদের জানাবেন আমরা কার্যকর ব্যবস্থা নেব।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, আনলিমিটেড সেবা প্রকৃত পক্ষে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করে না। তার চেয়ে জোর দেওয়া উচিত ন্যূনতম মানসম্পন্ন সেবা। খেয়াল রাখতে হবে গ্রাহক যাতে প্রতারিত না হয়।
এমটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ বলেন, ১৮ কোটি গ্রাহকের মধ্য থেকে যদি একশ বা দেড়শ গ্রাহকের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেই তাহলে সেটা যুক্তিযুক্ত হবে না। ‘এক দেশ এক রেট’ করে ভালো কিছুর পরিবর্তে অন্য কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি কিনা সেটা চিন্তা করার বিষয় আছে। ইয়ং জেনারেশন বিভিন্ন প্যাকেজ খোঁজে, তারা একাধিক অপারেটরের সিম ব্যবহার করেন।
রবির চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেন, প্যাকেজের সংখ্যা নিয়ে কিছু ভ্রান্তি আছে। কাস্টমারের কাছে কত প্যাকেজের চাহিদা সেটা মূল বিষয়। ১৮ কোটি গ্রাহকের ১৮ কোটি প্যাকেজের চাহিদা আছে। গ্রাহককে সবগুলো প্যাকেজ অফার করা হয় না। আমরা কাসন্টমার ভেদে প্যাকেজ অফার করি। কাস্টমারকে বেশি চয়েজ দেয়া দরকার, সীমা বেঁধে দিলে প্রতিযোগিতার ক্ষতি হবে।
গ্রামীণফোনের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর হোসেন সাদাত বলেন, আমরা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি উইন উইন সিচ্যুয়েশনে যেতে পারব।
বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, বছরখানেক আগে সবাই দামের কথা বলত। এখন দামের কথা বলে না, বলে মানের কথা। জ্বালানির দাম বেড়েছে, আমাদের যেন খরচটা না বাড়ে। আমরা ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছি তরঙ্গ কিনতে। মান আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।
টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব-উল-আলম বলেন, প্যাকেজ, ডাটার মেয়াদ এবং মূল্য নিয়ে বেশি উদ্বেগ। তিনটি বিষয়কে কীভাবে সমন্বয় করা যায় সেটা দেখতে হবে। মোবাইল ডাটার ক্ষেত্রে মানুষের প্রত্যাশা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ডাটার ক্যারি ফরোয়ার্ড কীভাবে করা যায় সেটি বিটিআরসি ইতিবাচকভাবে দেখবে। প্যাকেজের বিষয়টাও দেখবে। মানুষের যে ভোগান্তি দূর করতে হবে।
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের প্যাকেজ করা সহজ হলেও মোবাইলের ক্ষেত্রে কঠিন। কারণ ১৮ কোটি গ্রাহক।
বিটিআরসি’র স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ বলেন, আপনাদের মতামত নিয়ে খুব স্বল্প সময়ে এটা করে ফেলব।