Search
Close this search box.

মন্দা মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ

মন্দা মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ

ড. প্রণব কুমার পান্ডে

সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ২০২৩ সাল হবে বিশ্বের সব দেশের জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটা বছর। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সরকারের সঙ্গে জনগণ এবং অন্য অনুঘটকদের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কাজ করতে হবে।

করোনা অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে মানুষ যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে এবং সরকার যখন অর্থনীতিসহ অন্য ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী আবার এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ যুদ্ধে ইউক্রেনের হাজার হাজার মানুষ যেমন মৃত্যুবরণ করেছে, ঠিক তেমনিভাবে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। প্রথমদিকে ধারণা করা হয়েছিল, এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের ফলেও যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এতে রাশিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে গ্যাস ও জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, তেল, জ্বালানি ও অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে কয়েক গুণ।

বিভিন্ন দেশে এ যুদ্ধের প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করতে থাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। যুক্তরাজ্যের মতো দেশে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পরপর দুজন প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছে গত কয়েক মাস ধরে। ইউরোপের দেশগুলোতে তেল, গ্যাস এবং জ্বালানির অভাব দেখা দেয় ব্যাপকভাবে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলো অনেকটা পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। বিভিন্ন দেশে মধ্যরাতের পরে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে ইউরোপের অনেক দেশে বাসায় হিটার ব্যবহার না করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

করোনা অতিমারি-পরবর্তী ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব সামাল দিতে বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিকভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। আরও অনেক দেশের অর্থনীতি আগামী দিনে হুমকির সম্মুখীন হবে মর্মে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে ২০২৩ সালে বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে এখন পর্যন্ত আমাদের অর্থনীতি মোটামুটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ করার জন্য দেশের বাজারে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল বিধায়, ডলারের বিপরীতে দেশে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে কয়েকবার। একইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছিল মাস দুয়েক আগে।

আমাদের দেশে কয়েক মাস আগেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার ছিল যা এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের তরফ থেকে বিলাসপণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন পর্যন্ত মোটামুটি একটি ভালো জায়গায় রয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে পরিস্থিতি যদি খারাপ হয়ে যায়, তবে মন্দার প্রভাব দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পারে বাংলাদেশকে। আশার কথা হলো, বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার প্রবণতা এখনো ইতিবাচক রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে সতর্ক করে বারবার যে কথাটি বলার চেষ্টা করেছেন তা হলো, এই বৈশ্বিক মন্দা চলমান থাকলে এর প্রভাব আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি হতে পারে। আর সেই অবস্থা যদি তৈরি হয় তাহলে দেশে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিধায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ফলে দেশের জনগণের দুর্ভোগ অনেকটা কমে গেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ার ফলে পুনরায় মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেশ যখন বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে দেশের মধ্যে একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি করে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসায়িক ফায়দা লোটা যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

একইসঙ্গে যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার সময় সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এমন কথা বলা উচিত নয় যা জনগণের মনে কোনো ধরনের দ্বিধা তৈরি করতে পারে। আবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তি যখন সেই ব্যক্তির বক্তব্যকে সরকারের বক্তব্য নয় বলে ব্যাখ্যা দেন, সেটিও সরকারের জন্য খুব ভালো বার্তা বয়ে আনে না। ফলে যারা যে দায়িত্বেই থাকুন না কেন, নিজেদের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতের মাধ্যমে যদি কাজ করেন এবং বক্তব্য প্রদান করেন তাহলে দেশের জনগণ একদিকে যেমন সরকারের প্রতি আস্থাশীল হবে, ঠিক তেমনিভাবে জনগণের মধ্যে আগামী দিনের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব নিয়ে সংশয় তৈরি হবে না।

দুর্যোগের সময় সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সবাই মিলে যদি দুর্যোগ মোকাবিলা করা হয় তাহলে খুব সহজেই সেই দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব আগামী বছরে বাংলাদেশকে কতটা শক্তভাবে প্রভাবিত করবে এই মুহূর্তে তা বলা কঠিন। তবে, সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আমাদের মন্দা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে সরকার সফলভাবেই যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে, যেমনটা করেছে করোনা অতিমারির সময়। কিন্তু সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ২০২৩ সাল হবে বিশ্বের সব দেশের জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটা বছর। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সরকারের সঙ্গে জনগণ এবং অন্য অনুঘটকদের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে কাজ করলে সফলতার সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

লেখক : অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ