সব্যসাচী দাশ
মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্ম হয়েছিল ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। সময়টা সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কম বেশি ধারণা আছে। আসলে বোঝাতে চাচ্ছি, ব্রিটিশ শাসনের অন্তিম পর্বের অস্থিরতার কথা। সেই সময়ের অসংখ্য ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত জীবনে সিনেমা ছিল বেঁচে থাকার অন্যতম অনুষঙ্গ। ভারতের স্বাধীনতা উত্তর রূঢ় সময়ে যে বা যারা ওই ক্লান্ত জীবনে মধুরতৃপ্তি জুগিয়েছেন তার মধ্যে মহানায়ক উত্তম কুমারের নাম সর্বভারতীয় সিনেমা মহলে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। কেউ কেউ তাকে এবং তার অভিনয়কে আফিমের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
উত্তম কুমার যখন জন্মেছিলেন তখন তার নাম রাখা হয়েছিল অরুণ কুমার। পরে তার দাদু নাম রেখেছিলেন ‘উত্তম’। মা চপলা দেবীর এই নাম পছন্দ ছিল না। তার যখন তিন মাস বয়স মামা বাড়ির কুল সন্ন্যাসী ‘শ্রী পূর্ণ সন্ন্যাসী’ উত্তমের হাসিমুখ দেখে ভবিষ্যত বলেছিল ‘এই ভুবন মহিনী হাসি একদিন গোটা বঙ্গদেশ মাতিয়ে তুলবে এবং এই উত্তম নামেই সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পাবে’। সত্যিই ঘটেছিল তাই। উত্তম কুমারের ভুবন মহিনী হাসি- ভুবন মাত করেছে! মৃত্যুর বেয়াল্লিশ বছর পরও আজো সেই হাসি অসংখ্য মানুষের মন ভোলায়! যে কারণে তিনি আজ এবং আগামীর মহানায়ক। মধ্যবিত্ত জীবন থেকে ফাইফ স্টার জীবন সবটাতে অভ্যস্ত ছিলেন এই মানুষটি। সবদিক থেকে অনেক ওপরে উঠেও কখন ভুলে যাননি শিকরের কথা।
আধুনিক সমাজের অভিজাত শ্রেণী থেকে অজোপাড়া গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষদের স্বপ্নের নায়ক ছিলেন। একটা ছোট্ট উদাহরণ, সময় ১৯৭৫ সাল তখন শক্তি সামন্তের ‘অমানুষ’ সিনেমার কাজ চলছে, ‘কি আশায় বাঁধি খেলা ঘর বেদনার বালুচরে’ এই গানটির শূটিং-এর জন্য কলকাতা থেকে লঞ্চ নিয়ে সুন্দরবন এলাকায় রওনা হলো সিনেমার পুরো টিম। গানের শূটিং হচ্ছে, সন্ধ্যাও নেমে আসছে। কাজ শেষ করতে করতে হঠাৎই বনের মধ্যে ঘন সন্ধ্যা নেমে এল লঞ্চের ভেতর, উত্তম কুমার, শর্মিলী ঠাকুর, উৎপল দত্তসহ আরও কয়েক জন। পরিচালক বলেন, এই লঞ্চ ঘোরাও, ক্যাম্পের দিকে চলো। অন্ধকারে বনের ভেতর ছোট ছোট নদী, চালক ঠিক দিক খুঁজে পাচ্ছিল না। কিছু দূর চলার পর মনে হচ্ছিল আরও গভীর বনের ভেতর তারা ঢুকে পরছে। শর্মিলী ঠাকুর ভয়ে ভীষণ অস্থির! লঞ্চের ওপর শক্তি সামন্ত। কিছু দূর যাওয়ার পর। একটা আলো দেখতে পান। চালকে বলেন, আলোর কাছে লঞ্চ নিয়ে চল। কাছে গিয়ে দেখে একটা ছোট্ট দোকান। লঞ্চ থেকে নেমে শক্তি সামন্ত বলেন, আপনাদের এখানে কোন শুকনো খাবার হবে। আমরা শহর থেকে এসেছি খাবার শেষ। দোকানদার এক ধামা মুড়ি নিয়ে লঞ্চের ভেতর আসে- এসে দেখে ভেতরে উত্তমবাবু! তাকে দেখে মুড়ির ধামা রেখে ষষ্ঠাঅঙ্গে প্রমাণ করেন। তারপর বলেন, আপনারা একটু অপেক্ষা করেন আমি আসছি। এই বলে লোকটা চেলে যায়, কিছুক্ষণ পর দেখা গেল। নদীর পাড়ে শত শত মানুয়ের হাতে হারিকেন। তারা চিৎকার করে বলছে, আমরা মহানায়কে দেখতে চাই! শেষে উত্তম কুমার লঞ্চ থেকে বেড় হয়ে সবার সঙ্গে দেখা করেন। এককথায় জঙ্গলের বাঘ তাকে চিনত, স্বচক্ষে দেখতে চাইতো! আর এটাই ছিল বাঙালির মহানায়ক।
আজ ২৪ জুলাই তাঁর একচল্লিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। এ নিয়ে তার সময়ের অনেক সুহৃদ বহু স্মৃতিচারণ করেছেন। প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্র জগত উত্তম কুমারকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না। আমাদের প্রথম দেখা ‘ঝিন্দের বন্দি’ ছবিতে। সেই থেকে আমি ওর প্রেমে পড়ে যাই। তারপর আমাদের পরিচয়ের গভীরতা বাড়ে। সে বন্ধুত্ব মহানায়কের জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিল’।
মহানায়ক প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘উত্তমদার আগে অনেক নায়ক এসেছেন আর পরেও আসবেন তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস দাদার মতো ক্যারিশমা তারা দেখাতে পারবেন না। সেটা সম্ভব নয়। তার মধ্যে একজন নায়কের সব যোগ্যতা ছিল। উত্তম ইজ দ্য বেস্ট’।
একসঙ্গে অনেক ছবিতে অভিনয় করা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘ওর সঙ্গে যখন অভিনয় করতে যেতাম, আমার মনে হতো যেন বাস্তবে ও আমার, আমার খুব কাছের, তাই ওই যে বলেন, আমাদের বোঝাপড়া সেই কারণেই এত ভাল ছিল। অভিনয়ের পেশাদারিত্বের খাতিরে উত্তম কুমার ছিলেন সর্বোত্তমের শিখরে। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন, আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল? আমি মজা করে আজও বলি, আমি ওর নায়িকা ছিলাম না, ওই আমার নায়ক ছিল।
অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক তার অভিনয় জীবনে মহানায়কের কাছ থেকে পেয়েছেন অকৃত্রিম ভালবাসা। স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার কাছে উত্তম দা ছিলেন একটা ইনস্টিটিউশন। আমি কখনও অভিনয় হাতে কলমে কোথায় শিখিনি। যা করতে পেরেছি সেটা এইসব গুণী মানুষদের অভিনয় দেখে। তাদের কাজ দেখে বিশেষ করে উত্তম দা বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। আমি কাজের বাইরেও ওর সঙ্গে আড্ডা দিতাম। সেটা কখনও পেশাগত আবার কখনও ব্যক্তিগত। অভিনয় নিয়ে তিনি মারাত্মক খুঁতখুঁতে ছিলেন। তাই তিনি মহানয়ক।