সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
একটি পত্রিকার তথ্যমতে, দেশে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৭৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৪ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ছয়জন। সংস্থাটির তথ্য বলছে, দেশের প্রায় সব কয়টি জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সদরদপ্তরের একটি প্রতিবেদনে চোখ রাখলে।
চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ৭ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়, যার মধ্যে ৩ হাজার ৫২৩টি ধর্ষণের। বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছর ধর্ষণের মামলা ১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৮ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১০ হাজার ৪০৮টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ছিল ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০২০ সালে প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৪৯ শতাংশ মামলা ছিল ধর্ষণের। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে এই হার ৪৮।
ধর্ষণ নিয়ে বছরের পর বছর অসংখ্য কথা হয়েছে। বিচারব্যবস্থাও ধর্ষণের গুরুত্ব ও তার বিচারের পদ্ধতি নিয়ে কম মাথা ঘামায়নি। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডের বিধানও হয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি উহ্য থাকছে, তা এই মানসিক ‘গণধর্ষণ’। যে মেয়ে নির্যাতিতা হয়, তার মতামত শুনবার প্রয়োজনটুকু অনুভব করবার জন্য নারীবাদী হতে হবে এমন নয়, সামান্য সংবেদনশীল হলেই চলবে
এগুলো কেবলই পরিসংখ্যান, বাস্তব অবস্থা আরও খারাপ। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কলের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। সেই হিসাব দিয়ে আর লাভ নেই। শুধু একটি কথাই প্রযোজ্য যে, ধর্ষণ কাণ্ড বেড়েছে। গণধর্ষণের শিকার কত কিশোরী, কত নারী বা কত মেয়ে শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে সেই হিসাব কেউ জানেনা। ধর্ষণ কেন বাড়ছে, সেটা সমাজ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করতে পারেন যদি তারা চান। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা মেয়ে এই সমাজে যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হন, তার খবর কে রাখে? বরং তাদের ঘৃণা করা, তাদের প্রতি কটু বাক্য নিক্ষেপে এগিয়ে আসে সমাজের বড় অংশই। অথচ সমাজ এবং সমাজের সেই সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এ ধরনের যন্ত্রণার মধ্যে ধর্ষণের শিকার নারীকে নিক্ষেপ না করে তাকে পুনর্বাসিত করা।
পুলিশ প্রশাসন এমনই এক প্রতিষ্ঠান, যার কাছে নির্যাতিতা নারী সর্বাগ্রে প্রতিকার আশা করে, সেরকম প্রত্যাশা হতেই থানায় অভিযোগ জানাতে যায়। আর পুলিশ কী করে? সাধারণভাবে বলা যাবে না সব পুলিশ তাদের প্রতি নির্দয় আচরণ করে, কিন্তু অসংখ্য ঘটনা আছে যেগুলোতে প্রমাণিত হয়, ধর্ষণ, সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার নারী থানা পুলিশে আস্থা রাখেনা। বারংবার থানায় হাজিরা দেয়া, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করাতে উপর্যুপরি পীড়াপীড়ি ও তদ্বির, পুলিশের হাজার প্রশ্নের (যেগুলির সবকটি খুব শালীনও নয়) জবাব দিতে-দিতে এই নারীরা আবারও প্রকাশ্যে ধর্ষণের শিকার হন। তাদের সাথে সমাজ ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো এমন আচরণ করে, যা ধর্ষণের যন্ত্রণা, গ্লানি ও অবসাদকে না কমিয়ে বরং আরও বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। ধর্ষণের শিকার নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনাটি তাই কেবল নির্দিষ্ট ভাবে ধর্ষকদের কাছ হতেই আসে এমন নয়, সমগ্র সমাজই এই আত্মবিনাশে প্ররোচনা দেয়।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে সারা দেশে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বিধান করে যে আইন হয়েছে, তার কোনো প্রভাব নেই আসলে। কোন কিছু ধর্ষণ কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, দীর্ঘসূত্রতা এবং দোষীদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বড় আঘাত আসে সমাজের দুই স্তর থেকে – রাজনৈতিক নেতা ও ধর্মগোষ্ঠী থেকে। এরা যখন ধর্ষণের শিকার নারীর পোশাক-আশাক ‘স্বভাব-চরিত্র’, একাকী চলাফেলা করা, ‘ রাতে বা অসময়ে’ পথে কেন ছিল এমন প্রশ্ন করে বা কটাক্ষ করে তখন কার্যত ধর্ষকদের অপরাধ লঘু হয়েই যায়। এ থেকেই ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার নারীর মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়। নরসিংদীতে স্লিভলেস জামা পরায় কিশোরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, আবার এর বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিচারকরের মন্তব্যকে সামনে এনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর ছোট পোশাকের বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করাও যে নারী নিপীড়ন সেটাও বোঝা সম্ভব হচ্ছে না এই সমাজের।
সমাজটাই এমন যে, মনের ক্ষত নিরাময়ের মতো কোন করুণাধারা সে বর্ষণ করে না। তাই ক্ষতস্থান হতে নিয়ত রক্তক্ষরণ হতেই থাকে। পুরো প্রক্রিয়াটিই গ্লানিময়। অভিভাবকদের প্রশ্নবাণ, পুলিশের বিচ্ছিরি জেরা এবং আদালত কক্ষের উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদ ও সাক্ষ্যদানের প্রক্রিয়ায় একটি নারীকে বারবার সেই ধর্ষণের যন্ত্রণা ও গ্লানিই ফিরিয়ে দেয়। তাই ধর্ষণ, নাকি ধর্ষণ-পরবর্তী পরিস্থিতি, কোনটি অধিকতর নির্যাতন, সে নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। ধর্ষণের শিকার নারীকে কীভাবে মানসিক কষ্ট হতে মানসিক ধ্বংসে পৌঁছে দেয়া যায়, এমনকী শারীরিক ধ্বংস অর্থাৎ আত্মহত্যার দিকেও ঠেলে দেয়া যায়, তার সব উদাহরণ আছে এই সমাজে। নারীর প্রতি সহিংসতার সংখ্যাতত্ত্বের মতোই অপরাধ-পরবর্তী সামাজিক নির্যাতনের নিরিখে এ দেশ পাকিস্তান আফগানিস্তানের মতই পেছনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
ধর্ষণ নিয়ে বছরের পর বছর অসংখ্য কথা হয়েছে। বিচারব্যবস্থাও ধর্ষণের গুরুত্ব ও তার বিচারের পদ্ধতি নিয়ে কম মাথা ঘামায়নি। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডের বিধানও হয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি উহ্য থাকছে, তা এই মানসিক ‘গণধর্ষণ’। যে মেয়ে নির্যাতিতা হয়, তার মতামত শুনবার প্রয়োজনটুকু অনুভব করবার জন্য নারীবাদী হতে হবে এমন নয়, সামান্য সংবেদনশীল হলেই চলবে।
লেখক- প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।