ড. প্রণব কুমার পান্ডে
কোভিড-১৯ অতিমারি পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দেশের প্রায় সব খাতকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এরমধ্যে অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, সামাজিক এবং শিক্ষা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিমারির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছে। স্বাস্থ্য খাত ছাড়াও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। করোনাকালীন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মকে শিক্ষাক্ষেত্রে সহায়তা করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
অতিমারি চলাকালে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে সনাতন ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষণ কার্যক্রমকে অনলাইনে রূপান্তর করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত। ফলে অনলাইনে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এ দেশের শিক্ষার্থীরা। উন্নত বিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কারণ, তারা খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সনাতন ক্লাসভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনলাইনে রূপান্তর করতে পেরেছিল। এটা শুধু সম্ভব হয়েছিল অনলাইনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকার কারণে।
উন্নত বিশ্বের শিক্ষা কার্যক্রম খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনলাইনে রূপান্তরিত হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯-এর প্রথম দিকে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর ছিল না। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না।
তবে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন অতিমারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বেশ সহায়তা করেছে। বাংলাদেশে মোবাইল এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের পক্ষে পরিবারের অন্যদের ডিভাইস নিয়ে হলেও অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হয়েছে। যদিও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়া এবং বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকার কারণে অনলাইন কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা, শিক্ষাক্ষেত্রে অনলাইন কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। কারণ, অনলাইন কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে ডিভাইসের অপ্রতুলতা এবং ইন্টারনেট সংযোগের মূল্য পরিশোধ করার সামর্থ্য না থাকা। তাছাড়া নতুন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হতেও বেশ কিছুটা সময় লেগেছে শিক্ষার্থীদের।
প্রাথমিক স্তরে অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হলেও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অল্প সময়ের মধ্যেই ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমকে অনলাইনে রূপান্তর করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই ক্ষেত্রে বেশি সফল ছিল। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে তাদের শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে করোনার শুরুর দিক থেকেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা কম থাকা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবার কারণে অনলাইন কার্যক্রম শুরু করা সহজ ছিল।
অন্যদিকে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হওয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন কার্যক্রম চালু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল। তাছাড়া, অনলাইনে পাঠদান সম্ভব হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ ছিল স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনি জটিলতার কারণে পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু থাকার কারণে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যদিও ইউজিসির তত্ত্বাবধানে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছিল করোনাকালীন সময়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সনাতন শিক্ষণ পদ্ধতিতে ফিরে যায়।
তবে কোভিডকালে প্রযুক্তির ব্যবহার উচ্চ শিক্ষা স্তরে অপার সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করেছে। একদিকে যেমন অনলাইনে শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের সভা আয়োজন করার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক দিক থেকে লাভবান হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আমি আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডের বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে করোনা মোকাবিলার সময় ব্যবহৃত বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন অনেকটা সহজ করে তুলেছে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়েছে এবং সময়ের অপচয় রোধ করছে।
ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখনও অনলাইনে বিভিন্ন বৈঠক চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অতি সম্প্রতি বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে আমি দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদোন্নতি বোর্ডে অনলাইনে যুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের অফিসে অনুষ্ঠিত পদোন্নতি বোর্ড ফিজিক্যালি উপস্থিত হয়েছিলেন কয়েকজন সদস্য এবং প্রার্থী এবং আমি রাজশাহী থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছিলাম। অন্যদিকে, আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে প্রার্থী নিজেও জুম লিংকের মাধ্যমে বোর্ডে অংশগ্রহণ করেছিল। উপাচার্য মহোদয় নিজেও জুম লিংকের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়েছিলেন নিজের অফিস থেকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদস্যগণ সেই নির্বাচনি বোর্ডে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ফলে, আমার কাছে পরের বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ্ধতিটি বেশি ভালো লেগেছে। কারণ, আমরা জানি করোনা অতিমারির পরে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারও খুব কঠিন সময় পার করছে। একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের সভায় যোগদান করতে গেলে সেই সদস্যের টিএ, ডিএ এবং বৈঠকি ভাতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বড় অঙ্কের বিল প্রদান করতে হয়।
এই ধরনের নির্বাচনি সভায় ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হলে শুধু বৈঠকি ভাতা প্রদান করলেই হয়। ফলে, সরাসরি যুক্ত হওয়ার চেয়ে ভার্চুয়ালি যুক্ত হলে একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সদস্যদের সময় বাঁচে, ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দিক থেকে অনেকটা সাশ্রয় হয়। ভ্যালু ফর মানির দিক থেকে বিবেচনা করলে এই ধরনের সভা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হলে উভয় পক্ষের জন্যই তা লাভজনক হয়। ফলে কোভিডকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যে ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার আমরা করেছি সেই প্রযুক্তির ব্যবহার যদি চালিয়ে যেতে পারি সেটি আমাদের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য এবং সেটি অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ডিজিটাল বাংলাদেশের ওপর ভর করেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করবার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। অতএব, ডিজিটাল বাংলাদেশের জনগণ ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে তাদের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন- এটি সবার কাছে কাম্য।
তবে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখনও অনলাইনে এই ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যারা এই পদ্ধতির প্রয়োগ করছেন না তারা খুব যৌক্তিক কাজ করছেন না। যেকোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের ইনোভেশনের প্রয়োজন হয়। সেই ইনোভেশনগুলোকে যদি আমরা পরবর্তীতে কাজে লাগাতে পারি, তবে তা ইতিবাচক ফল আনতে পারে। করোনাকালে ব্যবহৃত প্রযুক্তি আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। অনলাইনে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি আমাদের সনাতন পদ্ধতির ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষাকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে রূপান্তর করতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। দুটিকে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর এভাবে যদি আমরা এগিয়ে যেতে পারি তাহলে আগামী দিনে কোভিড-১৯ অতিমারির মতো কোনও বিপদ এলেও আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে না।
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন তাদের উচিত প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে এই ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায় এবং একই সঙ্গে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা মেটানো যায় সে বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া। করোনা অতিমারি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমরা যেমন অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি এবং অনেক কিছু হারিয়েছি, ঠিক তেমনিভাবে অনেক নতুন নতুন জিনিস শিখেছি। অতিমারি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা যেসব বিষয় শিখেছি সেগুলো যদি ভবিষ্যতে ব্যবহার না করি তাহলে আমাদের এই শিক্ষণ কোনও কাজে আসবে না।
এ কথা ঠিক যে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে ইলেকট্রিক ডিভাইস, স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট এবং বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, ডিজিটাল বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির করার যে পরিকল্পনা সরকার হাতে নিয়েছে সেই পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ইন্টারনেটের মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই খারাপ। ফলে এসব বিষয় মাথায় রেখে কীভাবে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় সেই বিষয়ে কাজ করতে হবে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে যে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেই সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শুধু শিক্ষকদের প্রযুক্তিতে সংযুক্ত করলে হবে না, আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে বৃদ্ধি করতে হবে তাদের জ্ঞান।
লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।