ড. প্রণব কুমার পান্ডে
২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের সমীকরণের খেলা আমরা প্রত্যক্ষ করছি বেশ কয়েক মাস ধরে। গত সাড়ে ১৩ বছরে বিরোধী দল একেবারে কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও তারা এখন খোলস থেকে বের হয়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান করছে। মাঝে মাঝে তারা এমন বক্তব্য প্রদান করছে যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সরকার পতনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় আসবে। বিরোধী দলের সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু ভুঁইফোড় রাজনৈতিক সংগঠন। তারা জনগণকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছে।
কেউ কেউ আবার বলার চেষ্টা করছে যে তারা খুব দ্রুতই ক্ষমতা গ্রহণ করে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করবে। এ বিষয়গুলোকে সত্যিই হাস্যকর বলে মনে হচ্ছে দেশের বেশিরভাগ জনগণের কাছে। যাদের জনগণের সঙ্গে কোনও সম্পৃক্ততা নেই, তারাই বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
তারা নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য বিভিন্ন সময় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনাকে পুঁজি করে জনগণের মধ্যে এক ধরনের ভীতি সঞ্চার করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হলে এই গোষ্ঠী জনগণের মধ্যে এই বলে ভীতি সঞ্চার করতে চেয়েছিল যে খুব দ্রুত বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে। তখন এই জুজুর ভয় দেখিয়ে তারা জনগণের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি আনার চেষ্টা করছে। শ্রীলঙ্কার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে কয়েক মাস অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। বরং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধপরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং কেন্দ্র আগামী দিনে যেসব রাষ্ট্র ঝুঁকির মধ্যে মধ্যে রয়েছে তাদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার কোনোটিতেই বাংলাদেশ খারাপ অবস্থানে নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে যেখান থেকে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
শ্রীলঙ্কার ঘটনা পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা কমে যাওয়ার সাথে সাথেই এই গোষ্ঠী বলবার চেষ্টা করলো যে আগামী তিন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা হবে। কারণ, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল সেই সময়। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যাচার করার মাধ্যমে এই গোষ্ঠী জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভাগ্যদেবী কখনোই তাদের প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল না। ফলে যখনই তারা বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে, তখনই পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে চলে আসে। এর মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং একজন দূরদর্শী নেতার হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে। ফলে, বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার যে অপচেষ্টা তা সফল হবে না বলেই আমি মনে করি।
অতি সম্প্রতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থনীতির চারটি সূচক প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রত্যেকটিতে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই ইতিবাচক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের বিলাসী পণ্য আমদানিতে লাগাম টানার সুফল হিসেবে অর্থবছরের প্রথম মাস অর্থাৎ জুলাই মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে। নেতিবাচক ধারা থেকে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে। মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় কিছুটা ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে এবং রফতানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চারটি সূচকে উন্নতিতে সরকারসহ বাংলাদেশের জনগণ আশার আলো দেখছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে জুলাই মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমেছে। জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা জুলাই মাসে কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে। জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা জুলাইয়ে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। জুলাইয়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতিবিদ বলেছেন, এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতি আরও শক্তিশালী অবস্থান পৌঁছাবে।
একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে ২০২০ সাল থেকে চলমান দুই বছর মেয়াদি করোনা অতিমারির প্রভাবে সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল। যদিও বাংলাদেশ সেই সময়ও অন্যান্য বড় বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে ভালো করেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে যখন বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, ঠিক সেই সময় ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকট আরও ঘনীভূত হলে আমদানি ব্যয় এবং পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়ে, বিশেষ করে ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়। মুদ্রাস্ফীতি নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অঙ্কে পৌঁছায়। আবার হঠাৎ করে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করে। এ অবস্থায় একটি স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সঠিক নেতৃত্বের কারণে পরিস্থিতি খুব দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধন করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। পৃথিবীব্যাপী বড় বড় অর্থনীতির দেশ একই পথে হাঁটছে। ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশ বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণকে সাশ্রয়ী হবার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশে এমন কোনও পরিস্থিতি হয়নি যাতে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে হারিকেন মিছিল নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালাতে হবে।
আজ থেকে ১৫ বছর আগের সরকারের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের অবস্থা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। সেই সময় দেশে দিনের বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকতো না। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ১০০ শতাংশ বিদ্যুতায়নের যে অঙ্গীকার ২০০৮ সালে করেছিল সেটি তারা বাস্তবে করে দেখাতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেছে। তবে, পরিস্থিতির কারণে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ভর্তুকি না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে জনগণ ইতিবাচকভাবেই দেখছে। তাছাড়া মানুষের মধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। অতএব, আমরা সকলে মিলে যদি কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধন করি তাহলে সরকারের পক্ষে এই বিষয়গুলো মোকাবিলা করা সহজ হবে।
বিরোধী দলের সরকারবিরোধী অপপ্রচারের মাঝে গত ২ আগস্ট পাকিস্তানের ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ পত্রিকা ‘টেক অ্যাওয়ে ফ্রম বাংলাদেশ’স লিডারশিপ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। নিবন্ধটির লেখক সাহেবজাদা রিয়াজ নূর পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করার উপদেশ দিয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে সাহেবজাদা রিয়াজ নূর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সাবেক মুখ্য সচিব। লেখক নানান পরিসংখ্যান দিয়ে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের তুলনা করেছেন এবং শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে বলেছেন।
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের তুলনায় ১৯৭০ সালে দেশটির ৭৫% দরিদ্র ছিল। কিন্তু এখন পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫% ধনী। পাকিস্তানের তুলনায় ১৯৭০ সালের বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১ কোটি বেশি ছিল। বর্তমানে পাকিস্তানের ২৩ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ।
২০২১ সালে বাংলাদেশের রফতানি ৪৭ বিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে পাকিস্তানের ২৮ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১৫৪৩ ডলার, কিন্তু বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৫০০ ডলার অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তিনি পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রম থেকে শিক্ষা নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের মূল ধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারের ভালো কাজগুলো যথাযথভাবে প্রকাশ করা হয় না। এই সংস্কৃতি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। আমাদের মধ্যে একশ্রেণির মানুষ রয়েছেন যারা সবসময় হীনম্মন্যতায় ভোগে। কারণ, তারা সরকারের ভালো কাজগুলো উপস্থাপন করতে ভয় পায়। তারা যদি সরকারের ভালো কাজগুলো উপস্থাপন করে তাহলে সরকার দেশের জনগণসহ বিশ্বের মানুষের কাছে বাহবা পাবেন– এই বিষয়গুলো তারা মেনে নিতে পারে না। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হচ্ছে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করে সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করা এবং খারাপ কাজের সমালোচনা করা।
একই সাথে বাংলাদেশের কয়েকটি বিরোধী দল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারের সব কাজের সমালোচনা করে। সম্পূর্ণ যুক্তিহীনভাবে তারা সরকারবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের এই অপচেষ্টা কখনোই সফল হবে না। কারণ, দেশের নেতৃত্বে রয়েছেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যার বাবার হাত ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে গত এক দশকে দেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন এবং আগামী দিনে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে সকলে বিশ্বাস করে। অতএব, বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করে সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য সবার এগিয়ে আসা উচিত। তবে যারা বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করেন, অর্থনৈতিক ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি তাদের কপালে ভাঁজ তৈরি করবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়