সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
বাংলাদেশের পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এখন কেমন? এক কথায় অনেকেই উত্তর দিতে চাইবেন– নৈরাজ্য। কদর্য শিক্ষক রাজনীতি আর আধিপত্যকামী ছাত্ররাজনীতির কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায়ই জাতীয় শিরোনাম হয়। শিক্ষক রাজনীতির নামে সরকারপন্থিদের পদ-পদবির লড়াই, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অনিয়ম আর ছাত্র-রাজনীতির নামে ক্যাডারদের একচ্ছত্র দাপট, হল দখল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, হলে হলে টর্চার সেল ও গণরুম সংস্কৃতি, জোর করে মিছিলে নেওয়া, যখন তখন পেটানোই এখানকার সংস্কৃতি।
এই মাত্র কয়েকদিন হয় ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির হুমকি, ধমকির কিছু শব্দ ভেসে এসেছে সামাজিক ও কিছু গণমাধ্যমে। এগুলো অশ্রাব্য কিন্তু তার চেয়ে বেশি হলো এসব কথা শুনলে বোঝা যায় এদের কাছে কতটা অসহায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ও প্রতিষ্ঠান প্রশাসন, এরা কতটা নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে! সারা দেশে এখন নিয়মিত বাড়ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। যেহেতু বড় জনসংখ্যার দেশ, তাই শিক্ষার্থী পেতে অসুবিধা নেই। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক উপাচার্যই নিজের পরিবার-পরিজনদের জন্য চাকরির ক্ষেত্র বানিয়েছেন ক্যাম্পাসগুলোকে, কেউ কেউ ব্যাপক হারে আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম করছেন, এমন আচরণ করেছেন যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে রাতের অন্ধকারে পুলিশ পাহারায় পালাতেও হয়েছে একজনকে।
আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসমূহে প্রায়ই যে সহিংস ঘটনা ঘটে এগুলো শুধু ক্যাম্পাসের ভেতরেই নয়, উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় ক্যাম্পাসের বাইরেও। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু সীমিত জায়গায় গড়ে ওঠে এবং আশপাশে আবাসিক এলাকা থাকে, ফলে এখানে কোনও গোলযোগ হওয়া মানে যেকোনও সাধারণ মানুষ ভিকটিম হতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে শঙ্কিত সাধারণ পড়ুয়ারা ও তাদের পরিবার। উদ্বিগ্ন শিক্ষামহল ও সমাজ। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি প্রায় সবার কাছেই ভয়ের ও আতঙ্কের।
স্বভাবতই ভর্তির সময় শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের প্রথম পছন্দ থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। না পারলে তারা যায় প্রাইভেটে। এর বড় কারণ অর্থনৈতিক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ কম, যেহেতু রাষ্ট্র ভর্তুকি দেয়। কিন্তু অনেকেই আছে যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টাই করে না। সুযোগ পেলেও প্রাইভেটে আসে। এদের এবং এদের পরিবারের কাছে অপছন্দ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতির দাপট, অস্থিরতা, সেশনজট। তাই তারা বেছে নেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে। শিক্ষার পরিবেশ, সেশনজট, রাজনৈতিক সংঘাত সবকিছু মিলিয়ে উদ্বেগ থাকায় খুব মধ্যবিত্ত ঘরের অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের বেসরকারিতে পাঠান। এখন তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তারা উদ্বিগ্ন। হঠাৎ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক হারে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কমিটি দিতে শুরু করেছে। আর এতে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর যৌক্তিকতাও আছে। ছাত্রলীগ শুরু করলে অন্যরাও এখন কমিটি দিতে থাকবে। এতে একটা সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। শুধু তা-ই নয়, সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কলহ কতটা ভয়ংকর, কতটা সহিংস তার প্রমাণ অসংখ্য।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার ধরন আলাদা। এখানে সারাক্ষণই কোনও না কোনও প্রকার কাজ ও সৃজনশীলতায় সক্রিয় থাকতে হয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অবাধ সময় নেই অকাজে ব্যয় করার। সেমিস্টার প্ল্যানের কারণে শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড চাপ থাকে। এর বাইরে আছে ক্যারিকুলামবহির্ভূত নানা কাজ। এতসবের মধ্যে রাজনীতি ঢুকলে লেখাপড়ার শিকেয় উঠবে বলেই উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা, পড়ুয়ারা এবং অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় যারা চালান সেসব কর্তৃপক্ষ।
হঠাৎ কী এমন হলো যে এখানেও ছাত্র রাজনীতি, কমিটি গঠন, এসব করতে হবে? এমন প্রশ্ন শুধু পড়ুয়ারা বা অভিভাবকরা করবেন তা নয়, করছে সমাজই। কারণ সবার জানা। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছাত্ররা আইন ভাঙবে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং তারা ভালো করেই জানবে তাদের পেছনে ক্ষমতাবানরা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দূরে থাকুক, পুলিশ বা প্রশাসনেরও তাদের স্পর্শ করার সাধ্য থাকবে না। পেছনে রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে এরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চাপে রেখে অনৈতিক সুবিধা আদায় করবে, যেটা আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, আরও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে। দক্ষতার সাথে পরিচালিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো একদম ভেঙে পড়বে বলেই আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়ুয়ারা রাজনীতি সচেতন এবং তারা ভোট দেয়। ফলে রাজনীতি তারা করতেই পারে। তবে তা ক্যাম্পাসে বড় দলের শাখা খুলে রাজনীতি করতে হবে তা নয়। রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া রঙহীন ছাত্র-রাজনীতি যদি করা যায় সেটা হতে পারে এবং আমার ধারণা সেটা আছেও। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক আছে, ভিন্নমত আছে, অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও তাদের অনেকেই এখন মানের দিক থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাইতে ভালো এবং ভালো করার একটা চেষ্টা আছে।
দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি সরে গেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পদ-পদবির লড়াই কমবে, টাকার খেলাও কমবে। পুরো সিস্টেমে জ্ঞানী ও সৎ লোকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। সত্যি হলো সেটা হবে না। চোখের সামনে সরকারি তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের দুর্দশা দেখার পরও কি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নষ্ট হতে দেবে সবাই?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি