শাহনাজ পারভীন এলিস
সঙ্গীতশিল্পী মনিকা দেওয়ান। সঙ্গীত ও সুরপ্রেমী বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে স্কুলজীবনেই তার গানে হাতেখড়ি। মঞ্চে মনিকার গানের সাথে বাঁশি ও বাদ্যযন্ত্র বাজায় তার ছোটবোন লাবনী এবং বাবা মকবুল হোসেন। তিনে মিলে সমন্বিত মায়াময় সুরের আবেশে তারা ভাসিয়ে নিয়ে যান উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকদের। পথেপ্রান্তরে-এর পাঠকদের জন্য কণ্ঠশিল্পী মনিকা এবং তার পরিবারের গল্প লিখেছেন শাহনাজ পারভীন এলিস।
– গানের জগতে, বিশেষ করে বাউল গানের জগতে কীভাবে কার প্রেরণায় এলেন?
– গানের জগতে আসি মাত্র ৮ বছর বয়সে। তখন ধানমণ্ডির শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্কুলে পড়তাম। সেখানে প্রতি বৃহস্পতিবার গানের ক্লাস হতো। বাসায় ফিরে সেই গানগুলো সুর-লয় ছাড়াই গাইতাম। তবে গানের ক্ষেত্রে মূল প্রেরণা হলেন আমার বাবা,
হাওলাদার মকবুল হোসেন। তিনি ছেলেবেলা থেকেই বাউল গানের খুব ভক্ত। তাই গানের মানুষদের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। বাবা সারভর গান শুনে মুখস্থ করে বাসায় ফিরে আমাদের তা লিখতে বলতেন, গাইতে বলতেন। বাবার সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে আমাদের বাসায় বাউল শিল্পীদের আনাগোনাও ছিল। গান শুনতে গিয়ে জীবনে কী ধরনের ঘটনা ও পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে- তা আমাদের কাছে বাবা প্রায়ই বলতেন।
কোথাও পালাগান হবে জানলেই বাবা রাতভর গান শুনতেন; খুব ভোরে বাড়ি ফিরতেন। সেসময় গেট বন্ধ থাকতো বলে তাকে গেট টপকে ঘরে আসতে হতো। একদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পুলিশ চোর সন্দেহে তাকে ধরে নিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে এলাকার জসিম কমিশনারের সাথে তাদের দেখা হয়; তিনিও বাউল গানের খুব ভক্ত ছিলেন। বাবার সাথে তার পরিচয় ছিল। তাই তিনি তখন পুলিশকে বলেন, ‘তাকে ধরেছেন কেন? সে সাধারণ মানুষ; রাতে আমরা একসাথেই গান শুনেছি।’ তখন পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।
রাজু মিয়া নামে একজন বাঁশিবাদক বাবার বন্ধু ছিলেন। তিনি ধানমণ্ডি লেকে বাঁশি বাজাতেন আর ঘুরে ঘুরে বাঁশি বিক্রিও করতেন। বাবা তার কাছে বাঁশি বাজানোর তালিম নিতেন। বাঁশি কীভাবে বাঁধতে হয় সেটাও তার কাছ থেকেই শেখেন। কুমিল্লা বাঁশি আনতে গেলে মাঝেমধ্যে বাবাকেও সাথে নিয়ে যেতেন। এভাবেই আমার বাবাও ধীরে ধীরে বাঁশিবাদক শুধু নন, বাঁশি বিক্রিকেও পেশা হিসেবে বেছে নেন।
– পরিবারে আর কে কে আছে, গান নিয়ে আপনার পরিবারের ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই?
– বাবা-মা আর আমরা দুইবোন। ছোট বোন লাবনী আক্তার; পড়ছে বদরুন্নেসা কলেজে ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষে। সেও আমার সাথে গান করেন। ওর বিশেষত্ব হলো বাবার মতোই বাঁশি বাজাতে পারে। ছোটবেলায় শখের বশে বাবার কাছেই আমি আর
লাবনী বাঁশি শেখা শুরু করি। কিন্তু সেই প্র্যাকটিসে আমি ব্যর্থ হই আর লাবনী বাঁশিতে সুর তুলতে সফল হয়। পরে আসাদগেটে মৃত্যুঞ্জয় স্যারের কাছে কয়েক মাস বাঁশি বাজানো শেখে লাবনী। কিন্তু অর্থাভাবে তা আর বেশিদিন চালানো সম্ভব হয় না, বাসায়ই চলে প্র্যাকটিস। সম্প্রতি শিল্পকলার শিক্ষক মনিরুজ্জামান স্যারের বাসায় সপ্তাহে একদিন বাঁশির ওপর তালিম নিচ্ছে আমার বোন। এছাড়া সে হারমোনিয়াম, তবলাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রও খুব ভালো বাজাতে পারে। ভবিষ্যতে খ্যাতিমান বাঁশিবাদক হওয়ার স্বপ্ন দেখে লাবনী।
– কোন কোন শিল্পীর গান আপনার ভালো লাগে?
– সব ধরনের গানই শুনি। তবে ভালোলাগার গানগুলো একটু বেশি শুনি। বাউল জগতে মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, মাখন দেওয়ান, কাজল দেওয়ান, ছোট আবুল সরকার, রুমা সরকার, রশীদ সরকার, শাহ আলম সরকার- এরকম অনেকের গান ভালবাসি। এছাড়া আব্বাস উদ্দিন, মমতাজ, দিলরুবা খানম ও বারী সিদ্দিকীর গান ভীষণ পছন্দ করি।
– কোন ধরনের গান আপনার ভালো লাগে, কাউকে অনুসরণ করেন কী?
– মূলত বাউল ও ফোক গান করতে বেশি করি। ফকির লালন সাঁই, হাছন রাজা, বাউল আব্দুল করীমের গান ছাড়াও বিভিন্ন বাউল সাধকের আধ্যাত্মিক গান গাইতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তবে অনুষ্ঠানে গেলে বিভিন্ন ধরনের গানই গাওয়া হয়। নিজের মতো করে গাওয়ার চেষ্টা করি; এক্ষেত্রে কাউকে অনুসরণ করি না।
– আপনি তো পালাগান করেন। তো এপর্যন্ত কতগুলো পালা গানে, কোন কোন শিল্পীর সাথে গান করেছেন?
– কতগুলো আসরে পালাগান করেছি হিসাব করা হয়নি, অগণিত। কারণ সেই ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন বাউল ও পালাগানের আসরে অংশ নিয়েছি। যাদের সাথে পালাগান করেছি অনেকের নামও মনে নেই। তাদের মধ্যে রয়েছেন- বৈতাল কালাম দেওয়ান, সুজন দেওয়ান, সজল দেওয়ান, নয়ন দেওয়ান, ছোট খালেক দেওয়ান, বাবুল দেওয়ান, বাবুল সরকার, শিরীন দেওয়ান, বিলকিস বানু, হানিফ সরকার, কানন দেওয়ানসহ প্রখ্যাত বিভিন্ন শিল্পীর সাথে গান গাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে।
– আপনি কী সবসময় বাবা-বোনকে সাথে নিয়েই গান করেন?
– যদিও প্রোগ্রামের ধরন অনুযায়ী আমরা যন্ত্রশিল্পীদের বায়না করি। তবুও বেশিরভাগ গানের আসরে আমার সাপোর্টার হিসেবে বোন আর বাবা প্রায় সময়ই আমার পাশে থাকেন।
– পড়াশোনা কোথায় করছেন, সঙ্গীতের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা কী নিয়েছেন?
– মিরপুর বাঙলা কলেজে বাংলায় অনার্সে পড়ছি। প্রাথমিক শিক্ষা বরিশালের বাবুগঞ্জের একটি গ্রামের এক ব্রাক স্কুলে। ঢাকায় এসে ধানমণ্ডির শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী ঢাকার রায়ের বাজারের রিয়েল স্কুল। সেসময় রুদ্রবীণা একাডেমীতে তিন বছর গানের তালিম নিয়েছি। ধানমণ্ডির শংকরে আলী হোসেন গার্লস হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল এন্ড কলেজে। পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে সরাসরি গান শিখেছি।
– গান গেয়ে আপনি এবং আপনার পরিবারের যে উপার্জন হয়, তা দিয়ে কী সংসার খরচ চলে?
– আমার পরিবারের সদস্যরা সঙ্গীতপ্রেমী হওয়ায় কর্মক্ষেত্রটাও সঙ্গীতভিত্তিক হোক সেটাই প্রত্যাশা করে। তাই অন্য কিছু করার চেষ্টাও খুব বেশি করা হয় না। একারণেই আমার বাবা আগের পেশা মৌসুমী ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে বাঁশি বিক্রি করছেন।
এতে একদিকে বাঁশি বাজানো হয়, আর জীবিকার জন্য কিছু অর্থ উপার্জনও হয়। আর মাঝেমধ্যে স্টেজ প্রোগ্রাম করে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে কোন রকমে আমাদের সংসার চলে। তবে আগের মতো স্টেজ প্রোগ্রাম ও পালাগানের আসর এখন আর হয় না। তাই প্রোগ্রামের আশায় না থেকে গানের টিউশন করি; আমার সঙ্গীত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দিতে চেষ্টা করি, এতে কিছু সম্মানি আসে।
এছাড়া আমরা তিনজনই ২০২০ সাল থেকে ঢাকার নাট্যদল নাটনন্দনের সাথে গান ও মিউজিক কম্পোজিশনের কাজ করছি। করোনা মহামারিকালে ঢাকাসহ সারাদেশে লকডাউন থাকায় উপার্জনের সব পথ যখন বন্ধ, তখন আসমা আকতার লিজা আন্টি তার দল নাটনন্দন-এর সাথে আমাদের কাজ করার সুযোগ করে দেন। লিজা আন্টি লালমাটিয়ার মেহমানখানা’র চেয়ারম্যান। তার সহযোগিতায় আমরা দুই বোন মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় ‘লিডো’ নামে এক প্রতিষ্ঠানে সঙ্গীত প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজে যোগ দেই। ওই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম করোনা লকডাউনের মধ্যে চলমান ছিলো। সংসারে অভাব-অনটন থাকলেও চাকচিক্য বা বিলাসী জীবন আমার পরিবারের কারো কাম্য নয়, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে সম্মানের সাথে আমরা বাঁচতে চাই।
– গানের ব্যাপারে আপনার বাবার বক্তব্য ও অনুভূতি জানতে চাই?
– বাবার জন্যই আমাদের গানের জগতে আসা। বাবা ছোটবেলা থেকেই আমাদের শিখিয়েছে- ‘জীবনে কারো বোঝা হয়ে নয়, নিজের আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচবে। কারণ টাকা পয়সা অনেকেই উপার্জন করে, কিন্তু সম্মান নিয়ে সবাই পথ চলতে পারে না।’
– গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
– গান নিয়ে আমার একা কোন স্বপ্ন দেখি না। পরিবারে আমরা দুই বোন এবং বাবা-মায়ের স্বপ্ন- ভবিষ্যতে একটা সঙ্গীত একাডেমী গড়া। যেখানে থাকবে হাজারো সঙ্গীত প্রেমী ও সংস্কৃতিমনা মানুষের আনাগোনা; সেটা হবে এক অন্য জগত- যেখানে ভেদাভেদ ভুলে সমাজের সবাই মিলেমিশে কাজ করবে।
– গানের ব্যাপারে আপনার মায়ের ভূমিকা ও সহযোগিতা সম্পর্কে জানতে চাই?
– সঙ্গীতের জগতে পথচলায় মায়ের অনুপ্রেরণা ও পরোক্ষ অবদান সবসময়ই আমাদের পাথেয়। আমরা যেন পড়াশোনার পাশাপাশি গানটা করতে পারি সেজন্য ঘরের কাজ করতে দিতেন না। রাত-বিরাতে প্রোগ্রাম করে বাসায় ফিরে দেখি মা জেগে বসে আছেন। আমরা ক্ষুধার্থ থাকবো- তাই না ঘুমিয়ে রাতেই খাবার রান্না করে রাখতেন। আমাদের প্রোগ্রামে যাওয়ার আগে বা পরীক্ষা দেওয়ার আগে খাবার খেতে না চাইলে খাবার মেখে আমাদের পেছনে পেছনে ঘুরে খাবার খাইয়ে দিতেন, আর আমরা রেডি হতাম। সংসারে অভাব-অনটন যতই থাক মা হাসিমুখে আমাদের সব আবদার সাধ্য অনুযায়ী পূরণের চেষ্টা করেন।
আসলে সুরটাকে আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরা পরিপূর্ণ রুপে ধারণ করতে চাই। বর্তমান গানের যেই অবস্থা- দু-চারটা গান শিখেই মামার জোরে স্টার বনে যাওয়া; আমরা সেরকম হতে চাই না। সুরের রাজ্যকে সাধনা দ্বারা জয় করে একটা সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছাতে চাই। আমাদের সঙ্গীত জগতে অনেক গুণী শিল্পী আছেন; যারা আজীবন সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন- সেরকম কিছু করতে চাই।