Search
Close this search box.

২৫০তম জন্মবর্ষে রামমোহন

 

॥ স্বদেশ রায়॥

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, রাজা রামমোহন রায় যখন তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গাড়িতে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন সে সময়ে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পিতার বন্ধু রামমোহনের মুখে একটা বিষাদের ছায়া দেখতেন। রামমোহনের মুখে কেন সে বিষাদের ছায়া ছিল তা কোথাও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথ লেখেননি। তবে কারো বুঝতে কষ্ট হয় না, বাঙালি জাতির দুর্দিন সহ গোটা ভারতবাসীর দুর্দিন থেকে সত্যি অর্থে কোনো মুক্তির পথ খুঁজে না পাওয়াই ছিল রামমোহনের ওই বিষাদের ছায়ার মূল কারণ।

খুব ছোটবেলায় বাড়ি ছেড়েছিলেন রামমোহন। ওই সময়ে আর অন্য সাধারণ বাঙালি সন্তানের মতো তিনি ঘরকুনো হয়ে থাকেননি। তিনি বিস্তীর্ণ ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে, নিজ জন্মভূমি বাংলার পথে প্রান্তরে এক বালক পরিব্রাজক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, আসলে মানুষের জীবন ও মনোভূমিকে। আর এই পথ ঘুরতে ঘুরতে তিনি এক সময়ে তিব্বতে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। তিব্বত গভীর ঈশ্বর বিশ্বাস ও মুর্তিকে পূজা করার একটা দেশ। সে দেশে যখন তিনি পৌঁছান তখনও তাঁর কৈশোর কাটেনি। তারপরেও ওই দুর্দমনীয় মনের কিশোর বার বার বলতে গিয়েছেন এই অন্ধ বিশ্বাস নয়, যুক্তির সঙ্গে ঈশ্বরকে দেখতে হবে। যুক্তির সঙ্গে দেখতে হবে বাস্তব জীবনকে। আর যদিও তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী তারপরেও পরকালের থেকে তিনি জোর দিচ্ছেন বেশি ইহকালে। যার ফলে নেপালের ধর্মগুরুদের রোষানলে পড়ে বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হন রামমোহন। সেখানে তাকে বারবারই রক্ষা করেছে বিভিন্ন নারী। রামমোহন তাই তার কৈশোরে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য দেখতে পান। উভয়েই মানুষ হলেও নারী সহনশীল ও রক্ষাকর্তা। পুরুষের মতো আসুরিক চরিত্র তার ভেতর কম।

আর তাই বুঝি যখন তিনি পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী, যিনি প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন তাঁর ব্রাহ্ম সমাজ। যে সমাজ আসলে হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করে তিনি তাকে শুধু হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে রাজী নন। তিনি সকল ধর্মের মানুষের জন্যে উন্মুক্ত করতে চান ব্রাহ্ম সমাজ। আবার ওই একই সময়ে রামমোহন কোলকাতাতে দুই হাজারের বেশি দুর্গাপূজা অনুষ্ঠান করান। বা তার প্রধান পৃষ্টপোষক ছিলেন। তাঁর এ কাজে তিনি বির্তকিত হয়েছেন- সেই সময়ে। তাকে বলা হয়েছে যিনি নিরাকার ঈশ্বরের পথে সকলকে আনতে চান, তিনি আবার দুর্গাপূজা করাচ্ছেন। রাজা রামমোহন রায় কেন এই দুর্গাপূজা করিয়েছিলেন তার কোনো সত্যিকার ব্যাখ্যা মেলে না। তবে একটা হিসাব মেলানো যায়, তিব্বতের নারীদের ভেতর তিনি যে মাতৃরূপ দেখেছিলেন, এখানে দুর্গার নামে তিনি কি সেই মাতৃরূপের পূজা করাচ্ছেন! আসলে এ কোনো আকাশের দুর্গা নয়, একেবারে ঘরের মেয়ে দুর্গার পূজা, যে মাতৃরূপে মানুষের ভেতরকার সকল আসুরিক দিককে দমন করবেন। বাস্তবে তিনি এই চিন্তা থেকেই কী মনে করেছিলেন, নিরাকার ঈশ্বরের পাশাপাশি মাতৃরূপে নারীর পূজা করা উচিত। আর নারীর প্রতি এই শ্রদ্ধা থেকেই তিনি ইংরেজ যে সতীদাহ প্রথা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটাকে তিনি সমর্থন শুধু নয়, তার স্বপক্ষে নেমে পড়েছিলেন তাঁর সকল শক্তি দিয়ে।

মানুষের ভেতর যেমন শ্রেষ্টরূপ মাতৃরূপ এ যেমন রামমোহনকে আকৃষ্ট করেছিল তেমনি তিনি মূল ভাষায় সকল ধর্ম গ্রন্থ বা পৃথিবীর মাদার নলেজকে নিজের ভেতর ধারণ করে নিয়ে বুঝেছিলেন- সকল ধর্মের মূল কথা এক। এখানে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য যা তৈরি হয়েছে তা মূলত ডোবায় আটকে থাকা পঁচা জলের সঙ্গে সমুদ্রের স্রোতবাহী পানির যে পার্থক্য সেই পার্থক্য। আসলে ধর্ম অশিক্ষিতদের হাতে পড়ে এবং কিছু লোকের হাতে বন্দী হয়ে পড়াতে এই মানুষে মানুষে ধর্মের নামে পার্থক্য করছে। এবং তিনি বুঝেছিলেন, এখান থেকে মানুষকে বের করে আনতে হলে, সকল মানুষকে তার ধর্মগ্রন্থ বা সকল ধর্মগ্রন্থ নিজ নিজ ভাষায় পড়তে হবে। এ কারণে তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু সংস্কৃত ও আরবি শিখে সকল ধর্ম গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করার কাজ শুরু করেন। এই বিশাল জগত নির্মাণ কখনও একার পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরেও তিনি অনেক কাজ করেছিলেন। তার ওই কাজে আচার সর্বস্ব হিন্দু ধর্মের মানুষেরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ ধর্মগ্রন্থের একটি গণতান্ত্রিকায়ন হয়ে গিয়েছিল তার কাজের ভেতর দিয়ে। মাতৃভাষায় গ্রন্থ পেয়ে যে কেউ তা পড়তে শুরু করে দেয়।

তবে রামমোহন মোটেই নিজেকে শুধু ধর্ম সংস্কার আর সমাজ সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। কারণ, ইংরেজি ভাষায় ধীরে ধীরে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জনের ফলে তিনি ততক্ষণে পরিচিত হয়ে গেছেন পশ্চিমে যে উদারনৈতিক রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে-তার সঙ্গে। ভারতীয় দর্শনের উদারতার দিকগুলো, সেমিটিক দর্শনের সুফিবাদের উদারতার দিকগুলো আগেই তাঁর হৃদয়ে ও বোধের সঙ্গে ছিল তার সঙ্গে ইউরোপীয় এই উদারবাদের পরিচয় ঘটার পরে সত্যি তিনি ভারতবর্ষের প্রথম উদারনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে পরিণত করেন। আর অনেকটা নিজের সন্তানের মতো করে পালন করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথের বাবাকে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের রচনাবলী যারা পড়েছেন তারা সকলে এক বাক্যে বলবেন, রবীন্দ্রনাথ যদি না জন্মাতেন তাহলে ঠাকুরবাড়ির সেরা লেখক বা দাশর্নিক থাকতেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু রামমোহনের উদারনৈতিক চরিত্রের সংস্পর্শে অনেকটা পিতৃস্নেহে পালিত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাই আজো পৃথিবীর উদার পিতাদের একজন। পিতার ভেতর সাধারণত যে কঠোরতা থাকে তার বদলে মহর্ষি’র ভেতর দেখা যায় এক উদারতা ও প্রকৃতির মত বিশালতা। এমনকি জীবনের একটা প্রান্তে এসে তিনি নিজেকে প্রকৃতির পাশেই রাখতেন সব সময়। আর এই বিশাল প্রকৃতি ও  হৃদয়ের উদারতা তিনি প্রবেশ করাতে সমর্থ হয়েছিলেন তার প্রায় সবগুলো ছেলে মেয়ের মধ্যে, তবে নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটু বেশি। তাই আমরা যে উদার ও বিশ্বমানব রবীন্দ্রনাথ পাই, যাকে ছোটবেলা থেকে তাঁর পিতা তৈরি করেছিলেন, তাঁর ভেতর প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে গেছেন ভারত পথিক রাজা রামমোহন। তৃতীয় প্রজন্ম স্বাভাবিকই অনেক এগিয়ে যাবে, রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও তাই ঘটেছে। অর্থাৎ রামমোহন ছিলেন ভারতপথিক, রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন বিশ্বপথিক।

রামমোহন এই যেমন একজন রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টির সূচনা বাঙালি সমাজে করে দিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি তিনি ব্রিটিশ রাজত্বের ভেতর থেকেই বাংলায় তথা সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ যাতে উদারভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে সে কাজটিও শুরু করেন। তিনি ব্রিটিশের সঙ্গে দরকষাকষি করে ব্রিটিশকে অনেকখানি নমনীয় করেছিলেন। হ্যাঁ, অনেকে বলতে পারেন, রামমোহন- সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার ও মনোজগতের সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতার কথা বলেননি। এটা সত্য। কারণ, রামমোহন জানতেন ওই সময়ে পশ্চাৎপদ ভারতবাসী, রাজা ও সম্রাট শাসিত ভারতবাসী স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তারা তখনও দেশকে চেনেনি। তবে তাঁর উদার রাজনীতি, যার ভেতর দিয়েই শতবর্ষ না যেতেই একদিন কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল তাঁর উদার চিন্তাই একদিন বঙ্কিমচন্দ্রকে একটি নতুন দেশধর্ম তৈরির কাজে নিয়ে যায়। এই নতুন ধর্ম অর্থাৎ পূজার অর্ঘ দেয়া দেবী- মা নয়, এমনকি নিজের জন্মাদাত্রী মায়ের থেকেও দেশ মাতা বড়- এই যে দেশকে মা বলে আত্মত্যাগের এক আকাঙ্ক্ষা- এই দেশমাতার জন্ম বঙ্কিমচন্দ্র দিয়ে গেলেন -এও কিন্তু রামমোহনের উদার মানসিতকতার, ত্যাগের মানসিকতার পথ ধরে।

তাই ভাষা সাহিত্যের মানুষরা যেমন বলেন, রামমোহন বাংলা গদ্যের স্রষ্ঠা, তেমনি যারা রাজনৈতিক সংগ্রাম ও উদারনীতি নিয়ে কাজ করেন, তারা বলবেন, একটি উদার স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনা, স্বাধীনতা না চেয়েই রামমোহন করেছিলেন। আমরা আজও তাকে বুঝতে পারি না। আর এই বুঝতে না পারার কারণ, যে ধর্ম ও সমাজের কুপমুন্ডুকতা দেখে রামমোহন ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে বেশি সময় দিয়েছিলেন, আজও পৃথিবীর দেশে দেশে সেই ধর্ম ও সমাজের খণ্ডতা, ক্ষুদ্রতা। তাই আজ রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মবার্ষিকীতে এসে যে সত্য বলা প্রয়োজন, এ মুহূর্তে, ভারতীয়, সিনিক, সেমেটিক ও পশ্চিমা সভ্যতায় এক একজন করে রামমোহনের একান্ত প্রয়োজন। যাতে নিজ সমাজও সংস্কৃতিতে বসে তিনি সংস্কার করবেন তার সমাজ। কুসংস্কারকে মুক্ত করে বের করে আনতে পারবেন, প্রকৃত ওই সমাজের সংস্কৃতি, যাতে ভর করে বেড়ে উঠতে পারবে মানুষ। আর হয়তো এই নতুন নতুন  রামমোহনের অভাবেই আজ সারা পৃথিবীর উদারনৈতিক মানুষের মুখে বিষাদের ছায়া। হয়তো সেদিন রামমোহনের মুখে এমনি বিষাদের ছায়া দেখেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সিনিয়র সাংবাদিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ