সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
নির্বাচন কমিশন যেদিন আগামী সংসদ নির্বাচনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করল, তখন সংসদের আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল জাতীয় পার্টি শিরোনামে আসছে নানা কাণ্ড করে। জাতীয় পার্টি মানেই অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা, অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা।
আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে মনে হচ্ছে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দলটি আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠছে। গত বুধবার সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইফ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামসহ সব ধরনের পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন জি এম কাদের। পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সাবেক মহাসচিব রাঙ্গাকে অব্যাহতি দিয়েছেন এবং এর মধ্যে এ আদেশ কার্যকরও করা হয়েছে।
এরশাদ বেঁচে থাকতেই পার্টিতে তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলেন রওশন এরশাদ এবং এখনও তাই আছেন। জাতীয় পার্টি আছে এবং থাকবেও এরশাদের নামের ওপরই, তবে সেটা সত্যিকারের একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়। এরশাদের এই দলের সবচেয়ে বড় ভিত্তি তার নিজ জেলা রংপুর। জাতীয় পার্টি আগামীতে নিজেকে মজবুত করতে পারে রংপুর কেন্দ্রিক আঞ্চলিক দল হিসেবেই।
দলে কোন কোন্দল নেই এবং গণতান্ত্রিক চর্চা দলে আছে, এমন একটি কথা জি এম কাদের বলে থাকেন প্রায়ই। কিন্তু দলের গঠনতন্ত্রই এমন যে, চেয়ারম্যান চাইলে যে কাউকে যখন তখন যেকোন পদ দিতে পারেন, কেড়েও নিতে পারেন। সাংগঠনিক কাঠামো এবং পরিচালন পদ্ধতিতে দলের প্রধানই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। দলের বিভিন্ন স্তরে নিয়োগ, অপসারণ বা নীতি নির্ধারণেও তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং দল প্রধানের হাতেই একক ভাবে ক্ষমতা।
গণমাধ্যম বলছে, মশিউর রহমার রাঙ্গা একা নন, নজরে রাখা হয়েছে আরও কয়েকজনকে। কিন্তু কেন? বলা হচ্ছে, এরা দুই নৌকায় পা রেখে চলছেন। একটি নৌকা যদি জাতীয় পার্টি হয়, আরেকটি কোন দল, সেটি অবশ্য পরিষ্কার করছেন না দলের কেউ। তবে একটি বার্তা পরিষ্কার করা হয়েছে, জি এম কাদেরের সমালোচনা করলে বা তার বলয়ের বাইরে গেলেই কতল।
দেবর ভাবির এই পার্টিতে এবারের অস্থিরতার নেপথ্য কারণ বলা হচ্ছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ও তার ভাই জিএম কাদেরের মধ্য দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসায়। কিছুদিন আগে রওশন এরশাদের দেওয়া এক সিদ্ধান্ত নিয়েই শুরু হয় তোলপাড়। আগামী ২৬ নভেম্বর দলের অনুষ্ঠেয় দশম সম্মেলন উপলক্ষে আট সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেন তিনি। কমিটিতে রওশন নিজেকে আহ্বায়ক ও দলের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম মসীহকে সদস্য সচিব করেছেন।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে একাংশের নেতৃত্ব দিতে থাকেন রওশন এরশাদ। কিন্তু মৃত্যুর আগে এরশাদ তার ভাই জি এম কাদেরকে দলের নেতৃত্ব দিয়ে যান। এরপর জি এম কাদের তার ভাবিকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করেন। পাশাপাশি তিনি জাতীয় সংসদে হন বিরোধীদলীয় উপনেতা। লম্বা সময় শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগতে থাকায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল হয়ে তাকে নেয়া হয় ব্যাংককে। এখনো সেখানেই আছেন। মাঝে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে দেশে ফেরার পর তাকে বিমানবন্দরে ঘটা করে স্বাগত জানিয়েছিলেন জিএম কাদেরসহ অন্য নেতারা।
এমন একটা দল যার গঠনতন্ত্র প্রচণ্ড স্বৈরতান্ত্রিক, যার নেতাদের মধ্যে সবসময়ই কোন্দল আর গ্রুপিং লেগেই থাকে, যে দলটির কোন গণমূখী কার্যক্রম চোখে পড়েনা কখনও, সেই দলেরও সমর্থন আছে কিছু এবং তাকে জোটে নিতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠিত বড় দলগুলো। ২০১৪ সালে আসন পেয়েছিল ৩৪টি, আর ২০১৮ সালে পেয়েছে ২০টি। পতিত স্বৈরাচারের দল হয়েও একই সঙ্গে বিরোধী দল এবং সরকারে থাকার বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে জাতীয় পার্টি।
এরশাদ নিজে যা ছিলেন, দলটিও তাই। তার মতোই আদর্শিক দৃঢ়তাহীন একটি দল জাতীয় পার্টি। বরাবরই আবর্তিত হয়েছে সুবিধাবাদের বিবেচনায়। দলটি গঠিত হয়েছিল এরশাদ যখর রাষ্ট্র ক্ষমতায়। কখনো এরশাদ বিএনপিপন্থিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, কখনো আওয়ামী লীগ থেকে সুবিধা নিয়েছে। বারবার ভেঙ্গেছে জাতীয় পার্টি। কতবার ভেঙ্গেছে সেটা খোদ দলের নেতারাই হয়তো বলতে পারবেন না। মূল জাতীয় পার্টি তো আছেই জি এম কাদেরের নেতৃত্বে, সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আছে জাতীয় পার্টি (জেপি) নিয়ে, নাজিউর রহমান নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার ছেলে আন্দালিভ রহমান পার্থ। কাজী জাফর আহমেদের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ও ডা. মতিনের জাতীয় পার্টি অস্তিত্বহীন হলেও এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদের নেতৃত্বে এখন সক্রিয় আছে জাতীয় পার্টি ‘পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার’।
ব্যক্তি এরশাদের মতই সকাল-বিকাল সিদ্ধান্ত বদলের দল জাতীয় পার্টি। মশিউর রহমান রাঙ্গাও যে ফিরে আসবেন, সেটাও দলের সবাই জানে। আসলে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কখনোই বিকশিত হতে পারেনি দলটি। বরাবরই থেকে গেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কোন্দল জর্জরিত একটি সংগঠন হিসেবে। গত তের বছরে বিএনপি যে দুরবস্থার ভেতর দিয়ে গেছে সেটাকে পুঁজি করে জাতীয় পার্টি সে শূন্যতা পূরণ করতে পারত। সেটা সে পারেনি এবং আর পারার কোন ক্রাণ নেই। জাতীয় পার্টি সংসদ ও রাজপথ- কোথাও সত্যিকারের রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
এরশাদ বেঁচে থাকতেই পার্টিতে তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলেন রওশন এরশাদ এবং এখনও তাই আছেন। জাতীয় পার্টি আছে এবং থাকবেও এরশাদের নামের ওপরই, তবে সেটা সত্যিকারের একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়। এরশাদের এই দলের সবচেয়ে বড় ভিত্তি তার নিজ জেলা রংপুর। জাতীয় পার্টি আগামীতে নিজেকে মজবুত করতে পারে রংপুর কেন্দ্রিক আঞ্চলিক দল হিসেবেই।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।